
জন্মের ঠিক পরপরই একটি শিশু মাকে চিনতে শুরু করে। জন্মের দুই মাসের মধ্যে সে শনাক্ত করতে পারে তার বাবাকে! মা ও বাবার কণ্ঠস্বর, চেহারা, এমনকি শরীরের গন্ধ শিশুর নিরাপত্তাবোধ তৈরি করে। একটি শিশুর জীবনে মায়ের পাশাপাশি বাবার সঙ্গে বন্ধন গড়ে ওঠাও খুব জরুরি। এই আত্মিক ও আবেপ্রবণ বন্ধন, যাকে বলা হয় অ্যাটাচমেন্ট, তা শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের অন্যতম অনুষঙ্গ। এই বন্ধন যত নিরাপদ হয়, শিশুর বেড়ে ওঠা তত পূর্ণ হয়।
অনেক সময় দেখা যায়, বাবা মনে করেন একটি ছোট শিশুর যত্নে তাঁর তেমন কিছু করার নেই, তিনি আর কী বোঝেন? যা করার মা করবেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যে শিশুটি জন্মের পরপরই বাবাকে চিনতে শুরু করেছে, তাই ছোটবেলা থেকেই তার সব বিষয়ে বাবার অংশগ্রহণ থাকা প্রয়োজন। অন্যথায় শিশুর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা রকম সমস্যা তৈরি হতে পারে। শিশুর সুস্থ ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার জন্য এবং ভবিষ্যতে শিশুর পারিবারিক ও সামাজিক জীবন স্বাভাবিক রাখতে ছোটবেলা থেকেই মায়ের পাশাপাশি বাবার সম্পৃক্ততা থাকতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে যে শিশুটি তার বাবার শরীরের স্পর্শ পায়, বাবার বুকের মধ্যে নিরাপত্তা পায়, সে শিশুটির সঙ্গে বাবার বন্ধন দৃঢ় হয়। শিশুর সঙ্গে এই বন্ধন দৃঢ় করার জন্য জন্মের পর থেকে পাঁচ-ছয় বছর পর্যন্ত শিশুর ক্ষেত্রে বাবা যা যা করতে পারেন—
জন্মের পরপরই শিশুর যত্নে অংশ নিন। তাকে পরিষ্কার করানো, কাপড় পাল্টানো থেকে শুরু করে ঘুম পাড়ানো পর্যন্ত—সবকিছুতে মায়ের পাশাপাশি সক্রিয় ভূমিকা রাখুন।
শিশু বুঝতে পারুক আর না-ই পারুক, জন্মের পর থেকেই তার সঙ্গে কথা বলুন, হাসুন, ছড়া বলুন, প্রয়োজনে শিশুকে গান গেয়ে শোনান—তাতে শিশু বাবার কণ্ঠস্বরকে শনাক্ত করতে শিখবে। পাশাপাশি শিশুর শ্রবণ সংবেদন ও যোগাযোগ কৌশল উন্নততর হবে।
শিশুকে স্পর্শ করুন। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরুন, হালকা করে তার শরীর মালিশ করে দিন; শিশু আপনার নিরাপদ স্পর্শকে অনুভব করতে শিখবে আর তার স্পর্শের প্রতি সংবেদনশীলতা বাড়তে থাকবে।
যখন সে একটু বড় হতে থাকবে, তখন তার নিজের করতে পারার মতো কাজগুলো (দাঁত মাজা, নিজের কাপড় নিজে পরা) করতে তাকে উৎসাহিত করুন, অতি যত্ন করতে গিয়ে তার সব কাজ কখনোই করে দেওয়া যাবে না। এতে সে পরনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে।
আপনার সন্তান ছেলে বা মেয়ে যা-ই হোক না কেন, বাবা হিসেবে আপনাকে সমান দায়িত্বই পালন করতে হবে। ‘মেয়েশিশুর দেখভাল কেবল মা করবেন’—এমন ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হয়ে আসুন। আপনার মেয়েসন্তানের সঙ্গেও বন্ধন দৃঢ় করুন।
শিশুকে ভয় দেখাবেন না বা তার সামনে ভীতিকর চরিত্র হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাবেন না। অনেক সময় দেখা যায়, মা বা পরিবারের অন্য সদস্যরা ‘ওই বাবা আসছে...তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও’ ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় শিশুর সামনে বাবার একটা ভীতিকর ইমেজ তৈরি করে। এমনটা যেন কখনোই না হয়।
বাইরে থেকে এসে চুপ করে ঘরে ঢুকে না গিয়ে আপনার শিশুর নাম ধরে ডাকুন, তার খোঁজ নিন। এতে তার আত্মমর্যাদাবোধ বাড়বে, আপনার সঙ্গে বন্ধন দৃঢ় হবে।
চেষ্টা করুন একনাগাড়ে অনেক দিন যেন শিশুর কাছ থেকে দূরে থাকতে না হয়।
খেলনা কিনে দেওয়া বা পছন্দের খাবার খাওয়ানোই কিন্তু বাবার দায়িত্ব নয়, শিশু চায় বাবার ভালোবাসা। সেটি দিতে হলে শিশুর সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে হবে, তার সঙ্গে কথা বলতে হবে, খেলতে হবে।
শিশু কাঁদলে বা বিরক্ত করলে সেটি সামলানোর দায়িত্ব বাবাকেও নিতে হবে। কেবল মায়ের প্রতি সেই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কখনোই বিরক্তিভাব প্রকাশ করা যাবে না। মনে রাখবেন, শিশু যেমন আপনার ভালোবাসা বুঝতে পারে, তেমনি আপনার বিরক্তিও বুঝতে পারে। সে যদি বুঝতে থাকে যে বাবা তার ওপর বিরক্ত হচ্ছে, তবে বাবার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হবে।
কখনো ধমক বা শারীরিক নির্যাতন নয়। এ ধরনের আচরণ শিশুর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি খারাপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
শিশুকে ব্যঙ্গ করবেন না, তাকে অন্যদের সামনে তুচ্ছ বা ছোট করবেন না।
আপনার সন্তানের যেকোনো অসুস্থতায় কোনো অবস্থাতেই তাকে দায়ী বা দোষারোপ করবেন না।
শিশুর পড়ালেখায় যতদূর সম্ভব অংশ নিন, অন্তত তার পড়ার বিষয়গুলো আপনার জানতে হবে।
আপনার সন্তানের কিছু পছন্দের বিষয় থাকতে পারে। যেমন: বই পড়া, বিশেষ খেলা ইত্যাদি। এগুলোকে উৎসাহিত করুন। শিশু যদি প্রবল উৎসাহ নিয়ে আপনাকে কিছু বলতে আসে বা দেখাতে আসে, তবে সেটি শোনার বা দেখার চেষ্টা করুন। তার আগ্রহকে দমিয়ে দেবেন না।
শিশুর যেকোনো পর্যায়ের সাফল্যকে প্রশংসা করতে শিখুন।
শিশুর সামনে তার মা বা পরিবারের কোনো সদস্য বা শিশুর পরিচিত কারও সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য কখনোই করবেন না, শিশুর কোনো সমস্যা নিয়ে মাকে দোষারোপ করবেন না।
শিশু যদি আপনাকে বিশ্বাস করে কোনো গোপন কথা বলে, তা যতই ক্ষুদ্র ও হাস্যকর হোক না কেন, কখনোই সেটি তার মা বা কারও কাছে প্রকাশ করে দেবেন না।
কখনো যদি মনে হয় শিশুর সঙ্গে আপনার একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে বা কোনো কারণে বন্ধনটি ঠিক জুতসই হচ্ছে না, তবে পরিবারের সদস্যরা মিলে তার কারণ জানতে চেষ্টা করুন। আর প্রয়োজন হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
লেখক: মনোবিদ