
বন্ধুত্ব জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। একটা সময়ের পর জীবনকে যেন আমরা বুঝতেই শিখি বন্ধুর হাত ধরে। কিন্তু বন্ধুর সব সংকটে, সব বিপদেই কি আমরা নির্দ্বিধায় পাশে দাঁড়াতে পারি? এমনো তো দেখা যায়, বন্ধুর বিপদে গা বাঁচানোর জন্যই আমরা পিছুটান দিই। নিজের দোষের কারণে বন্ধু যখন কোনো ঝামেলায় জড়ায়, তখন কি মনে হয় না খামাখা এই ঝামেলায় নিজে না জড়ানোই ভালো!
খুবই নির্ভার আর স্বাধীন এ সম্পর্কে সেভাবে ‘কমিটমেন্ট’ শব্দটি উচ্চকিত না থাকলেও, ‘বন্ধু’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু তাদের কথাই মনে হয়, যারা ভালো ও খারাপ সময়ে শর্তহীনভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। তবে এ কথাও ঠিক, বন্ধুকে সাহায্য করার ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় আমরা বুঝে উঠতে পারি না, ঠিক কীভাবে তাকে সাহায্য করব। চাকরিচ্যুতি, সম্পর্কে সমস্যা বা বিচ্ছেদ, অসুস্থতা, পারিবারিক সমস্যা থেকে শুরু করে আইনগত জটিলতা, মামলা, অর্থসংক্রান্ত সমস্যায় ফেঁসে যাওয়া ইত্যাদি নানা জটিলতায় কিন্তু যে কেউ পড়তে পারে।
মনোযোগ দিয়ে বন্ধুর সমস্যার কথা শুনুন
যেকোনো ধরনের সমস্যা বা বিপদে পড়াই এক ধরনের মানসিক চাপ। এই চাপ কিছুটা হলেও কমানো যায় কারও কাছে মনের কথা নির্দ্বিধায় খুলে বললে। কাজেই বন্ধুকে সাহায্য করার প্রথম পদক্ষেপই হবে তার সমস্যার কথা বলতে দেওয়া এবং সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কোনো ব্যক্তি কিছু শোনার মতো অবস্থায় থাকে না বলে এ সময় কোনো ধরনের মন্তব্য বা বিষয়টার বিশ্লেষণ না করাই ভালো।
নিঃশর্ত ভালোবাসার হাত বাড়ান
এ সময়ে তার দৈনন্দিন কাজে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী যতটা পারেন সাহায্য করুন। যেমন বাচ্চাদের দেখাশোনা, বিল দেওয়া, ফাইল গুছিয়ে দেওয়া, আইনজীবীর খোঁজ দেওয়া ইত্যাদি।
বন্ধু যখন অন্যায় করেছে
গুজবে কান না দিয়ে বা অন্যের কাছ থেকে না শুনে, সরাসরি বন্ধুকে বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞাসা করুন। তার অবস্থান থেকে তাকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিন।
সবকিছু শোনার পর আগে নিজের কাছে পরিষ্কার হোন নৈতিক দিক থেকে বন্ধুর কাজটি সমর্থন না করলেও আপনি তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন কিনা। তার কাজের ফলাফলে ভবিষ্যতে যে ঝামেলা বা বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে, সেটার আঁচ আপনি বন্ধুর জন্য নিতে প্রস্তুত কিনা। সম্পূর্ণভাবে বিবেচনা করে সাহায্যের সিদ্ধান্ত নিলে আপনার বন্ধুত্বের হাতটি বাড়িয়ে দিন। আপনি এই বিপদে তার পাশে আছেন, এটা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তার এই কাজটির (?) ব্যাপারে আপনার নৈতিক অবস্থান কী তা-ও পরিষ্কারভাবে জানান। কোনোভাবেই বিষয়টা আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে এ বিষয়ে আপনার মতামত এবং অপারগতা স্পষ্ট করে তাঁকে বলুন।
আশ্বাস দিন আপনি তার পাশে আছেন
মুখে বলুন, আচরণে প্রকাশ করুন। তার সঙ্গে বেশি করে দেখা করুন, ফোনে তার খোঁজ নিন। বিপদের সময় বা যেকোনো খারাপ সময়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়, নিজেকে ছোট লাগে বা মনে হয় এ অবস্থা থেকে যেন মুক্তি নেই। এই খারাপ সময়টা যে একসময় আর থাকবে না, সে ব্যাপারে তাকে মুখে বলুন ও আশ্বস্ত করুন। আপনার এই আশ্বাস আর পাশে থাকা এ ধরনের নাজুক অবস্থা মোকাবিলা করতে বড় ধরনের শক্তি ও সাহস জোগাবে।
আবেগ প্রকাশ করতে সাহায্য করুন
যেকোনো বিপদে আমাদের মন নানা ধরনের যৌক্তিক-অযৌক্তিক আবেগ, যেমন রাগ, কষ্ট, ঘৃণা, অভিমান, ক্ষোভ ইত্যাদিতে আপ্লুত থাকি। এসব আবেগের ঠিক-বেঠিক বিচার না করে তার মন থেকে এসব প্রকাশ করতে সাহায্য করুন। তাকে কাঁদতে দিন, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, অভিমান তার মতো করে প্রকাশ করতে দিন।
বিচারকের ভূমিকা পালন করবেন না
কোনো ঘটনা শুনলে প্রথমেই আমরা ঠিক-বেঠিক বা নৈতিক-অনৈতিকতার বিচারে লেগে যাই। নানা রকম উপদেশমূলক কথা বলি, যা আসলে এক ধরনের বিরক্তি ঘটায়।
কাজেই এ সময় অহেতুক উপদেশ দেওয়া বা অতিরিক্ত বিচার-বিশ্লেষণ করা থেকে আপাতত নিজেকে বিরত থাকুন। বরং তার অবস্থানে গিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে জানতে চান আপনি কীভাবে তাকে সাহায্য করতে পারেন।
নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখুন
মনে রাখবেন, বন্ধুর পাশে দাঁড়ানো মানে এই নয় যে নীতিগতভাবে না মানলেও তার কোনো বিষয়ের সঙ্গে আপনার থাকতেই হবে। সাহায্য মানে এই নয় যে কারও বিরুদ্ধে বন্ধুর সঙ্গে প্রতিহিংসায় আপনি যোগ দেবেন। আপনি বন্ধুর জন্য ততটুকুই করবেন, যতটুকু আপনার মন সায় দেবে।
জীবনের নানা জটিলতার জট খুলতে, তার ভার লাঘব করতে সব সম্পর্ককে পেছনে ফেলে আমরা প্রথমেই ছুটে যাই বন্ধুর কাছেই। বলা হয়, বন্ধুত্ব আমাদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, যার প্রয়োজনীয়তা আর গুরুত্ব দৃশ্যমান হয়ে উঠে মূলত যেকোনো সংকটে। খুব বেশি আপনার নীতির বিরুদ্ধে না হলে বন্ধুর সেই সংকটে আপনার হাত বাড়িয়ে দিন। আপনারও হয়তো কোনো একসময় কোনো এক বন্ধুর হাতের প্রয়োজন হতে পারে।
ডা. মেখলা সরকার : মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি) জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা