
বিয়েতে কনের বয়স একই সঙ্গে ১৮ ও ১৬ বছর থাকবে কি না, সে ব্যাপারে পাঠকের মতামত চাওয়া হয়েছে। বিপুলসংখ্যক পাঠক প্রথম আলোর অধুনার ঠিকানায়, ই-মেইলে ও ফেসবুক ফ্যান পেজে নিজেদের মতামত পাঠিয়েছেন। সেসব থেকে বাছাই করে কয়েকটি মতামত আজ প্রকাশিত হলো।
বিয়ের বয়স ১৮ ও ১৬!
উপমা মাহবুব
মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছরের পাশাপাশি ১৬ করার সরকারি প্রস্তাব এবং এর পক্ষে দেখানো যুক্তি কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর চেয়েও চিন্তার বিষয় হলো এ সিদ্ধান্ত মধ্যযুগীয় চিন্তাচেতনা ধারণ করা কিছু মানুষকে তাদের নানি-দাদির ১০-১১ বছর বয়সে বিয়ে হওয়া ও অসংখ্য ছেলেমেয়ে জন্ম দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে অকারণ তর্ক করার সুযোগ দিয়েছে। যারা ১৬ বছর বয়সে নারীর শরীর বিয়ের উপযুক্ত হয় বিধায় এ বয়সে বিয়ে দেওয়ার পক্ষে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য করছেন, তাঁরা কি চলার পথে ফুটপাতে বাস করা রুগ্ণ কিশোরী মা আর তাঁর চেয়েও রুগ্ণ শিশুদের দেখেন না? প্রতিদিন দেশে যৌতুকের দাবিতে অসংখ্য নারী নিগৃহীত হচ্ছেন। এ দেশে ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হওয়া নারীদেরই নিজের পায়ে দাঁড়াতে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়। ১৬ বছরের একটি মেয়ে যদি বিয়ের পর নির্যাতনের শিকার হয়, যদি অল্প বয়সেই তার স্বামী মারা যান, যদি তার সম্পর্কছেদ হয়—তাহলে তার পুরো জীবন একটা ভয়াবহ অনিশ্চয়তার চাদরে ঢেকে যাবে। কেউ কেউ আবার এত স্বাধীনতায় বিশ্বাসী যে বিয়ের বয়সই উঠিয়ে দিতে চাইছেন। বাংলাদেশে বর্তমানে ১৪-১৫ বছরের মেয়েদের ১৮ বছর বয়স দেখিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা শহরের বাসাবাড়িতে কাজ করা গৃহকর্মীদের বড় অংশই অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া, স্বামী পরিত্যক্তা এবং সন্তানের মা। অন্যদিকে স্বামীরা ইচ্ছামতো পুনরায় বিয়ে করছেন। এ বিধান কার্যকর হলে আরও কম বয়সী মেয়েদের ১৬ বছর বয়স দেখিয়ে বিয়ে দেওয়া হবে। এ রকম একটা অবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতার উদাহরণ টেনে বিয়ের বয়স উঠিয়ে দিতে যাঁরা চান, তাঁদের উদ্দেশ্য আসলে নারীকে স্বাধীনতা দেওয়া নয়, তাকে আরও অল্প বয়স থেকে বেশি মাত্রায় ভোগ করা! ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশে ১৬ বছরে মা-বাবা বা আদালত চাইলে বিয়ে করতে পারার বিধানকে যাঁরা উদাহরণ হিসেবে টানছেন, তাঁরা কী জানেন না যে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিকসহ ক্ষমতায়নের সব দিক দিয়েই ওসব দেশের কিশোরী মেয়েরা বাংলাদেশের মেয়েদের চেয়ে অনেক এগিয়ে?
অপ্রাপ্ত বয়স্ক একটা মেয়েকে ভোলানো যে কত সহজ, পাশ্চাত্য দেশগুলোই তো এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ স্থাপন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া থেকে যে কজন মেয়ে আইএসআই জঙ্গিদের বিয়ে করে জিহাদ করার স্বপ্ন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমিয়েছে, তাদের সবার বয়স ১৬ থেকে ১৯-এর মধ্যে। যতই ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশার সুযোগ থাকুক না কেন, একটি কিশোরী মেয়ের গর্ভধারণ করাকে পশ্চিমা দেশেও সমর্থন করা হয় না।
সমগ্র বিশ্বব্যাপী সর্বজনীনভাবে নারীর বিয়ের বয়স ১৮ বছর নির্ধারণ করার পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে, রয়েছে অসংখ্য গবেষণা। এটাকে যাঁরা প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, তাঁরা আসলে সারা বিশ্বের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিচ্ছেন। বাংলাদেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে আসতে শুরু করেছেন। এ রকম একটি সময়ে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর পক্ষে যে খোঁড়া যুক্তি বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে নামে-বেনামে তুলে ধরা হচ্ছে, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এখনো অনেক তথাকথিত আধুনিক মানুষ সন্তান উৎপাদন ও সাংসারিক দায়িত্ব পালনকেই নারীর একমাত্র দায়িত্ব বলে মনে করেন। মন্তব্যগুলোর ধরন থেকে বোঝা যায় যে এদের বড় অংশই তরুণ। তাঁরা সামাজিক মাধ্যমগুলো নিয়মিত ব্যবহার করেন। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ আইনটি টিকে গেলে এই অল্পসংখ্যক মধ্যযুগীয় মানসিকতার মানুষেরা আরও কথা বলবেন, আরও খোঁড়া যুক্তি স্থাপন করবেন। নারীর ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে উসকানি দেবেন। নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রযাত্রায় যার প্রভাব হবে মারাত্মক নেতিবাচক।
উন্নয়নকর্মী
এটা কোনো বিয়ে হতে পারে না
কিশোর কুমার
এই আইন আমাদের সমাজের মেয়েদের আরও বিপদের মুখে ফেলে দেবে। ১৮ বছরেই মেয়েদের বিয়ে দিলে নানা জটিলতা তৈরি হয়, সেখানে ১৬ বছরে তো আরও ঝুঁকি। আমি মনে করি, মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়িয়ে ২০ বা তার বেশি করা হোক। একটা ১৬ বছরের মেয়ে বিয়ের কীই-বা বোঝে। এটা কোনো বিয়ে হতে পারে না, এটা ধর্ষণ। আমরা বহু বছর আগের কথা শুনেছি, সেখানে মেয়েদের ১০-১২ বছর বা তার কম বয়সে বিয়ে হতো। এই আইন কি তাহলে এই আধুনিক যুগেও আমাদের মেয়েদের সেই যুগে নিয়ে যাচ্ছে না? ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, এই আইনে কি তাহলে একটি শিশুর বিয়ের কথা বলা হলো না!
শরণখোলা, বাগেরহাট।
আইন হতে হবে নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট
ফতেহ আখতার
‘কন্যার বিয়ের বয়স ১৬ ও ১৮’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ১১ মার্চ প্রকাশিত তিনজন বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন। একজন আইন বিশেষজ্ঞ ও একজন চিকিৎসক যে মত দিয়েছেন, তার সঙ্গে একমত। আইনের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো আইনকে হতে হবে নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট। একই বিষয়ে একই সঙ্গে দুটি বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না। বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ বাবা-মা যত শিগগির পারেন মেয়েকে পাত্রস্থ করতে চান। আলোচকেরা বলেছেন, পিতামাতা সচেতন নন। আমি বলব, এই বয়সে কন্যা নিজেও মানসিক বা শারীরিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠে না। কাজেই ১৬ বছর বয়স বিয়ের জন্য কোনোভাবেই সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না। ন্যূনতম ১৮ বছর থাকতে পারে।
কুষ্টিয়া
মানুষের স্বার্থে মতামত নেওয়া প্রয়োজন
কায়সার আহমেদ
১৬ বছরে বিয়ে নয়, নির্যাতিত হওয়া একই কথা। বাবা-মা হওয়ার জন্য চাই পরিণত বয়স। আমি একজন এনজিও কর্মী। প্রতিনিয়ত গ্রামে-গঞ্জে যাই অল্প বয়সে বিয়ের কারণে, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এবং রোগাক্রান্ত ছেলেমেয়ের জন্ম হচ্ছে।আইন করার আগে সাধারণ মানুষের স্বার্থে সবার মতামত নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
দেবীদ্বার, কুমিল্লা
আপনার মেয়েটিই একদিন যোগ্য হয়ে উঠবে
রোমেনা বেগম
১৮ বছর বয়সের আগে কারও কারও বিয়ে হলে আর যা হোক, সে বিচারবুদ্ধি ও বিবেচনাবোধসম্পন্ন হবে না। যেখানে ১৮ বছর না হলে কেউ ভোটাধিকার পাচ্ছে না। যেখানে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ, দেশের শিশু আইনসহ সব জায়গাতেই শিশুর বয়স ১৮ বছর পর্যন্ত। এতএব, ১৬ বছর বয়স মানেই নির্দ্বিধায় আমরা বলতে পারি, সেটা শিশু বয়স। তাহলে ১৬ বছর বয়সে একটি মেয়ের যখন বিয়ে হবে, স্বভাবতই যেকোনো সময় সে মা হতে পারে এবং সেটা ১৮ বছরের আগেই। ১৬ বছর বয়সের একটি মেয়ে সে নিজেই শিশু, সে কীভাবে আরেকটা শিশুর জন্ম দিতে পারে? কীভাবে সে মাতৃত্বের মতো একটি গুরুদায়িত্ব তার ছোট্ট শরীরে বহন করতে পারে? আর বাবা-মাকেই বা কেন আমরা এমন অমানবিক কাজটি করতে আইন তৈরি করে উৎসাহিত করব? তার উল্টোটা কি হতে পারে না? যেমন আমার এ ছাত্রীর মা চার-পাঁচ বছর আগে মেয়ে এইচএসসি পাস করার সঙ্গে সঙ্গেই ভালো ছেলে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে, সেই ভয়ে মেয়েকে জোর করেই বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। তখন আমি একটু শক্ত ভূমিকাই নিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম, ‘আপনার মেয়েই একদিন সেই যোগ্যতাসম্পন্ন ছেলের পর্যায়ের হতে পারে। ওকে আপনি পড়াশোনার সুযোগ দিন।’ উনি হয়তো সেদিন মনে কষ্ট পেলেও রাজি হয়েছিলেন। আজ সেই মেয়েটিই নামকরা একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফল নিয়ে পাস করে বেরিয়েছে। সে বিসিএস পরীক্ষার জন্য জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের উচিত অসচেতন বাবা-মায়ের চেতনা ফিরিয়ে আনা; মেয়েদের শিশু বয়সে বিয়ে দিতে উৎসাহিত করা নয়।
ভৈরব এমপি পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ।