
ক্যালেন্ডারে ৩ জুন তারিখটা যেন আসছিলই না! দিনটার জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম বহু আগে থেকেই। আমরা মানে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মিলিয়ে আমাদের মোট ২১ জনের দল। আধুনিক বিশ্বের সিনেমা নির্মাণের কারিগরি দিকগুলো শেখাতে প্রতিবছর আমাদের জন্য দেশে-বিদেশে সরকারি খরচে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা বর্তমান ব্যাচের শিক্ষার্থীরা গিয়েছিলাম ভারতে। হায়দরাবাদ ও কলকাতা ঘুরে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ‘সিনেমায় শব্দের ব্যবহার’ সম্পর্কে জানা।
শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগেরই এটাই প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। তাই রোমাঞ্চের কমতি ছিল না। ৩ জুন আমরা রওনা হই কলকাতার পথে। সেখানে একদিন বিরতি নিয়ে আমাদের গন্তব্য ছিল হায়দরাবাদ। ৪ তারিখ রাত নয়টায় ছিল আমাদের ফ্লাইট। ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট রাতের আকাশে উড়ে আমরা পৌঁছালাম হায়দরাবাদে। নতুন শহর নতুন মানুষ। বিমানবন্দরে আমাদের জন্য বাস অপেক্ষা করছিল। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে প্রায় একঘণ্টা পর আমরা যখন রামুজি ফিল্মসিটিতে পা রাখি, তখন অনেক রাত। ।
পরদিন খুব সকাল থেকেই শুরু হয় আমাদের পাঁচ দিনের কর্মশালা। প্রথম দিন থেকেই সময় কেটেছে ভীষণ ব্যস্ততায়। শুরুতেই আমাদের একটি চিত্রনাট্য দেওয়া হলো। বলা হলো, এর ওপর ভিত্তি করে একটি নয় মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি বানাতে। অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলী—সবাই শিক্ষার্থী। শুটিংয়ের জন্য আমরা নিজেদের মধ্যে ভাগ হয়ে যে যার দায়িত্ব বুঝে নিয়েছিলাম।
আমাদের মধ্যে একদল চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করতে থাকে। আরেক দল লোকেশন ঠিক করা ও শট ডিভিশনের দায়িত্ব নেয়। এ ছাড়া সাউন্ড ডিজাইনের জন্যও একটা দল ঠিক করা ছিল। পরদিনই রামুজির বিভিন্ন জায়গায় শুটিং হবে। ভীষণ রোমাঞ্চ নিয়ে শট ডিভিশন, স্টোরি বোর্ড, প্রপস, কস্টিউম...এসব তৈরি করতেই আমাদের অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল।
পরদিন সকাল নয়টায় আমাদের শুটিং শুরু হয়। শুটিংয়ের পুরো পর্বটাই ছিল বড় এক চ্যালেঞ্জ। কারণ, আমাদের প্রশিক্ষকেরা ছিলেন শতভাগ পেশাদার। তাই একটা বাড়তি চাপও টের পাচ্ছিলাম। অনেক ক্ষেত্রে একটি শট আমাদের ১৫ বারও নিতে হয়েছে। পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার একটি দৃশ্য বারবার ধারণ করতে করতে এক অভিনেতা তো অসুস্থই হয়ে পড়ল! এমন নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়েছে। ভুলভ্রান্তি হলেও নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম।
পরদিন রামুজি ফিল্মসিটির সিম্ফনি সাউন্ড স্টুডিও ঘুরে দেখার সুযোগ হলো। মজার বিষয় হলো, প্রতিটি স্টুডিও অন্যটি থেকে ভিন্ন এবং এর ব্যবহারও আলাদা। শেষের দুদিন ভারতের বিখ্যাত সংগীত পরিচালক অনুপ মুখার্জি ছিলেন প্রশিক্ষক হিসেবে। শব্দের নান্দনিক ব্যবহারের ওপর দিনব্যাপী কর্মশালার পুরোটাই তিনি পরিচালনা করেন।
কলকাতায় শিক্ষাসফর তখনো বাকি। পরদিন সকালে আবার আকাশপথে কলকাতা ফিরে আসি। এবার আমাদের গন্তব্য ছিল রবিঠাকুরের শান্তিনিকেতন। কলকাতা শহর থেকে শান্তিনিকেতনের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। ওখানকার চারিদিক যেন রবীন্দ্রনাথের কাব্যের মতোই। সেখানে রবিঠাকুরের একটি জাদুঘরও আছে। শান্তিনিকেতন থেকে শান্তির বার্তা নিয়ে আমরা ফিরি কলকাতা শহরে। পরদিন কলকাতায় একটি কালার গ্রেডিং স্টুডিও ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে পড়ার সুবাদেই দারুণ এই অভিজ্ঞতাটি হলো। আমাদের এখানে দুই বছর মেয়াদে বিশ্ব চলচিত্রের ইতিহাস, চলচিত্রের ইতিহাস: উপমহাদেশ ও বাংলাদেশর চলচ্চিত্র, চিত্রগ্রহণ, চলচিত্র সম্পাদনা, নন্দনতত্ত্ব, চলচিত্রে শব্দ ও সংগীতায়োজন, চলচিত্রে শিল্পনির্দেশনা, চলচ্চিত্রে অভিনয়, ডিজিটাল চিত্রগ্রহণসহ মোট ২৫টি বিষয়ে পড়ানো হয়। দেশে-বিদেশে নানা অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে আমরা দেশকে ভালো ভালো সিনেমা উপহার দেব—এমনটাই স্বপ্ন।