হঠাৎ মা–বাবা আবিষ্কার করলেন বয়ঃসন্ধিকালের সন্তান প্রেমে পড়েছে। অনেকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কেউবা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। অভিভাবকের কী করা উচিত?

এসএসসি শেষ করে কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে শর্মী (ছদ্মনাম)। মা-বাবা খেয়াল করলেন ইদানীং সে যেন তাদের এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে। আগে সে বাবা-মায়ের উপস্থিতিতেই বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলত, এখন কোনো কোনো সময় সে আলাদা ঘরে গিয়ে ফিস ফিস করে কথা বলে। বাসার বাইরে গেলে কখনো ফিরতে দেরি হচ্ছে। বাবা-মা চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাঁদের মেয়ে কি প্রেমে পড়েছে?
বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মা-বাবা এমনিতেই চিন্তায় থাকেন। এসব চিন্তার মধ্যে একটা বড় চিন্তা হচ্ছে কার সঙ্গে কখন কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তা নিয়ে। যেকোনো ধরনের প্রেম বা আবেগীয় সম্পর্ককে বাবা-মায়েরা ভয় পান। তাঁরা সন্তানকে কঠোর শাসন করেন, মোবাইল ফোন কেড়ে নেন, বাসার বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেন, কখনো সন্তানের বিশেষ বন্ধু বা বান্ধবীটিকে শাসান, তাদের বাবা-মাকে নালিশ করেন। কেউ কেউ মারধরও করেন। কিন্তু এ ধরনের আচরণ সন্তানের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। মা-বাবাকে বুঝতে হবে যে তাদের সন্তানটি একটি আবেগীয় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। যেসব লক্ষণ দেখে তাঁরা বুঝতে পারবেন তা হলো—
* তার একটি আলাদা নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়েছে, কিছুটা গোপনীয়তা বজায় রাখছে।
* পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে দিন দিন অনাগ্রহী হয়ে উঠছে।
* একটু আড়াল হয়ে ফোনে কথা বলছে, কখনো নিচু স্বরে। কেউ কেউ সারারাত কথা বলছে।
* মাঝে মাঝে কিছু মিথ্যা বলছে। বাড়ির বাইরে থাকলে কখনো কখনো নিজের অবস্থান আড়াল করছে।
* কেউ কেউ মা-বাবার কাছে তার সম্পর্ক তৈরির বিষয়টি সরাসরি বা আকারে-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করছে।
* নিজেকে প্রায় সময়ই আগের চেয়ে কেতাদুরস্ত করে রাখার চেষ্টা করছে।
* কারও কারও ক্ষেত্রে আচরণের পরিবর্তন ঘটছে, আগের মতো রূঢ় বা উগ্র ভাবটি নেই।
* পড়ালেখায় মনোযোগের পরিবর্তন ঘটে, কখনো মনোযোগ কমে যায়, আবার কখনো বেড়েও যায়!
* বাবা-মায়েদের উচিত হবে এ সময় অস্থির না হয়ে, ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া। সন্তানের ওপর চড়াও হওয়া যাবে না।
মা-বাবা যা করতে পারেন
* মোটেই উত্তেজিত হবেন না। প্রেমে পড়লে কেমন ভালো লাগতে পারে সেটা বুঝে আপনার সন্তানের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করুন। নিজের জীবনের দিকে একবার ফিরে তাকাতে পারেন।
* তার সম্পর্কের প্রতি অতি উৎসাহী হয়ে, খুশিতে গদগদ হয়ে খুব ভালো উদার বাবা-মা হওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। মনে রাখতে হবে আপনার সন্তানের বয়স খুব বেশি নয়, সুতরাং তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর আগে সার্বিক বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ করুন।
* আবার ধুম করে রেগে গিয়ে তার সম্পর্কটি এই মুহূর্তেই শেষ করে ফেলতে হবে, এমনতর আদেশ বা হুমকি তাকে দেবেন না।
* সন্তানের বয়স যদি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযোগী না হয়, তবে তাকে উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বিরত রাখুন। অপেক্ষা করতে বলুন। হুট করে সম্পর্ক ভেঙে ফেলার জন্য চাপ দেবেন না।
* সন্তানের অনুভূতিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিন। যদি মনে করেন এই সম্পর্কটি তার পড়ালেখা বা ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকর হবে, তবে তা সন্তানকে বুঝতে দিন।
* সন্তানকে ভালোবাসা আর মোহের সংজ্ঞা ও পার্থক্য বুঝিয়ে বলুন। যাতে সে বুঝতে পারে যে সে সত্যিই প্রেমে পড়েছে না, মোহগ্রস্ত হয়ে গেছে।
* আপনার সন্তানের ভালোবাসার মধ্যে যত্ন আর আন্তরিকতা আছে কি না। না থাকলে তাকে সাবধান করুন।
* আপনার সন্তান তার ভালোবাসার মানুষটিকে কোনো বিপদে ফেলছে কি না সেদিকে নজর দিন। সন্তান নিজেও কোনো বিপদে পড়ছে কি না খেয়াল করুন।
* আপনার সন্তান কি সম্পর্ক বজায় রাখতে প্রস্তুত কি না সেদিকে নজর দিন। প্রয়োজনে তাকে প্রস্তুতির জন্য সুযোগ দিন এবং প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত সম্পর্কের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিতে অনুরোধ করুন।
* তার সম্পর্কটিকে অনুমোদন করবেন না করবেন না সে বিষয়টি সার্বিক পরিস্থিতি ও আপনার ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার ওপর নির্ভর করে। তবে যদি অনুমোদন করেন তবে আপনার সন্তানকে কিছু নিয়মরীতি বেধে দিন। এ নিয়মগুলো মেনে চলতে তাকে উৎসাহিত করতে হবে। যেমন রাত জেগে কথা না বলা, বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে না থাকা, ক্লাস-পড়া ফাঁকি না দেওয়া ইত্যাদি।
* অনেক সময় মনে হতে পারে যে প্রেমে পড়ার কারণে আপনার সন্তানটি আপনার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রয়োজনে বাবা-মায়েরাই তাকে একটু বেশি বেশি সময় দিন।
* সন্তানের আস্থা অর্জন করুন। যাতে তারা আপনার কাছে তাদের সম্পর্ক ও এর জটিলতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে। প্রয়োজনে আপনার সন্তানের বিশেষ বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন।
* বিষয়টিকে ঝুলিয়ে রাখবেন না। কখনোই ভাববেন না ‘আরে এগুলো কিছুই না, দুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে।’ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করুন। অনুমোদন করেন আর নাই করেন, সন্তানের কাছে আপনার বক্তব্য আর মনোভাব স্পষ্ট করতে হবে।
* অনেক সময় দেখা যায় মা-বাবা একে অপরের কাছ থেকে বিষয়টি লুকিয়ে রাখেন। এমনটা করা যাবে না। বাবা-মা পরস্পর আলাপ-আলোচনা করে সমন্বিত সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
* শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি মাথায় রেখে সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই সতর্ক করুন। নৈতিকতা আর নিরাপত্তার বিষয়গুলো তাকে ছোটবেলা থেকেই শেখাতে চেষ্টা করুন।
* প্রয়োজনে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করুন বা বিশেষ জটিলতায় মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন।
আহমেদ হেলাল : সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা