বাবা দিবস

বাবা সব সময় তাঁর হৃৎস্পন্দনের তালে নেচেছেন : মারিয়াম আলী

৩ জুন চলে গেছেন বক্সিং রিংয়ের কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলী। বিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়ানায়কও বলা হয় তাঁকে। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে মোহাম্মদ আলী বলতেন, ‘আমিই সেরা।’ বাবা হিসেবেও যে তিনি ‘সেরা’ ছিলেন, সে কথাই লিখেছিলেন তাঁর নয় সন্তানের মধ্যে সবার বড় মারিয়াম আলী। আজ বাবা দিবস উপলক্ষে ‘স্বপ্ন নিয়ে’র পাঠকের জন্য থাকল ২০১৪ সালে ইউ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সেই প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত অংশ।
তোয়ালে দিয়ে বাবার গা মুছে দিচ্ছে মেয়ে মারিয়াম
তোয়ালে দিয়ে বাবার গা মুছে দিচ্ছে মেয়ে মারিয়াম

কথা বলা, হাঁটা শেখার সময় থেকেই জেনেছি, আমার বাবা একজন বিখ্যাত মানুষ। বাড়ির পাশের দোকানে কেনাকাটা করতে গেলেও জনা পঞ্চাশেক ভক্তের ভিড়ে বাবাকে হারিয়ে ফেলতাম। আমার কাছে এটাই ছিল স্বাভাবিক। বাবা মানুষকে ভালোবাসতেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন, আনন্দ দিতেন।
আমি ছিলাম বাবা–অন্তঃপ্রাণ। বাবা যখন কোনো লড়াইয়ে যেতেন, আমি গোঁ ধরে বসতাম, ‘আমাকেও নিতে হবে।’ বেশির ভাগ সময়ই তিনি আমার কান্নার কাছে হার মানতেন! বাবা হিসেবে তিনি সত্যিই চমৎকার। আমরা তাঁর সঙ্গে পেনসিলভানিয়ার ডিয়ার লেকের বক্সিং ট্রেনিং সেন্টারে যেতে খুব পছন্দ করতাম। প্রশিক্ষণ শেষে আমি একটা তোয়ালে দিয়ে বাবার গা মুছে দিচ্ছি, এমন একটা ছবি আমার কাছে আছে।

মারিয়াম আলী

বাবা ছিলেন একজন কবি, প্রথম র্যাপারও বলতে পারেন! ‘প্রজাপতির মতো ভাসো, মৌমাছির মতো হুল ফোটাও’—এমন অনেক অদ্ভুত কথাই তিনি বলেছেন। কবিতা খুব ভালোবাসতেন। সনি লিস্টনকে (১৯৬৪ সালে যাকে হারিয়ে মোহাম্মদ আলী ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন) নিয়ে একবার ছন্দ মিলিয়ে বলেছিলেন, ‘হি উইল ফল ইন রাউন্ড এইট টু প্রুভ আই অ্যাম গ্রেট। অ্যান্ড ইফ হি ওয়ান্টস টু গো টু হেভেন, আই উইল গেট হিম ইন সেভেন...ইফ ইউ ওয়ান্ট টু লুজ ইওর মানি, দেন বেট অন সনি।’ কখনো মজা করে আমাদের বলতেন, ‘ডোন্ট বি আ ফুল, স্টে ইন স্কুল। ইফ ইউ ওয়ান্ট টু বি কুল।’
আয়নার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বাবা সব সময় চট করে নিজেকে একবার দেখে নেন। আমাকে বলেন, ‘আমি এখনো বেশ সুদর্শন। আমার কাছ থেকেই তুমি তোমার সৌন্দর্য পেয়েছ।’ প্রায়ই বলেন, ‘আমিই সেরা।’
বাবা চাননি, আমরা ধনীর দুলালি হয়ে বেড়ে উঠি। কিন্তু তিনি কখনো আমাদের টাকার পেছনে ছোটার শিক্ষা দেননি। বলেননি আইনজীবী বা অন্য কিছু হও। বরং বলেছিলেন, ‘যদি প্রতিটি মানুষের জন্মেরই কোনো-না-কোনো উদ্দেশ্য থাকে, তোমার কী মনে হয়, তুমি কী উদ্দেশ্য নিয়ে জন্মেছ?’ আমি বলেছিলাম, ‘মানুষের কল্যাণ করা, তাঁদের সহযোগিতা করাই আমার কাজ।’ এখন লস অ্যাঞ্জেলসে আমি একজন সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করছি।

বাবা সব সময় বলেন, আমার জন্মের সময়টা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। আমি তাঁর সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়, ব্যাপারটা তা নয়। কারণটা হলো, আমি তাঁর প্রথম সন্তান। একটা মানুষের জন্মের বিস্ময়কর আনন্দটা তিনি আমাকে দিয়েই প্রথম বুঝেছেন (১৯৬৮ সালে)। আমার জন্মটা সম্ভবত তাঁর জীবনে একটা অন্ধকার সময়ে আলো হয়ে এসেছিল। তখন তিনি বক্সিং থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন। কারণ, ধর্মীয় চেতনা থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিতে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

ছোটবেলায় মারিয়াম আলী ছিলেন বাবা–অন্তঃপ্রাণ। ছবি: সংগৃহীত

সৌভাগ্যক্রমে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে ১৯৭১ সালে তিনি আবার বক্সিং রিংয়ে ফিরেছেন। বড় হয়ে আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছি, ‘আমেরিকান সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি তুমি কোথায় পেয়েছিলে?’ তিনি বলেছেন, ‘খোদা আমাকে আমার বক্সিং দিয়ে বিচার করবেন না। ইসলামের প্রতি আমার বিশ্বাস বলে, “যুদ্ধে যেয়ো না। কারণ যুদ্ধটা শুধুই যুদ্ধ নয়।” আমি বিলাসবহুল বাড়িতে থাকতে পারি। খ্যাতিমান, ধনবান লোকের সঙ্গে চলাফেরা করতে পারি। কিন্তু আমার সম্প্রদায়ের লোক যদি স্বাধীনতা না পায়—এসবের কোনো মূল্য নেই। টাকা নিয়ে যাও। আমার হেভিওয়েট খেতাব নিয়ে যাও। মানুষের যদি ধর্ম পালনের স্বাধীনতা না থাকে, তাহলে এসব দিয়ে কী হবে?’
শিকাগো অথবা লস অ্যাঞ্জেলসে বাবার হাত ধরে মসজিদে যাওয়া আমার জীবনের সেরা স্মৃতি। আমরা নামাজ পড়তাম। তিনি আমাকে জীবন এবং মননের কথা বলতেন। এখনো সকালে ঘুম ভাঙলে আমার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। তিনি বলতেন, ‘খাওয়ার আগে খোদার কাছে প্রার্থনা করো। শরীর ঠিক রাখতে যেমন নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হয়, তেমনি খোদার কাছে সব সময় প্রার্থনা করাও প্রয়োজন।’
একবার আমি বাবাকে বলেছিলাম, ‘বাবা, তুমি বুড়ো হয়ে গেছ। আর বক্সিং কোরো না।’ ছোটরা ভীষণ রকমের সৎ হয়। আমি বলেছিলাম, ‘তুমি ব্যথা পাবে’ (তাঁর বয়স তখন ৩৭ বছর)। শুনে তিনি হেসেছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, আমি বোধ হয় তাঁকে একটু কষ্ট দিয়ে ফেললাম। সে সময় তাঁর স্ত্রীও (ভেরোনিকা) চাননি তিনি বক্সিং করেন। আমরা ঠিক ছিলাম। তিনি সত্যিই খুব ব্যথা পেয়েছিলেন। তাঁর শরীর তাঁর বিরুদ্ধে যাচ্ছিল কিন্তু তিনি সেটা মানতে রাজি ছিলেন না। স্যাটেলাইট টিভিতে আমরা তাঁকে ল্যারি হোমসের সঙ্গে লড়তে দেখেছিলাম। সে রাতে প্রচণ্ড শোক আমাদের ঘিরে ধরেছিল। পরদিন স্কুলে দেখি, পুরো স্কুলে পিনপতন নীরবতা। কারণ, বাবা হেরে গেছেন। বাবার হেরে যাওয়ায় আমি একটুও কষ্ট পাইনি। আমি কষ্ট পেয়েছিলাম বাবা ব্যথা পেয়েছিলেন বলে।
আমার মনে হয়, ১৯৭৪ সালেই তাঁর অবসর নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু অন্যান্য মুষ্টিযোদ্ধার মতো তিনিও জানতেন না, কখন তাঁর অবসর নেওয়া উচিত। আমার আফসোস নেই, বাবারও ছিল না। আমার বাবা এমন একজন মানুষ, যিনি সব সময় তাঁর হৃৎস্পন্দনের তালে নেচেছেন। তাঁর সিদ্ধান্ত সব সময় তিনি নিজেই নিয়েছেন।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ