Thank you for trying Sticky AMP!!

রুবানা হক একা এবং অনেক

ছবি: সুমন ইউসুফ

রুবানা হকের সকালটা শুরু হয় অ্যালেক্সার সঙ্গে। ‘আজ আপনাকে কোন পত্রিকা পড়ে শোনাব? নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল নাকি দ্য গার্ডিয়ান?’ প্রতিদিন ওই সময় এ কথাই বলে অ্যালেক্সা। রুবানা হক জানিয়ে দেন তাঁর পছন্দ। মনমেজাজ হয়তো কোনো কারণে ঠিক নেই, অ্যালেক্সা তখন জ্যাজ মিউজিক বা রবীন্দ্রসংগীত বাজিয়ে দেয়।

প্রযুক্তি ও আশপাশের মানুষের কারণে রুবানা হকের একা থাকার সময় কোথায়? নিজেকে তিনি প্রযুক্তিপ্রেমী বলেন।
লন্ডনে বড় মেয়ের কাছ থেকে উপহার পাওয়া অ্যালেক্সা রোবট নিত্যদিনের অনেক কিছু সহজ করে দেয়। শুধু আদেশ করার জন্যই অপেক্ষা, সঙ্গে সঙ্গে তা পালন করে অ্যালেক্সা। আর মুঠোফোন তো আছেই। পিএইচডি থিসিসের সব বই থেকে শুরু করে গল্পের বই থাকে মুঠোফোনে। যখন যা ইচ্ছা, পড়ে নেন তিনি। প্রতিটি দিনই কর্মব্যস্ত।
এমনই এক কর্মব্যস্ত দিনে মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সমাজসেবী রুবানা হকের বাসায় সকালে গিয়ে হাজির হলাম। কথা শুরু হলো তাঁর স্বামী প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে নিয়ে। জানা গেল, কীভাবে সাধারণ একজন মেয়ে রুবানা থেকে তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি হয়ে উঠেছেন।

রুবানা হক
রুবানা হক
জন্ম: ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪, ঢাকা
স্কুল: ভিকারুননিসা নূন স্কুল
কলেজ: হলিক্রস কলেজ প্রিয় বই: আঠার বছর বয়সে পড়া আবু সৈয়দ আইয়ুবের পান্থজনের সখা প্রথম ভাবতে শিখিয়ে ছিল।
প্রিয় গান : রবীন্দ্রসংগীত ‘নয় নয় এ মধুর খেলা’।

ব্যবসাই জীবন
মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা রুবানা ১৫ বছর বয়স থেকে টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতেন। সত্যিকার অর্থে মেধাবী মেয়েটি এসএসসি, এইচএসসি—দুবারই বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছিলেন।
এটি আনিসুল হক ও রুবানা—দুজনেরই দ্বিতীয় বিয়ে। নাভিদ, ওয়ামিক, তানিশা ও শারাফ—চার সন্তান নিয়ে সংসার। যদিও ছয় বছর বয়সেই শারাফ বাবা–মায়ের কোল খালি করে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। সে এক দুঃসহ সময় কেটেছে মা রুবানা হকের। জীবনের বড় আঘাত।
পড়ালেখার দিকেই ছিল রুবানা হকের আগ্রহ, ব্যবসার প্রতি সেটা ছিল না একেবারেই। আনিসুল হকও শুরুতে চাইতেন না রুবানা ব্যবসায় আসুন। রুবানা হক তখন একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াতেন। পড়ানোটা উপভোগ করতেন। আনিসুল হকের ব্যবসাও ভালোই চলছিল। কিন্তু অতিরিক্ত কাজের চাপে আনিসুল হকের উচ্চ রক্তচাপ কমছিল না। এর মধ্যে একদিন চিকিৎসকের কাছে গেলেন তাঁরা। চিকিৎসক বললেন, ব্যবসার কিছু দায়িত্ব তো ভাবিকে দিলেই পারেন। কথাটি বেশ মনে ধরল আনিসুল হকের। বাড়িতে ফিরে আনিসুল হক ব্যবসার কাজে রুবানার সাহায্য চাইলেন। সে সময় আনিসুল হকের ব্যবসায়িক অংশীদারদের কারও স্ত্রী ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন না। তাঁরা কেউ অফিসে আসতেন না। রুবানা শুরুতে মতিঝিলের অফিসে গিয়ে বসে থাকতেন, টুকটাক কাজ করতেন। ধীরে ধীরে ব্যবসার কাজে যুক্ত হলেন। বর্তমানে ২১ টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি।
রুবানা বিষয়টিকে দেখেছেন এভাবে, ‘আমি অনেক পড়ুয়া। আমি আনিসকে বলেছিলাম, যতই ব্যবসা দেখি না কেন, আমি কিন্তু পিএইচডি করবই। সে তো আমার বন্ধু ছিল, আবার ছিল ব্যবসায়িক পার্টনারও। ও বলত, যা-ই করো, ব্যবসা ঠিক রাখতে হবে। ব্যবসায়িক বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এমনকি আনিসুল হকও অবাক হয়ে বলত, “এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নাও কী করে?” আর আমাদের সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাছে আমি মায়ের মতো। কার কী প্রয়োজন, কার কোথায় সমস্যা—সেগুলো খেয়াল রাখি। এমনকি পোশাক কারখানাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যাতে তাঁরা সময়মতো বেতন পান, সেটাও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি।’
রুবানা হকের আরেকটি নিয়ম আছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিজের মতো করে টিকতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠান অপর প্রতিষ্ঠানকে কোনো আর্থিক ঋণ দেবে না। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এভাবেই চলছে। একের পর এক ব্যবসায়িক সফলতা আসতে থাকল, একসময় অংশীদারি ব্যবসা থেকে বেরিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠান গড়লেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বত্বাধিকারী তখন তাঁরাই। ছেলে নাভিদও এখন মা রুবানা হকের সঙ্গে ব্যবসা দেখভাল করছেন। সন্তানেরা কত ভালো করছেন, এটা বলতে গিয়ে রুবানা হকের চোখে পানি চলে আসে। মনে হয় একজন সার্থক, সফল মা সামনে বসে আছেন।
রুবানা হক মনে করেন, তাঁর সব কাজ শেখা আনিসুল হকের কাছ থেকে। এতগুলো বছর তিনি আনিসুল হকের ছায়াতেই ছিলেন। এক বছর আগে নির্ভরতার ছায়া সরে যাওয়ার পর নিজেকে মানসিক দিক থেকে আরও শক্ত করেছেন। কারও সামনে কখনো কাঁদেননি। শুধু মনে হয়েছে, সব ঠিকঠাক চালিয়ে নিতে হবে, নিয়েছেনও।

শি ফর শি ও আমাদের সমাজ
বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে শুনতে পেতেন অনেক মেয়ে হয়তো পরচর্চা করছেন কিংবা শাড়ি-গয়না এসবের গল্প করছেন। সেই আড্ডার সময় তাঁর মনে হতো, এমন কিছু যদি করা যেত, যাতে মেয়েরা মেয়েদের পাশে থাকবেন। একজনের কষ্টের কথা আরেকজন শুনবেন। নিজের জন্যও যে কিছু করা যায়, সেই ভাবনাও তাঁদের নেই। সবকিছু সামলাতে তাঁদের জীবনের সব সময় চলে যায়। সেখান থেকে বের করে আনতে চান মেয়েদের। ‘শি ফর শি’ নামে একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। এখনো তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পেলেও ‘শি ফর শি’ নিয়ে অনেক কিছু করতে চান রুবানা হক।
‘কোনো মেয়েকে যদি দেখি হতাশায় ভুগছেন, তাঁকে ঝাঁকি দিই, তাঁর কথা শুনি। পাশে থাকার চেষ্টা করি। সবাই একটা আদর্শ পরিবারের ছবি দেখাতে চান। কিন্তু ভেতরে আসলে তাঁরা ভালো থাকেন না। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদেরও নানা কথা থাকে, যা তাঁরা নানা জায়গায় বলতে চান। কিন্তু নিজেদের কথা বলার জায়গা পান না। তাঁদের কথাও শুনি।’ বলেন রুবানা।
সামাজিক কাজ, কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবন—এভাবে আলাদা করে কিছু ভাবেননি। সব মিলিয়েই ভেবেছেন। বিভিন্ন পোশাক কারখানার বেশ কয়েকজন মেয়ের পড়াশোনার ভার নিয়েছেন, তাঁদের পড়াচ্ছেন চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ)। এইউডব্লিউর বোর্ডেও ট্রাস্টি রুবানা হক। তাঁদের জন্য এককালীন অনুদান দিয়েছেন। এখানকার মেয়েরা যখন ইংরেজিতে ই-মেইল করেন, তাঁদের কোনো সফলতার কথা কিংবা প্রয়োজনের কথা বলেন, রুবানার তখন খুশিতে মন ভরে যায়। যখন এ কথা বলছিলেন, সেই খুশি সামনে বসা মানুষটির মধ্যে দেখতে পাই।
রুবানা হক বলেন, ‘এইউডব্লিউর প্রতিষ্ঠাতা কামাল আহমেদ আমার বন্ধু। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল একদিন, কী করা যায়। তখনই আমার মনে হলো, এইচএসসি পাস করা মেয়েদের যদি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরের বিশেষ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ইংরেজি, গণিত, কম্পিউটার ও সব ধরনের পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী করে তৈরি করে তারপর যদি পড়ালেখা করানো যায়, নিশ্চয়ই তাঁরা অনেক ভালো করবেন। কামালকে জানালাম আমার ভাবনার কথা। এঁদের পড়াশোনার খরচ চালানোর ব্যাপারে আরও কিছু পোশাক কারখানার ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললাম। ভালো কিছু করলে তো নিজের মধ্যেও শান্তি আসে। অনেকে পরে খুব একটা সহায়তা না করলেও আমি সেটা চালিয়ে যাচ্ছি। সেই মেয়েদের মধ্যে একজন এবার নাগরিক টিভিতে হ্যাশট্যাগ নন্দিনী অনুষ্ঠানে এসেছিল। সেই তো আসল চেঞ্জমেকার।’ এসবের পাশাপাশি আনিসুল হক ফাউন্ডেশন, শারাফ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন রুবানা।

রুবানা হক

ড. রুবানা হক: এই আমি
কথার শুরুতেই বলেছিলেন, স্বামী আনিসুল হকের থেকে তিনি বন্ধু আনিসুল হককে বেশি মিস করেন। অনুভব করেন, আনিসুল হক তাঁর পাশে সারাক্ষণ আছেন। ‘রুবু’ বলে ডাকছেন। আনিসুল হক চাইতেন না তাঁর রুবু কোনো অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দিন, পার্টিতে যান। তিনি মারা যাওয়ার পর বুঝতে পারছেন, কেন তিনি চাইতেন না। একজন নারী সমাজে ভালোভাবে থাকতে পারেন, সেটা এই সমাজ অনেক সময় মেনে নিতে পারে না। অনেক উৎসুক চোখ, উতরোল মন চারপাশে। সেসব থাকবেই। কিন্তু জীবনে এগিয়ে যেতে হলে এ সব সমস্যা মোকাবিলা করেই এগোতে হবে, তেমনটাই ভাবেন তিনি।
জীবনে, সম্পর্কে আগেও চড়াই-উতরাই এসেছে, সেসব মোকাবিলা করেই তো এগিয়েছেন। ‘যদি মনে হয় অনেক কষ্ট জীবনে, অনেক সংগ্রাম—তবে আর এগোনো যায় না। জীবনের ট্র্যাজেডিকে ট্র্যাজেডি মনে করা যাবে না।’ বলেন রুবানা।
আগামী ২৪ ডিসেম্বর রুবানা হকের পিএইচডির সমাবর্তন। এটা নিয়ে খুব উত্তেজিত তিনি। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরুষোত্তম লালের প্রকাশনা সংস্থা ও রাইটারস ওয়ার্কশপের ওপর ‘রাইটারস ওয়ার্কশপ: এজেন্ট অব চেঞ্জ’ বিষয়ে পিএইচডি শেষ করেছেন গত বছর। ‘কেউ যখন আমাকে ডক্টর রুবানা হক বলেন, নামের পাশে লেখেন, কী যে ভালো লাগে—সেটা বোঝানো যাবে না। জীবনে শেষবারের মতো সমাবর্তনে হ্যাট-গাউন পরব, সেটা নিয়ে খুবই রোমাঞ্চিত আমি। এর পেছনে পরিবার ছাড়া আরেকজন মানুষের বড় ভূমিকা আছে—তিনি এখন অধ্যাপক নারীনেত্রী মালেকা বেগম, তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সমাবর্তনে যেতে চাই। আমি আমার সারা জীবনের সকল শিক্ষক, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে খুব কৃতজ্ঞ।’ ২০০৮ সালে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল নিয়ে এমএ শেষ করেন।
রুবানা হক একজন সৃজনশীল মানুষ। কবিতা লেখেন, প্রবন্ধ লেখেন, কবিতা লিখে পেয়েছেন সার্ক সাহিত্য পুরস্কার। আবার সময় পেলে নিজে মোমবাতি তৈরি করে উপহার দেন। বাড়িভর্তি নানা রকমের শিল্পকর্ম দেখলে বোঝা যায়, তিনি একজন বড় শিল্পসংগ্রাহকও বটে। অষ্টপ্রহর ব্যস্ততা। এতগুলো প্রতিষ্ঠান চালানো। সামাজিক দায়িত্ব পালন। শি ফর শি। কবিতায় বুঁদ হয়ে থাকা খানিকক্ষণ। সন্তান–সংসার। মোমশিল্পে মগ্নতা। আর রোবট অ্যালেক্সার খবরদারি কিংবা ঘরকন্না। অবসর কই? কোথায় অবকাশ!
তবু কি রুবানা একটিবার তাকান না অঘ্রানের আকাশের দিকে? নীল অনন্ত আকাশ, অসীম শূন্যতা। শূন্যতার মধ্যে আশার মতো সাদা মেঘ। মেঘের গায়ে রোদের পরশ। তাঁর কি মন কেমন করে?