বিচ্ছেদের পরেও

বিয়েবিচ্ছেদ। অতএব সম্পর্ক শেষ। আধুনিক এ যুগে শেষ হয়ে যাওয়া সম্পর্কেও থেকে যায় রেশ। যদি থাকে সন্তান তবে তাকে ঘিরেই নতুন সম্পর্ক...

সপ্তাহের দিন ধরে মা–বাবার কাছে ভাগাভাগি করে থাকা। বাবা দিয়ে গেলেন মায়ের কাছে। মডেল হয়েছেন রাসেল, জিনিয়া ও ফাইরু। ছবি: সুমন ইউসুফ
সপ্তাহের দিন ধরে মা–বাবার কাছে ভাগাভাগি করে থাকা। বাবা দিয়ে গেলেন মায়ের কাছে। মডেল হয়েছেন রাসেল, জিনিয়া ও ফাইরু। ছবি: সুমন ইউসুফ

আমি তোমাকে তালাক দিলাম।
এক তালাক (স্ত্রী কানে হাতচাপা দিয়ে সশব্দে বলছেন ‘না’)।
দুই তালাক। স্ত্রী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছেন, আমাকে এমন শাস্তি তুমি দিয়ো না।
তিন তালাক। স্ত্রী পুরোই ভেঙে পড়েছেন। হয়তো স্বামীর পা জড়িয়ে ধরছেন। পর্দায় বিদ্যুতের চমক আর বজ্রপাতের শব্দ। স্বামী স্ত্রীকে পায়ে ঠেলে বেরিয়ে যাবেন, আর স্ত্রী কাঁদতে থাকবেন। সন্তান থাকলে তাকে জড়িয়ে ধরে এক কাপড়ে স্বামীর ঘর ত্যাগ করবেন।
বাংলা চলচ্চিত্রে এমন দৃশ্য আমরা অনেকেই দেখেছি। আবার এও দেখেছি এই স্ত্রীই তার সন্তানকে নিয়ে ভয়াবহ কষ্টের মধ্য দিয়ে নিজের জীবনে, সন্তানের জীবনে উন্নতি এনেছেন। স্বামীকে দূর থেকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা আলাদাভাবে ভালোই আছেন।

প্রয়োজনের কারণে এখন বিচ্ছেদের পর যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে যায় না

এও অনেকের জানা, এভাবে মৌখিক এক, দুই, তিন তালাকে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ আইনসিদ্ধ হয় না। তালাক বা ডিভোর্সের যে প্রক্রিয়া আছে, সেটা ধরেই বিচ্ছেদ ঘটাতে হয়।
যে কোনো কারণেই হোক একবার তালাক হলে, আগে দেখা যেত সাবেক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মুখ দেখাদেখি তো বন্ধই, সব রকমের যোগাযোগও ‘কাট-আপ’।
সময় পাল্টেছে। ধরা যাক, সাদিয়া ও আরমানের (ছদ্মনাম) কথা। তাঁরা প্রথমে ছিলেন সহপাঠী, তারপর মন দেওয়া-নেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে কর্মজীবনে ঢুকতেই দুজনে বিয়ে করে ফেললেন। বছর খানেক ভালোই কাটল, তারপর মনোমালিন্য, কথা-কাটাকাটি—চূড়ান্ত পরিণতি বিচ্ছেদ। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সব চেষ্টাই বৃথা গেল। বিচ্ছেদের পরে আবার দুজনকে একসঙ্গে দেখা গেল। ঘটনা কী? সাদিয়ার উত্তর, ‘আমরা আর স্বামী-স্ত্রী নেই, তবে এখনো আমরা খুব ভালো বন্ধু।’ আজকাল এমন দেখা যায়।
আবার প্রতি শুক্রবারই সৌরভকে (ছদ্মনাম) দেখা যায় ভালো কাপড়চোপড় পরে একগাদা চকলেট কিনে গাড়ি নিয়ে বেরোতে। তিনি যাচ্ছেন তাঁর ছয় বছরের মেয়েকে দেখতে। তালাকের পর মেয়ে থাকে তার মায়ের কাছে। শর্ত অনুযায়ী সপ্তাহে এক দিন বাবা মেয়েকে দেখতে পান বা মেয়েকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারেন। রাতে বা শনিবার সকালে মেয়েকে আবার তার মায়ের কাছে রেখে আসতে হবে। মেয়েকে আনা-নেওয়ার সময় সাবেক স্ত্রীর সঙ্গেও দেখা হয়। টুকটাক কথাও হয়, কিন্তু সেগুলো প্রয়োজনীয় বা খরচাপাতি দেওয়া বিষয়ে।
তালাকের পর আবার বিয়ে করেছেন নাফিস আহমেদ (ছদ্মনাম)। সাবেক স্ত্রী শুক্লাও ঘর বেঁধেছেন নতুন করে। একই শহরে থাকেন। পরস্পরের বন্ধুবৃত্তটা এক। কোনো দাওয়াত বা অনুষ্ঠানে দেখা হওয়াটা তাই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এতই তিক্ততার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়েছে তাঁদের যে হঠাৎ কোথাও দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে নেন দুজনেই। পুরো ইউটার্ন। নাফিস কোনো পরিচিত মহলে আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ পেলে আগেই খোঁজ নেন, শুক্লা আসবে কি না! আবার শুক্লার ক্ষেত্রে তাঁর বর্তমান স্বামী খোঁজ নেন নাফিস আসবে কি না। সেও আমন্ত্রিত হলে ওই অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ।
সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন বললেন, ‘আগে বিচ্ছেদের পর সাবেক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগ গ্রহণযোগ্য ছিল না। সমাজ বদলাচ্ছে। আমরাও মিশ্রসমাজে বাস করছি। তাই এখন যোগাযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে যায় না। আবার দুই পরিবার বা দুজনের বন্ধুদের মধ্যে যোগাযোগটা দেখা যায়।’ বিশ্বায়নের কারণে এমন পরিবর্তন। সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে মাহবুবা নাসরীন মনে করেন, যোগাযোগটা যদি সন্তানের কারণে হয় তবে তা গ্রহণযোগ্য। এতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ‘এ যোগাযোগ প্রয়োজন বা বাস্তব চাহিদার মধ্যে থাকাটা ভালো। কোনো আবেগি সম্পর্ক নতুন করে তৈরি হলে সমস্যা হতে পারে।’ বললেন মাহবুবা নাসরীন। বিচ্ছেদের পর দুজনর মধ্যে যোগাযোগ শহুরে জীবনে দেখা গেলেও বাইরে অনমনীয় অবস্থাটা এখনো রয়েছে। তিনি বললেন, ‘সাবেক সঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার বেলায় নতুন সঙ্গীর প্রতি আস্থার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। আস্থা ঠিক থাকলে ওই যোগাযোগ কোনো সংকট তৈরি করে না।’
‘একই সামাজিক বৃত্তে থাকলে বিচ্ছেদের পরও দুজনের যোগাযোগ দেখা যায়। এমনকি দুজনই যদি আবার নতুন করে সংসার শুরু করেন বা সম্পর্কে জড়ান, তখনো যোগাযোগটা থাকতে পারে। যে তিক্ততায় বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হালকাও হয়ে আসতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে আইন মেনে পুনর্বিবাহের ঘটনাও দেখা যায়।’ বললেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাহিদ মাহতাব।
মুসলিম আইন অনুযায়ী তালাকের ক্ষেত্রে স্ত্রীর পাওনা দেনমোহরের পুরো টাকাই পরিশোধ করতে হয় স্বামীকে। তালাক প্রক্রিয়ার সময়কালে (তিন মাস) স্ত্রীর ভরণপোষণের খরচটাও দিয়ে দিতে হয়। এগুলো কখনো স্বাভাবিকভাবে ঘটে, আবার কখনো আদালত পর্যন্ত গড়ায়। জানালেন নাহিদ মাহতাব।
বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর সন্তান কার কাছে থাকবে—এ প্রশ্ন সামনে চলে আসে। আইন বলে, ছেলে হলে সাত বছর আর মেয়ে হলে বয়ঃসন্ধির বয়স (১১-১২ বছর) পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকে। তবে নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট দিন পর পর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাবা সন্তানকে দেখতে পারবেন বা কাছে এনে রাখতে পারবেন। মা দ্বিতীয় বিয়ে করলে অবশ্য সন্তানকে কাছে রাখার অধিকার হারাবেন।
পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে নাহিদ মাহতাব বললেন, ‘অনেক সময় আদালত সন্তানের কল্যাণ দেখেন। কার কাছে থাকলে সন্তানের কল্যাণ হবে, সেটা বিবেচনায় নেন আদালত। আসলে একেক ক্ষেত্রে একেক ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। কখনো সমঝোতায় সব হয়ে যায়, কখনো আবার আদালত পর্যন্ত যেতে হয়। আদালত কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্তানের মতামতও নেন।’
বিচ্ছেদের পর পুনর্বিবাহ নিয়ে নাহিদ মাহতাব জানালেন, আগে প্রচলন ছিল তালাকের পর আবার বিয়ে করতে হলে মাঝখানে একটা বিয়ে (হিল্লা বা অন্তর্বর্তীকালীন বিয়ে) করতে হবে। কিন্তু ১৯৬১ সালের আইনে এ প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছে। তালাক হলে একই স্বামী-স্ত্রী সর্বোচ্চ তিনবার বিয়ে (পুনর্বিবাহ বা রিম্যারি) করতে পারবেন।
জীবনের চলমান প্রবাহে যেমন ভালোবাসার সম্পর্ক থেকে তীব্র তিক্ততায় বিচ্ছেদ ঘটে, আবার সন্তান বা অন্য কারণে সেই তিক্ততাও কমে আসতে পারে। তখন সাবেক দম্পতির যোগাযোগটা হতেই পারে। স্বাভাবিক কথাবার্তাও চলতে পারে। এটা সহজাত। মানুষের জীবন তো, তার গতিপথ বাঁক নিতেই পারে।