একই স্কুলে পড়ত নয়ন আর নাঈম। ছেলেবেলা থেকেই তাদের বন্ধুত্ব। কলেজ শেষ করে তারা ভর্তি হয়েছে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুজনের পড়ার বিষয় আলাদা হলেও বন্ধুত্ব অটুট। নয়ন প্রায়ই নাঈমের বাসায় থাকে, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে। তাদের বন্ধুদের একটা দল আছে। কারোরই কোনো বদ-অভ্যাস নেই। কেউ নেশা করে না, সবাই ঠিকমতো পড়ালেখা করে। একসঙ্গে গানবাজনা করে, ঘুরতে যায়, আড্ডা দেয়। ইদানীং নাঈম দেখতে পাচ্ছে, তার বন্ধু নয়ন কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। একটু চুপচাপ, সব আড্ডায় আসছে না, সবাইকে কেমন যেন এড়িয়ে চলছে। পড়ালেখাতেও মন নেই। নাঈম বিষয়টি নিয়ে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করতেই তাদের ধারণা হলো, নয়ন বোধ হয় প্রেমে পড়েছে। কিন্তু না, সে রকম কিছু নয়। নয়ন কিছু একটা গোপন করে যাচ্ছে। কখনো দিন কয়েকের জন্য ফোন বন্ধ রেখে উধাও হয়ে যাচ্ছে। সবাই যখন নয়নকে নিয়ে চিন্তিত, তখন একদিন তারা পত্রিকায় দেখতে পেল, নয়ন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার!
এমনি করে বদলে যেতে পারে কাছের কোনো বন্ধু। পা বাড়াতে পারে ভ্রান্ত পথে। হাতে তুলে নিতে পারে মাদক। জড়িয়ে পড়তে পারে অপরাধের জগতে কিংবা সদস্য হয়ে যেতে পারে নিষিদ্ধ কোনো গোষ্ঠীর। পরিবারের পাশাপাশি কাছের বন্ধুরা একটু সজাগ থাকলে বিষয়গুলো আগে থেকে বুঝতে পারে। প্রয়োজনে বন্ধুকে সেই পথ থেকে ফিরিয়েও আনতে পারে। এ জন্য বন্ধুকে বুঝতে পারাটা খুব জরুরি। বন্ধু মানে কিন্তু একটা দায়িত্বশীলতা। তাই নেতিবাচক পথে বন্ধুর বদলে যাওয়া প্রতিরোধ করতে কিছু বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া দরকার। বন্ধুত্ব মানে খবরদারি নয় কিন্তু যদি তার বদলে যাওয়াটা খুব প্রকটভাবে দেখা দেয়, তখন তাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্বও বন্ধুর। আবার বন্ধু যদি কোনো কারণে টানা বিষণ্ন আচরণ করে, সেটা থেকে বেরিয়ে আনতেও সাহায্য করতে পারে অন্য বন্ধুরা। এ জন্য কিছু বিষয়ের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে:
কোনো কিছু গোপন করছে কি না
আপনার বন্ধু আপনার কাছ থেকে এমন কিছু গোপন করছে বা এমন কোনো মিথ্যা বলছে, যা আপনি সহজেই ধরে ফেলতে পারছেন।
টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন
হঠাৎ করে আপনার সাধারণ মধ্যবিত্ত বন্ধুর হাতে খুব বেশি টাকাপয়সা চলে আসছে, যা অস্বাভাবিক। এই টাকার উৎস সম্পর্কে তার কাছে উপযুক্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।
টাকা ধার চাওয়া
সে আপনার কাছে বা বন্ধুমহলে ইদানীং বেশি বেশি টাকা ধার চাচ্ছে কি না এবং ধার নেওয়া টাকা প্রায়ই ফেরত দিচ্ছে না।
কথায় অস্বাভাবিকতা
বন্ধুটির কথায় কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ করছেন কি না। হঠাৎ করে সে উগ্রবাদী, সাম্প্রদায়িক কথা বলা শুরু করেছে কি না এবং এসব নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়ছে কি না। বিতর্কিত বইয়ের সূত্র উল্লেখ করে সে তার পক্ষে সাফাই গাইছে কি না।
আচরণের অস্বাভাবিকতা
বন্ধুর আচরণে কোনো অস্বাভাবিকতা—যেমন কোনো কিছু আড়াল করার প্রবণতা, হঠাৎ উদ্ধত মনোভাব, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ইত্যাদি রয়েছে কি না।
হঠাৎ নিখোঁজ
আপনার বন্ধুটি আপনাদের বা বাড়িতে কাউকে না বলে দিন কয়েকের জন্য নিখোঁজ হচ্ছে কি না এবং তখন তার মুঠোফোন বন্ধ আছে কি না।
•
ঘুমের পরিবর্তন
সারা রাত জেগে থাকা আর সারা দিন ঘুমাচ্ছে কি না, চোখ লাল থাকছে কি না, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কি না।
•
মুঠোফোনের নম্বর পরিবর্তন
ঘন ঘন মুঠোফোনের নম্বর পরিবর্তন করছে। এক নম্বর বেশি দিন ব্যবহার করছে না।
নেশার উপকরণ বা বিতর্কিত বই
বন্ধুর ঘরে বা ব্যাগে নেশার কোনো উপকরণ যেমন সিগারেটের রাংতা, কলকে, অজানা-অচেনা ট্যাবলেট, সাদা কোনো পাউডারের গুঁড়া, বিতর্কিত বই, সন্দেহজনক পোশাক, ইউনিফর্ম এমনকি কোনো অস্ত্র আপনি দেখতে পেয়েছেন কি না।
অনৈতিক আচরণ
অনেক সময় আপনার বন্ধু—তা সে ছেলে কিংবা মেয়েই হোক, এমন কিছু আচরণ করছে যা দৃষ্টিকটু, উশৃঙ্খল, অনৈতিক এবং সমাজ-সংস্কৃতির পরিপন্থী।
বন্ধুত্বের পরিবর্তন
আগে যাদের সঙ্গে মিশত তাদের সঙ্গে মেশা বন্ধ করে রহস্যজনক নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিশছে কি না এবং এই নতুন বন্ধুদের কাউকে পরিবার বা আগের বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছে না। এমনকি আগে যদি কারও সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্কও থেকে থাকে, তবে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া তাতেও ভাঙন ধরেছে কি না।
শখের পরিবর্তন
আগে তার যে বিষয়গুলোতে আগ্রহ ছিল যেমন বই পড়া, গান শোনা, খেলা দেখা—সেগুলোতে সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কি না এবং এমন কোনো কিছুতে তার আগ্রহ তৈরি হয়েছে, যা বন্ধুরা বুঝতে পারছে না। ইন্টারনেটে ইদানীং সে কোন ধরনের সাইটগুলো বেশি দেখছে এবং সেগুলোর মধ্যে কোনো নিষিদ্ধ, অশ্লীল, বিতর্কিত বা উগ্রবাদী বক্তব্য থাকছে কি না, মাদক বা অস্ত্রশস্ত্র-বিষয়ক ওয়েবসাইটগুলো তার প্রিয় হয়ে উঠছে কি না।
•
পড়ালেখা বা কাজের মান কমে যাচ্ছে
তার পরীক্ষার ফল খারাপ হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে কাজের মান নেমে যাচ্ছে।
কোনো ভ্রান্ত বিষয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা
আপনার সদা হাস্যময় আড্ডাবাজ বন্ধুটি হঠাৎ করে আপনাকে খুব সিরিয়াস কোনো বিষয় নিয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে কি না এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে দায়ী করে সেই ভ্রান্ত বিষয়ে আপনাকে তার সঙ্গী হবার প্রস্তাব দিচ্ছে কি না।
কোনো মানসিক রোগের লক্ষণ
আপনার বন্ধুর মধ্যে বিষণ্নতা, কানে অদৃশ্য কারও কথা শোনা, একা একা কথা বলা, নিজেরÿক্ষতি করার প্রবণতা, আত্মহত্যার ইচ্ছা, মাদকাসক্তির লক্ষণ ইত্যাদি রয়েছে কি না, তা খেয়াল করতে হবে।
আপনার বন্ধুর মধ্যে যদি এ ধরনের কোনো বিষয় লক্ষ করে থাকেন, তবে সতর্ক হোন। আপনার বন্ধু নিজেও বিপদে পড়তে পারে এবং তার সূত্র ধরে বিপদে পড়তে পারেন আপনি, আপনারাও। ফলে প্রয়োজনে তার পরিবারের সদস্য এবং অন্য বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলুন।
অন্ধকারের পথ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনিও।
প্রতিরোধ-প্রতিকার কীভাবে
বন্ধু হতে পারে বিভ্রান্ত। হতে পারে বিপথগামী। মাদক, জঙ্গিবাদ, অপরাধজগতে জড়িয়ে পড়ে সে হারিয়ে যেতে পারে অন্ধকার জগতে। বন্ধু হিসেবে তাকে সঠিক পথে রাখার দায়িত্ব আরেক বন্ধুরই। এ জন্য প্রতিরোধ আর প্রতিকার দুই দিকেই জোর দিতে হবে। প্রতিরোধ আর প্রতিকার করতে হলে যা যা করতে পারেন:
বিচ্ছিন্নতা নয়
বন্ধুর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং বন্ধুত্ব করেই তাকে সুপথে আনতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে। বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে আপনি যদি তাকে বোঝাতে পারেন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাকে বিপথগামিতার হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব।
নিজের নিরাপত্তা
বন্ধুকে সাহায্য করবেন বটে, তবে নিজের নিরাপত্তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় বন্ধুর অপরাধের দায় নিতে হতে পারে আপনাকেও। তাই মুঠোফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইত্যাদিতে এই ঝুঁকিপূর্ণ বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ না করাই ভালো।
ইতিবাচক কাজে অংশগ্রহণ
বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে বন্ধুরা মিলে অংশ নিন। ইতিবাচক কাজ বেশি বেশি করা শুরু করুন, তাহলে বিভ্রান্ত আপনাদের স্পর্শ করার সুযোগ কম পাবে। মাদকের বিরুদ্ধে, অপরাধের বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বন্ধুরা সবাই মিলে আলোচনা করুন। তাতে যে বন্ধুর মনে এসব নিয়ে অস্পষ্টতা আছে, তা কেটে যাবে।
ব্যঙ্গ করবেন না
আপনার বন্ধুর কোনো বিষয় নিয়ে তাকে ব্যঙ্গ করবেন না, উত্ত্যক্ত করবেন না। তার দুর্বল দিক নিয়ে হাস্য পরিহাস করবেন না।
ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণ
বন্ধুর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণ দেখা গেলে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করুন। সবাই মিলে বন্ধুকে বোঝান। প্রয়োজনে বন্ধুর পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ত করুন। শিক্ষকদের সাহায্যও নিতে পারেন।
বিশেষজ্ঞ সেবা
যদি মনে করেন, বন্ধু কোনো ভুল বিশ্বাস নিয়ে চলছে, মাদক গ্রহণ করছে তবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে পারেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্য
যদি মনে করেন, আপনার বন্ধু কোনো অপরাধ বা নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, তবে প্রয়োজনে তার ভালোর জন্যই গোপনে আপনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিষয়টি জানাতে পারেন। এতে সাময়িক শাস্তি হলেও আপনার বন্ধুর জীবন রক্ষা পেতে পারে।
আহমেদ হেলাল : সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা