ভালো হতে গিয়ে হারিয়ে ফেলি নিজেকে

পুরোনো গিটারে নতুন সুর তুলতে ইচ্ছে জাগে। মডেল: তপন
পুরোনো গিটারে নতুন সুর তুলতে ইচ্ছে জাগে। মডেল: তপন

বাচ্চার স্কুলের বই গোছাতে গিয়ে লিনার চোখে পড়ল খুব সুন্দর করে আঁকা গ্রামের দৃশ্য। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। একসময় তিনিও ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। চেয়েছিলেন চিত্রশিল্পী হিসেবে গড়ে তুলবেন নিজের পেশাজীবন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আর হয়ে ওঠেনি। মা–বাবাও কখনো চাননি এবং আশপাশের মানুষের নিরুৎসাহিত করার কারণে তিনিও আর সাহস করতে পারেননি। আর বিয়ের পর চাকরি-সংসার সামলাতে গিয়ে, সব জায়গায় দক্ষতার পরিচয় দিতে গিয়ে রংতুলি শেষ কবে তুলে ধরেছিলেন মনে করতে পারেন না।

আসিফের কথাই ধরুন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কী দারুণ গিটারই না বাজাত। কখনো ভালো কর্মী, দায়িত্ববান স্বামী সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য—প্রতিদিনের ব্যস্ততায় গিটার হাতে নেওয়ার সময় কোথায়?

 এ রকম উদাহরণ নিজের অথবা চারপাশের সবার জীবন থেকেই পাব। আশপাশের মানুষের কথা ভাবতে গিয়ে প্রায়ই নিজেকে হারিয়ে ফেলি। একসময় আফসোস তৈরি হয়, তখন আর কিছুই করার থাকে না। আমরা নিজেদের চাহিদা পূরণের থেকে অন্যের চাহিদা পূরণে এগিয়ে যাই। অন্যের খুশি কিংবা আনন্দকে প্রাধান্য দেওয়া আমাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক সংস্কারের দিক থেকেও আমাদের চিন্তা এমন থাকে যে আমি যদি কাউকে না বলি, তাহলে সবাই আমাকে খারাপ ভাববে কিংবা আমার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখবে না। নিজের ইচ্ছে বা প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেওয়ার মানে হচ্ছে স্বার্থপরতা। আমরা আরেকজনের কাছ থেকে সম্মতি খুঁজি; কেউ আমাকে ভালো বললেই আমি ভালো। সে জন্য অনেক সময় নিজের শত কষ্ট বা অসুবিধাতেও না বলতে পারি না।

নিজেকে যেন খুঁজে ফিরি রংতুলির মাঝে। মডেল: সাইদা। ছবি: সুমন ইউসুফ

আপাতদৃষ্টিতে এই মানুষেরা সবার কাছে জনপ্রিয় হন। হয়তো খুব প্রিয় বাবা, মা কিংবা ভাবি, চাচা কিংবা মামা খুব ভালো বন্ধু। সবার বিপদে পাশে আছেন। তবে কখনো কি ভেবে দেখেছি, এই ব্যক্তির মনের অবস্থাটা কী হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এঁরা উদ্বিগ্নতায় ভুগে থাকতে পারেন। এঁদের মধ্যে ভয় কাজ করতে থাকে—আমাকে ছেড়ে যদি চলে যান, আমাকে যদি ভালো না বলেন! মূলত এই ভয় থেকে এঁরা সবার জন্য মুখ বুজে কাজ করতে থাকেন। সহজে ‘না’ বলতে না পারার কারণে নিজেদের মধ্যে একধরনের হতাশাও তৈরি হতে পারে। একসময় সেটি ক্ষোভে পরিণত হতে পারে। ‘আমি জীবনে কিছুই পেলাম না’—এই ভাবনাও চলে আসাটা অস্বাভাবিক নয়। অন্যের জন্য করতে করতে নিজস্বতা বলতে কিছুই থাকে না। এই মানুষগুলোর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাবও দেখা যায়।

এ কথাগুলোর সঙ্গে অনেকেই বিরোধিতা করতে পারেন। ভাবতে পারেন ‘আমি কি মানুষের কথা ভাবব না?’, ‘শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবা সেটা তো স্বার্থপরতা’—এ রকম অনেক চিন্তা চলে আসতে পারে। একসঙ্গে চলার পথে একজন আরেকজনের সুবিধা–অসুবিধার কথা অবশ্যই ভাবব। তার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ইচ্ছা, চাহিদা, প্রয়োজনীয়তা ভারসাম্য হচ্ছে কি না, তা–ও দেখে নিতে পারি। নিজেকে যেন অনেক কিছুর মধ্যে হারিয়ে না ফেলি। সেই খেয়ালও রাখতে হবে। এমনও অনেক শুনেছি, ছেলে মেয়েকে কিংবা মেয়ে ছেলেকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে পরিবারের কথায়, যেখানে নিজের পছন্দ একদম ছিল না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, নিজেরা এই ভুক্তভোগীর অংশ। পরে আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকছে না।

ছোটবেলা থেকে এই কথাগুলো শুনতে শুনতে আমরা মনের মধ্যে গেঁথে ফেলি এবং তা সারা জীবন বহন করে বেড়াই। কিছু করার আগে ভেবে দেখতে পারি, আসলেই কতটুকু প্রযোজ্য এটা আমার জন্য। ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের আমরা শেখাতে পারি, কীভাবে নিজেকে ভালোবাসতে হয় এবং তা প্রকাশ করতে হয়। আমি যেমন আমার অধিকারটুকু দেখব তেমনি অন্যেরটুকুও দেখব। যখনই আমি এভাবে চিন্তা করতে পারব, তখনই দুটির সমন্বয় কীভাবে নিজস্ব মতামত দিতে হয়, তা বুঝতে পারব। আমি যখন নিজে না বলতে পারব, একই সঙ্গে অন্যের না বলাটাকেও গ্রহণ করে নিতে শিখতে হবে। আমার যেমন পছন্দ–অপছন্দ রয়েছে, তা আরেকজন মানুষেরও আছে। তা মেনে নিতে শিখতে হবে, যা আমাদের নিজের প্রতি যত্নশীল হতে শেখাবে। ভুলে যাই, আমরা যদি নিজেকে নিয়ে ভালো থাকতে পারি, কেবল তখনই অন্যকে ভালো রাখতে পারব।

 লেখক: কাউন্সেলর, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়