Thank you for trying Sticky AMP!!

যেভাবে আদি রূপে ফিরছে লালবাগ কেল্লার হাম্মামখানা

লালবাগ কেল্লা প্রাঙ্গণের প্রধান তিনটি ভবনের একটি হলো দরবার হল ও হাম্মামখানা। সেটাই পুনরুদ্ধার ও সংস্কারকাজ চলছে। প্রকল্পের একজন পরামর্শক স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ। মোগল আমলের স্থাপনাটি কীভাবে আদি রূপ ফিরে পাচ্ছে, তাঁর কাছ থেকে শুনলেন সজীব মিয়া

লালবাগ কেল্লা প্রাঙ্গণে চলছে হাম্মামখানার সংস্কার ও সংরক্ষণের কাজ

প্রতিটি ভবনেরই একটা গল্প থাকে। সে গল্পটা সময়ের। একেক সময় প্রয়োজনের তাগিদে, ব্যবহারের সুবিধার্থে ভবনে পরিবর্তন আনা হয়। সংস্কার বা পুনরুদ্ধার কাজের ক্ষেত্রে একজন সংরক্ষণ–স্থপতির প্রথম কাজ হয় ভবনের কী কী পরিবর্তন হয়েছে তা খুঁজে বের করা। পরিবর্তনটা কখন, কীভাবে হয়েছে, সেটা বের করা। পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লার দেওয়ান-ই-আম বা দরবার হল ও হাম্মামখানা সংস্কার বা পুনরুদ্ধারের কাজ করতে গিয়ে আমরা সে পথেই হাঁটছি।

ইতিহাসের পথ ধরে

ইতিহাসবিদদের অনেকে বলেন, লালবাগ কেল্লা তৈরির কাজ যে শাসক শুরু করেছিলেন, তিনি থাকতেন চাঁদনী বজরায়। বুড়িগঙ্গাপারের যে জায়গাটা বর্তমান চাঁদনী ঘাট নামে পরিচিত, সেখানেই নোঙর করা থাকত এই নৌকা। দিনের বেলা এসে নির্মাণকাজ তদারক করতেন তিনি। এখানে অফিস করতেন। তাঁর গোসলের প্রয়োজন হতো, শৌচাগার ব্যবহারের দরকার পড়ত। সে কারণে প্রথমেই তিনি তৈরি করান গোসলখানা। মোগলেরা যাকে বলত হাম্মামখানা। হাম্মামখানায় গরম পানি ও ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পুরো কেল্লা নির্মাণ সম্পন্ন হলে হয়তো হাম্মামখানাটি পশ্চিম পাশের আবাসিক এলাকায় স্থানান্তরিত হতো।

নতুন দেয়াল অপসারণের পর পুরোনো সিঁড়িরও সন্ধান পাওয়া গেল। দুই পাশে দুটি সিঁড়ি। এত দিন যা আড়ালেই ছিল
আবাসন সুবিধার জন্য দরজা-জানালা বানিয়ে হাম্মামখানায় পরিবর্তন আনা হয়েছিল

হাম্মামখানার সামনের দ্বিতল ভবনটা দেওয়ান-ই-আম বা দরবার হল। আমজনতার সঙ্গে বৈঠক হতো বলেই এমন নাম।

Also Read: শায়েস্তা খানের কেন মনে হয়েছিল লালবাগ কেল্লা অপয়া

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় থেকে লালবাগের কেল্লা হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সেনানিবাস। থাকার জন্য দরবার হলে পরিবর্তন আনে তারা। মোগল ভবনের গায়ে ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির ছাপ পড়ে। ভবনের পেছন দিকে একটা বড় সিঁড়িও বানায় তারা। দরবার হল থাকে খোলামেলা। অনেকটা প্যাভিলিয়নের মতো কাঠামো। ব্রিটিশরা আবাসন সুবিধার জন্য দরজা-জানালা বানিয়ে সে কাঠামোয় পরিবর্তন আনে।

লালবাগ কেল্লার দরবার হল সংস্কারের আগে ও পরে

পাকিস্তান শাসনামলেও এখানে পরিবর্তন আসে। ৬০–এর দশকে ভবনটিকে মোগল নকশায় ফিরিয়ে নিতে কাজ করে তৎকালীন পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। আমরা পুনরুদ্ধার কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, প্রায় ৭০ শতাংশ মোগল রূপ ফিরে পেয়েছিল তখন। স্বাধীন বাংলাদেশেও অনেক কাজ হয়। আসে পরিবর্তন। এসব কাজে একটা ভুল হয়েছিল—সেটা হলো সিমেন্ট–সুরকির প্লাস্টার ব্যবহার। এতে স্থায়িত্ব হারায় চুন সুরকির কাঠামো।

Also Read: লালবাগ কেল্লা সংস্কারে অর্থায়ন করছে যুক্তরাষ্ট্র

বেরিয়ে এল সিঁড়ি

ইট-সুরকির গায়ে লেপ্টে দেওয়া সিমেন্টের প্লাস্টার সরিয়ে ফেলা ছিল আমাদের প্রথম কাজ। প্লাস্টার সরানোর পরই বেরিয়ে আসে বিভিন্ন সময় ভবনে যুক্ত হওয়া নানা অংশ। নতুন ইট, ইটের গাঁথুনি, নতুন মসলার ব্যবহার—এসব দেখলে যে কেউ নতুন আর পুরাতনের পার্থক্যটা বলে দিতে পারে।

সন্ধান পাওয়া সিঁড়ি সংস্কারের আগে ও পরে

দরবার হলে ইট-সিমেন্টের দেয়াল পাওয়া গেল, যা দিয়ে উন্মুক্ত জায়গা বন্ধ করা হয়েছিল। এগুলো অপসারণ করে ফেলা হলো। আদি রূপ ফিরে পেল দরবার হল। নতুন দেয়াল অপসারণের পর পুরোনো সিঁড়িরও সন্ধান পাওয়া গেল। দুই পাশে দুটি সিঁড়ি। এত দিন যা আড়ালেই ছিল। প্লাস্টার খোলার সময় দেখি, পাকিস্তান আমলে নতুন সিঁড়ি বানানো হয়েছিল। আমরা নতুন সিঁড়ি ভেঙে দিয়ে পুরোনো সিঁড়িতে ফিরে গেলাম।

Also Read: লালবাগ কেল্লাকে আগের আদলে ফেরানোর দাবি

হাম্মামখানায় আলো পড়ল

হাম্মামখানা মানে গোসলখানা। এখানে গোপনীয়তার ব্যাপার আছে। কিন্তু সেখানে বড় জানালা তৈরি করা হয়েছিল। সাধারণত এমন জানালা থাকার কথা নয়। আগেরকার হাম্মামখানার চরিত্র অনুযায়ী, আলো-বাতাস আসার কথা ওপর থেকে। প্লাস্টার সরাতেই ওপরে মিলল গর্ত। নতুন তৈরি জানালা বন্ধ করা হলো। আলো-বাতাস একই থাকল, আদি রূপ ফিরে পেল হাম্মামখানা।

হাম্মামখানার ওপরের গর্তটি বন্ধ করা হয়েছিল, সংস্কারের পর এখন সে পথে আলো আসছে

২০১২ সালে হাম্মামখানার একটা কক্ষের মেঝে কংক্রিটের ঢালাই করা হয়। বাইরে থেকে লাগানো হয় দরজা। এভাবে স্যুভেনির শপ হিসেবে কক্ষটাকে গড়ে তোলা হয়। কক্ষের কিছু অংশ ভাঙার পর দেখা গেল, এখানে চুল্লি ছিল। চুল্লিটা পুরোপুরি বের হয়ে গেল। যেখানে পানি গরম করা হতো। এই চুল্লি কক্ষের দেয়ালে প্লাস্টার আগের মতোই আছে। আমরা কক্ষটা সেভাবেই রাখব। আদি রূপ দেখবেন দর্শনার্থীরা।

যাঁদের নেতৃত্বে চলছে সংস্কারকাজ

সংরক্ষণে নতুন মাত্রা পাবে

এ কাজে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে আমরা পরামর্শক হিসেবে যুক্ত আছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে চালু হওয়া প্রকল্পটির নাম ‘কেল্লার হাম্মামখানার পুনর্গঠন, সংস্কার ও ত্রিমাত্রিক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রামাণ্য সংরক্ষণ’। প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডর ফান্ড ফর কালচারাল প্রিজারভেশন। সেপ্টেম্বর নাগাদ কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে ডকুমেন্টেশন ও গবেষণার কাজে আমাদের হয়তো মাস তিনেক সময় বেশি লাগবে। আশা করি এ ধরনের সরকারি ও বেসরকারি বিশেষজ্ঞদের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংস্কার, সংরক্ষণে নতুন মাত্রা যোগ হবে।