
এক
কয়েক দিন আগের কথা। ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় নারী দিবসের অনুষ্ঠান চলছে। মঞ্চে বক্তৃতা দিতে গেলেন অনুষ্ঠানের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কথার শুরুতেই তিনি বউকে নিয়ে বেশ একটু হাস্যরস করলেন, ‘আমি তো বউকে গাড়ি চালাতে দিই না। যদি অন্য গাড়িকে ধাক্কা দেয়। বউ গেলে বউ পাব। গাড়ি নষ্ট হলে গাড়ি পাওয়া কঠিন। গাড়ি সারাতে অনেক খরচ। হা হা হা হা...। সবাই বউকে ভয় পায়। আমিও ভয় পাই। এসব শুনলে রাগ করবে। বলবে, এত মেয়ের মধ্যে গিয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আজ বাড়িতে গেলে খবরই আছে। বউ ঢুকতে দেবে কি না কে জানে?’ বলেই আরেক চোট হাসি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেক পুরুষই এতে যেন বিপুল আনন্দ পেলেন!
দুই
সহকর্মীর বাড়িতে অফিসের কয়েকজনের পরিবারসহ দাওয়াত। খাবার টেবিলেই এক ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীকে ডাকলেন, ‘কই, শুনে যাও। এই ভাবির পা ধোয়া পানি খাও। কী ভালো রান্না করে, দেখেছ।’ ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিত হয়ে যান সেই নারী। কিছুই বুঝতে পারছেন না। খাবার ঘরের পরিবেশটাই বদলে গেল। তিনিও যেমন বিব্রত হলেন, তেমনি অন্যরাও। পরিবেশটা হালকা করতে আরেকজন বললেন, ‘আরে, আপনার স্ত্রীও তো ভালো রান্না করেন। আমরা তো ভাবির হাতের রান্না খেয়েছি। এভাবে বেচারাকে লজ্জা দিচ্ছেন কেন?’
তিন
বোনের বিয়ে। বাড়িভর্তি লোক। একটু পরপর চা খাওয়া আর আড্ডা চলছেই। এর মধ্যে বাড়ির বড় ছেলে তাঁর বউকে নিয়ে বেশ একটু মজা নিলেন। বললেন, ‘ও তো অফিসে ডেস্কে বসে থাকে, তাই তো এমন স্বাস্থ্য। ঘরের কাজ করলে, ঘর গোছালে স্বাস্থ্য কমত। খাওয়া দেখলে মাথা ঠিক থাকে না।’
এসব কী বলছে স্বামী! বউয়ের যেন নিজের কানকে বিশ্বাস হতে চায় না। এক-দুবার নিজের শোবার ঘরে বলেছে। তখনো খারাপ লেগেছে শুনতে। তাই বলে সবার সামনে এভাবে বলতে হবে!
ওপরের তিনটি ঘটনা বাস্তব থেকে নেওয়া। জীবনে অনেক সময় এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় স্ত্রীকে। অনেক স্বামী অন্যের সামনে বউকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। ব্যঙ্গ করেন। স্থূল রসিকতা করার প্রবণতাও দেখা যায় কারও কারও মধ্যে। নিজের ঘরেই হোক বা বাইরে—বউকে নিয়ে রসিকতা করা একধরনের অসৌজন্য। ব্যক্তির রুচিবোধ, সৌজন্যবোধ, বিনয় এবং অন্যকে কতখানি শ্রদ্ধা করেন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এসব কথার মধ্য দিয়ে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, যে ব্যক্তির জীবনে অনেক অপূর্ণতা থাকে, ব্যর্থতা থাকে, নিজেকে নিয়ে সারাক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন, তাঁর মধ্যে স্ত্রীকে ছোট করার প্রবণতা দেখা যায়। আবার স্ত্রী যদি স্বামীর থেকে বেশি বেতন পান, ক্ষমতায়িত হন তখনো একধরনের হিংসাত্মক মনোভাব থেকে তাঁরা এ ধরনের কথা বলেন। হাফিংটন পোস্ট-এর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, বউ যদি রান্না করতে না পারেন, গাড়ি চালাতে না পারেন, কোনো বিষয়ে দক্ষ না হন, তবু তাঁকে নিয়ে রসিকতা করা ঠিক নয়। নিশ্চয়ই তাঁর মধ্যে অন্য কোনো ভালো গুণ আছে। সেটি খুঁজে বের করা উচিত।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্ত্রী সবচেয়ে বেশি কষ্ট পান যখন স্বামী তাঁর কোনো দুর্বল জায়গা নিয়ে অন্যের সামনে হাসেন। তাঁদের কাছে নিষ্ঠুর রসিকতা মনে হয় এসবকে। অনেক স্বামী আড্ডায় নিজেকে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে এমনটা করে থাকেন।
জীবনকে আনন্দময় করতে হলে এসব কৌতুকের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন অনেক স্বামী। এতে বউয়ের কষ্ট পাওয়ার কী আছে—মনে করেন তাঁরা। ব্যাঙ ও দুষ্টু ছেলের সেই গল্পের মতো হয়ে যাবে। আপনার জন্য যেটি রসিকতা, সেটি অন্যের দুঃখের কারণ।
এ বিষয়ে প্রথম আলোকে নারীনেত্রী সালমা খান বলেন, ‘বড় কর্মকর্তা হলেই রুচিসম্পন্ন মানুষ হবেন, তা তো নয়। কোনো না কোনোভাবে তাঁকে বোঝাতে হবে, এটি ঠিক নয়। এই উপলব্ধি যত দিন না হবে, তত দিন তাঁকে সংশোধন করা যাবে না। স্ত্রীকে ছোট করা মানে যে নিজে ছোট হয়ে যাওয়া, বুঝতে পারেন না তাঁরা।’
ব্যক্তির বেড়ে ওঠার পরিবেশের ওপর নির্ভর করে তাঁর আচরণ। বিশেষজ্ঞরা এমনটাই মনে করেন। তাই ছোটবেলা থেকে অন্যকে শ্রদ্ধা করা শেখাতে হবে। আবার সন্তানের সামনেও এমন আচরণ করা যাবে না, যা তাঁকে অসৌজন্যবোধসম্পন্ন মানুষ বানায়।
দাম্পত্য জীবনে শান্তি বজায় রাখতে এ ধরনের আচরণ এড়িয়ে চলা উচিত। জীবনে অবশ্যই রসিকতার প্রয়োজন আছে। করবেনও। স্বামী-স্ত্রীর অনেক মজার কোনো স্মৃতি, গল্প বলে তো হাসতেই পারেন। কিন্তু কাউকে কষ্ট দিয়ে বা ছোট করে নয়।