
‘রেললাইনের ওই বস্তিতে জন্মেছিল একটি ছেলে/ মা তাঁর কাঁদে...ছেলেটি মরে গেছে’ গানের বাকি লাইনগুলো এখানে না লিখলেও চলে, আমরা সবাই তা জানি, আমাদের সবারই খুব চেনা এই ছবি। ‘পপগুরু’ আজম খান মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের এ ছবি এঁকেছিলেন। দারিদ্র্য আর সামাজিক অসহায়ত্বের এই ছবি যেন খুব একটা বদলায়নি দুনিয়াতে। বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ প্রতিবেশী ভারতের ‘রেললাইন চিলড্রেনস’ বা ‘রেল শিশু’দের জীবনকথাও যেন মিলে যায় এই কবিতায়, এই গানের আকুতিতে।
ভারতের রেল-শিশুরা
মা মরে যাওয়ার পর, মদ্যপ বাবার গালমন্দ-মারধর আর সইতে না পেরে বাড়ি ছেড়েছিল হরিয়ানার নয় বছর বয়সী ছেলেটি। একসময় স্কুলে গেলেও মায়ের মৃত্যুতে পরিবারহীন হয়ে পড়ে সে। এখন রাজধানী নয়াদিল্লির রেলস্টেশনই ওর বাড়িঘর। ছেঁড়া ময়লা জামা, জীর্ণ একটা হাফপ্যান্ট আর মাথায় পুরোনো একটা বেসবল ক্যাপ। সারা দিন রেললাইনের আশপাশে আর ডাস্টবিনে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে সেগুলো বিক্রি করেই দিন চালানোর চেষ্টা। রাতে স্টেশনের প্ল্যাটফরম বা ওয়েটিং রুমের বারান্দায় ঘুম।
নামে কী আসে-যায়! ওর মতো এমন আরও লাখো শিশু আছে ভারতের রেলস্টেশনগুলোতে। গণমাধ্যম আর সরকারি-বেসরকারি নানা উন্নয়ন সংস্থার ভাষায় ওরা এখন ভারতের ‘রেল-শিশু’। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রেলওয়ে নেটওয়ার্কের দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতাসহ বড় বড় নগর-বন্দরের রেলস্টেশন আর জংশনগুলোতে প্রতিবছর আশ্রয় নিচ্ছে আনুমানিক এক লাখ ২০ হাজার এমন গৃহহীন ছেলেমেয়ে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
ওরা প্রতিদিন আসে
ভারত একদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজের আসন পোক্ত করছে, সমর শক্তিতে আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্বের ধাপ পেরিয়ে বিশ্ব পরাশক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। ‘মাল্টি বিলিওনিয়ার’ বা ‘শত কোটিপতি’র সংখ্যায় অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে ভারতের নব্য উচ্চ-উচ্চবিত্তরা। দেশটির মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিনই আর অন্যদিকে গ্রামীণ দারিদ্র্য, সামাজিক অসহায়ত্বের নিগড়ে বাঁধা পড়া লাখো কোটি মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠে এসব রেল-শিশু যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে পুরোনো ভারতের এই সংকট সমাধানের কোনো সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি নেই। ২০২০ সালের মধ্যে ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘তরুণ জনসংখ্যার দেশ’ হয়ে উঠতে যাচ্ছে। কিন্তু এই রেল-শিশুরা যেন রেললাইনে লাল বাতির মতোই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সুফল ভোগের প্রস্তুতি এখনো বহুদূর।
নয়াদিল্লি রেলস্টেশনে রেল-শিশুদের নিয়ে সর্বশেষ জরিপ চালানো হয় ২০০৭ সালে। একটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালিত ওই জরিপে দেখা গেছে, প্রতিদিন অন্তত ২৫ থেকে ৪০টি গৃহহীন শিশু ওই স্টেশনে এবং এর আশপাশে এসে আশ্রয় নেয়। সালাম বালাক ট্রাস্টের প্রমোদ সিং জানান, এখন এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন সকালে স্টেশন এলাকায় ঘুরে ঘুরে নতুন আসা এমন শিশুদের নিজেদের সংস্থার তালিকাভুক্ত করার কাজ করে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি উন্নয়ন সংস্থা ‘রেলওয়ে চিলড্রেন’-এর হিসাবে ভারতে প্রতি পাঁচ মিনিটে একটি শিশু একা একা কোনো না কোনো রেলস্টেশনে আসে।
‘রেলওয়ে চিলড্রেন ইন্ডিয়া’র কান্ট্রি ডিরেক্টর নাভিন সেল্লারাজু জানান, ভারতের পশ্চাত্পদ রাজ্যের গ্রামীণ জনপদগুলোর দারিদ্র্য থেকে পালিয়ে এখানে আসে ওরা। দিল্লি বা মুম্বাইয়ে আপনি সহজেই উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের অনেককেই পাবেন। ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যা ব্রাজিল এবং রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। সেল্লারাজু আরও বলেন, অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলই রেলপথে বড় বড় নগর-বন্দরের সঙ্গে যুক্ত, সড়কপথে নয়। ফলে এমন যেকোনো শিশুই বিনা টিকিটে ট্রেনে চেপে বসে এসব শহরে চলে আসতে পারে।
স্টেশন, আশ্রয় নয়
স্টেশন সাময়িক আশ্রয়ই বটে, কিন্তু এ আশ্রয় বড়ই অনিরাপদ। কোনো একটা স্টেশনে বা জংশনে পৌঁছানোর প্রথম মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় একটা শিশুর শারীরিকভাবে নিপীড়িত-নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কা। ছেলেশিশুরা এ ক্ষেত্রে প্রথমেই শিকার হয় কিছুটা বড় বয়সী শিশু-কিশোরদের অন্য কোনো দলের মাস্তানির, এটা দলে ভেড়ানোর কৌশলও বটে। কিংবা সরাসরি কোনো প্রাপ্তবয়স্কের যৌন নিপীড়নের। আর মেয়েরা বয়স ভেদে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রথমেই শিকার হয় যৌন নিপীড়নের। আর কোনো পাচারকারী দলের খপ্পরে পড়ে অনেক মেয়েরই শেষ ঠিকানা হয় যৌনপল্লি।
ফেরার পথ নেই
নয়াদিল্লির স্টেশন প্রাঙ্গণের কাছেই একটা জীর্ণ বাড়িতে সালাম বালাক ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে একটা আশ্রয়কেন্দ্র আছে রেল-শিশুদের জন্য। নয়টি কিশোর ওই বাড়ির রকে বসে তাস খেলছে। সবারই পা খালি। এদের কয়েকজনই মাত্র সেদিনই সেখানে এসেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়জনের বয়স মাত্র ১৪। এদের একজন দুয়েক বছর আগে এসেছে হাজার কিলোমিটার দূরের বিহারের কিষানগঞ্জ থেকে। কয়েক মাস ধরে এই সংগঠনের আওতায় থাকছে ছেলেটি।
ছেলেটি বলছিল, ‘আর বাড়ি ফিরে যেতে চাই না আমি। এখন এখানেই আছি, এদের সঙ্গে আছি।’ রেলওয়ে চিলড্রেনসের কর্মকর্তা কিরণ জ্যোতি জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন শিশু-কিশোরদের আর বাড়িতে ফেরত পাঠানো যায় না। তিনি জানান, ‘অনেক সময়ই নতুন আসা শিশুরা কয়েক মাসের মধ্যেও মুখ খোলে না। কোথা থেকে এসেছে, কী পরিচয়, সেগুলো জানতেই আমাদের সময় লেগে যায়। আর যদি ওদের কোনোভাবে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া না যায় তাহলে তাদের দীর্ঘদিন ধরে সেবার আওতায় আনতে হয়।’ স্টেশনে থেকে যাওয়াদের বেশির ভাগই খুচরো কাজে উপার্জনের চেষ্টা করে। কেউ কেউ জড়িয়ে যায় অপরাধীদের চক্রে। নেশা আর পকেট মারা, চুরি ইত্যাদি।
ভারতীয় আইনে মানবপাচার এবং শিশু-কিশোরদের রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগের কথা বলা থাকলেও সে সবের প্রয়োগ প্রায় চোখেই পড়ে না। এদিকে, রেল কর্মকর্তা আর পুলিশের কাছ থেকে সহায়তার বদলে উল্টো ধমক এমনকি মারধরের শিকার হওয়ারও অভিযোগ পাওয়া যায় এমন রেল-শিশুদের কাছ থেকে। এখন শিশু-কিশোরদের রক্ষায় বিশেষ পুলিশ ইউনিট এবং রেলওয়ে কোম্পানিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এই রেল-শিশুদের সহায়তার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক এই শিশু যে গ্রাম বা বাড়ি থেকে এসেছে, সেখানে আর তাদের ফেরা হয় না। দিল্লি অনেক দূর।