স্মৃতি

বগুড়ায় হুমায়ূন আহমেদের কৈশোর

হুমায়ূন আহমেদের এই দুই সহপাঠী বগুড়ার জিলা স্কুলে যেন আগের দিনে ফিরে গেলেন। ছবি: সোয়েল রানা
হুমায়ূন আহমেদের এই দুই সহপাঠী বগুড়ার জিলা স্কুলে যেন আগের দিনে ফিরে গেলেন। ছবি: সোয়েল রানা

‘১৯৬৩ সাল। হালকা-পাতলা, শ্যাম বর্ণের একটা ছেলে আমাদের ক্লাস নাইনে এসে নতুন ভর্তি হলো। নাম বলল হুমায়ূন। ওর সঙ্গে ক্লাসে নতুন এল আরও দুজন—আহসান হাবীব ও মাসুম। তিনজনের মধ্যে হুমায়ূন অন্য রকম। চুপচাপ স্বভাবের, কথা বলত কম। ক্লাসে সামনের বেঞ্চে বসত। মন দিয়ে স্যারদের কথা শুনত। ক্লাসের ফাঁকে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ত। গল্পের বইয়ের পোকা ছিল ও। এই ছেলেটার সঙ্গে দ্রুতই আমাদের সবার ভাব হয়ে যায়।’

এই ‘ছেলে’ হলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। আর যিনি তাঁর কথা আমাদের জানালেন, তিনি এ কে এম রাজিউল্লাহ, বগুড়া জিলা স্কুলে হুমায়ূন আহমেদের সহপাঠী। স্কুল প্রাঙ্গণে দেড় শ বছরের পুরোনো থমসন হলের সামনে দাঁড়িয়ে এ মাসেরই প্রথম দিকে কৈশোরের স্মৃতিচারণা করছিলেন হুমায়ূন আহমেদের এই সতীর্থ।

বগুড়া শহরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে হুমায়ূন আহমেদের ছোটবেলার নানা স্মৃতি। শহরের সাতমাথার অদূরে শেরপুর সড়কের সূত্রাপুরের একসময়ের ‘দারোগা বাড়ি’তে (বর্তমানে আলম হাউস) মা-বাবা, ভাইবোনদের সঙ্গে থেকেছেন কয়েক বছর। সে সময় বিকেল হলেই ছুটে যেতেন করতোয়া নদীপাড়ের মালতিনগর শ্মশানঘাটে। শৈশবের বন্ধু-সহপাঠীরা এখনো জিলা স্কুল, মালতিনগর শ্মশানঘাট কিংবা সূত্রাপুরের দারোগা বাড়িতে খুঁজে ফেরেন তাঁকে।

হুমায়ূন আহমেদের সতীর্থ ও সহপাঠীরা জানান, ১৯৬৩ সালে হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান বগুড়ায় পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। স্ত্রী আয়েশা ফয়েজ, ছেলে হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আহসান হাবীব, মেয়ে শেকু, শেফু ও মণিকে নিয়ে সূত্রাপুরে জেলা জজের বাসভবন-সংলগ্ন আধপাকা একটি বাড়িতে। ওই বছরই হুমায়ূন আহমেদ ও জাফর ইকবালকে তিনি ভর্তি করে দেন তিনি বগুড়া জিলা স্কুলে।

বাবাও ছিলেন একজন লেখক ও সাহিত্য সংগঠক। বগুড়ার লেখকদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘বগুড়া সাহিত্য আসর’।

রাজিউল্লাহ বলে চলেন, ‘খুবই মেধাবী ছিল হুমায়ূন। দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয় “সেকেন্ড বয়” হিসেবে। স্কুলের দেয়াল পত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখত সে।’ স্কুলজীবনে বিকেলে শ্মশানঘাটে যাওয়া নিয়ে মজার কথা শোনালেন এই সহপাঠী। ‘সেখানে বসে হুমায়ূন প্লানচেট করত। সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকত।’

হুমায়ূন আহমেদের ডাকনাম ছিল কাজল। এর বাইরে সহপাঠীরা তাঁকে মাঝেমধ্যে বাচ্চু বলেও ডাকতেন। আরেক সহপাঠী মাহমুদুল ইসলাম স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘ক্লাসে তখন আমরা ৩২ জন ছাত্র ছিলাম। ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে হুমায়ূন। এরপরই বগুড়া ছাড়েন হুমায়ূন আহমেদ।’

মাহমুদুল আলম বলেন, ‘ঢাকা কলেজে ভর্তির আগে সহপাঠী বুলবুল তার বাসায় সবাইকে দাওয়াত দেয়। সেখানে হুমায়ূনও আসে। খাওয়াদাওয়ার পর সে জাদু দেখায়। সেই থেকে তাকে আমরা “জাদুকর” বলতাম।’

জনপ্রিয় গানের দল বগুড়া ইয়ুথ কয়্যারের তৌফিকুল আলম টিপুও ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের সহপাঠী। তিনি বললেন, ‘আমরা ৮-১০ জন ডানপিটে স্বভাবের ছাত্র ছিলাম। খুব দুষ্টুমি করতাম। হুমায়ূন তখন নানা উপদেশ দিত। এতে আমরা ওর উপর খ্যাপা ছিলাম। স্বাস্থ্য কম ছিল বলে আমরা তাকে “শুঁটকা” বলেও খ্যাপাতাম। কেউ কেউ ওকে ঠাট্টা করে “পণ্ডিত” বলে ডাকতাম। ম্যাট্রিকে বোর্ডস্ট্যান্ড করার পর আমরা ওর কাছে খুব লজ্জা পেয়েছিলাম।’

শৈশবের স্মৃতির টানে ১৯৯৩ সালে বগুড়া জিলা স্কুলে হুমায়ূন আহমেদ ‘বইমেলা’ উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন, তেমনি কৈশোরের স্মৃতিঘেরা স্থানগুলো ঘুরে বেড়িয়েছেন। বগুড়া থিয়েটারের পরিবেশনায় নিজের লেখা ১৯৭১ নাটক দেখে কলাকুশলীদের প্রশংসা করেছিলেন তিনি। ২০০৩ সালের শেষের দিকে আরেকবার এসেছিলেন বগুড়ায়।

বগুড়া জিলা স্কুল, সূত্রাপুরসহ নানা জায়গায় আছে হুমায়ূনের স্মৃতি। তাই তাঁর সহপাঠীরা চান এসব স্মৃতি সংরক্ষণ করতে; যাতে হুমায়ূনের ভক্তরা প্রিয় লেখকের শৈশবের ছোঁয়া পেতে পারেন বগুড়া এলে।