
মাহমুদকাটি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার নদীপারের গ্রামটি আর দশটি গ্রামের মতোই ছিল একসময়। প্রত্যন্ত গ্রামটিতে অশিক্ষা, বাল্যবিবাহ, কুসংস্কার—সবই ছিল রোজকার বিষয়। তবে ১৯৯০ সালের পর এলাকাটি বদলে যেতে শুরু করে। এখন সে গ্রামে বাল্যবিবাহ হয় না। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই খোঁজ মেলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে কর্মরত মানুষদের।
কীভাবে এল এই পরিবর্তন? এসব সম্ভব হয়েছে একটি গ্রন্থাগারের কল্যাণে। নাম তার অনির্বাণ লাইব্রেরি। গ্রন্থাগারটি শুধু বইয়ের আলোয় মানুষকে আলোকিত করেনি, হয়ে উঠেছে এলাকার মানুষের কাছে আস্থার প্রতীকও।
১৯৯০ সাল। দেশে তখন প্রবল গণ-আন্দোলন। এমনই এক সময়ে ওই গ্রামের কয়েকজন যুবক ভাবছিলেন গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করার কথা। একদিন সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে দিতে স্থানীয় সোনাতনকাটি গ্রামের জয়দেব ভদ্র (বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের সিলেট রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি) ও মানিক ভদ্র, মাহমুদকাটি গ্রামের বিশ্বকর্মা মণ্ডল ও হরিঢালী গ্রামের মৃণাল ঘোষ সিদ্ধান্ত নিলেন, গ্রামে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করবেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজও শুরু হলো। এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয় স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের। ১৯৯০ সালের ১০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে লাইব্রেরিটি। প্রথমে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের বাড়িতে যেসব বই ছিল, সেগুলো দিয়ে শুরু হয় কার্যক্রম। এরপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
অনির্বাণ লাইব্রেরির সভাপতি অধ্যাপক কালিদাশ চন্দ্র চন্দ বলেন, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার পর ঘরে ঘরে গিয়ে এলাকার ছেলেমেয়েদের ডেকে এনে বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত করা হতো। আর এখন ছেলেমেয়েরা এমনিতেই চলে আসে কার্যক্রমে অংশ নিতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী লাইব্রেরিটি এখন অনেক পরিপূর্ণ।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে লাইব্রেরি ঘিরেই এলাকায় গড়ে ওঠে ছোট পরিসরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। শুরু থেকেই প্রতি সপ্তাহে এলাকার ছেলেমেয়েদের নিয়ে লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে বসত পাঠচক্র। এলাকার স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতি সপ্তাহে হতো বৈঠক। উচ্চশিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হতো তরুণদের। শুধু তা-ই নয়, লাইব্রেরির আয়োজনে এলাকায় তিন মাস পরপর করা হতো ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প। এসব ক্যাম্পে থাকতেন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ওই এলাকার চিকিৎসকেরা।
মাহমুদকাটি গ্রামের হরিসভা মন্দিরের একটি ঘরে শুরু হয়েছিল গ্রন্থাগারের কার্যক্রম। মন্দির চত্বরে আয়োজিত হতো বিভিন্ন অনুষ্ঠান। ২০১৩ সালের দিকে নিজেদের একটি আলাদা ভবন করার পরিকল্পনা করে লাইব্রেরি কমিটি। পরিকল্পনা থেকে পাশেই পাঁচ বিঘা জমি কিনে তাতে তৈরি করা হয়েছে নতুন ওই তিনতলা ভবন।
শুরুতে শুধু শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে কাজ করলেও বর্তমানে লাইব্রেরিকেন্দ্রিক কাজের পরিধি অনেক। এলাকার মানুষ যাতে কোনোভাবেই পিছিয়ে না থাকেন, সে চেষ্টাই করে যাচ্ছে লাইব্রেরি। লাইব্রেরিকেন্দ্রিক এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি পরিচালনা পর্ষদ। ৩৩ সদস্যের ওই পর্ষদের সিদ্ধান্তের আলোকেই পরিচালিত হয় বিভিন্ন কার্যক্রম। লাইব্রেরি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা এলাকার যাঁরা বাইরে বিভিন্ন উচ্চ পদে চাকরি করেন, তাঁরা বিভিন্ন অনুদান জোগাড় করে দেন। এ ছাড়া সরকারি ও সদস্যের টাকায় চলছে কার্যক্রমগুলো।
তিনতলা লাইব্রেরি ভবনে রয়েছে মেডিকেল চেম্বার। সেখানে প্রতি শুক্রবার বিকেলে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগী দেখে থাকেন। প্রয়োজন অনুযায়ী গরিব রোগীদের বিনা মূল্যে কিছু ওষুধও সরবরাহ করা হয় লাইব্রেরির পক্ষ থেকে। সপ্তাহে তিন দিন চলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্লাস। এলাকার মানুষকে কম্পিউটার শিক্ষায় পারদর্শী করতে তৈরি করা হয়েছে কম্পিউটার ল্যাব। সেখানে বেতনভুক্ত একজন প্রশিক্ষক রাখা হয়েছে।
বর্তমানে অসহায় মানুষকে সাহায্য করার জন্য তৈরি করা হয়েছে অনির্বাণ মানবিক সহায়তা তহবিল। পাশাপাশি সামাজিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নিতে অনির্বাণ ছাত্র সংসদ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। সংগঠনের সদস্যরা খুলনার পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলা এবং সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ গাছ লাগিয়েছে। চলতি বছর আমন মৌসুমে দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় কৃষকদের হাতে ২০ লাখ টাকার ধানবীজ সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার ঢেউটিন ও ৭ লাখ ৩০ হাজার টাকার ত্রাণসহায়তা দিয়েছে অনির্বাণ লাইব্রেরি। করোনাকালে অসহায় পরিবারগুলোকে খাদ্যসহায়তাও করা হয়েছে লাইব্রেরির পক্ষ থেকে।
বর্তমানে লাইব্রেরিতে রয়েছে সাত হাজারের মতো বিভিন্ন ধরনের বই। সাধারণ সম্পাদক প্রভাত দেবনাথ বলেন, ‘আমরা চাই লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করতে। মানুষের আস্থার প্রতীক করে গড়ে তুলতে।’ বইয়ের সংখ্যা অনেক বাড়াতে চায় এই লাইব্রেরির পরিচালনা পর্ষদ। যাতে জ্ঞান অর্জনে কোনোভাবেই পিছিয়ে না থাকে মাহমুদকাটি ও আশপাশের মানুষেরা।