যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বাসিন্দা স্কট বেনেডিক্ট আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করছেন ১৫ বছর ধরে। শুধু স্থাপনা নিয়েই কাজ করেন তিনি। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবনের স্থপতি লুই আই কানের স্থাপত্য তাঁর অন্যতম আগ্রহের বিষয়। সম্প্রতি স্কট ঘুরে গেলেন ঢাকা।

ভিনদেশি এক মানুষ হয়েও লুই আই কান বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত এক নাম। বাংলাদেশের চির কাছের মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে আছে লুই কানের অমর কীর্তি—ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় সংসদ ভবন। সেই লুই কানের স্থাপত্যের খোঁজেই একজন আলোকচিত্রী ঘুরছেন বিশ্বের নানা জায়গা!
লুই আই কানের স্থাপত্য শৈলী স্কট বেনেডিক্ট নামের এই আলোকচিত্রীকে এমনই মুগ্ধ করেছে তাঁর ছবির প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে লুই কানের স্থাপত্য। সেই টানেই তিনি হাজির হয়েছেন বাংলাদেশ অবধি। কিন্তু কীভাবে স্কট মজলেন লুই আই কানের স্থাপত্য নিদর্শনের প্রেমে?
যেভাবে শুরু
ঘটনা ২০১০ সালের। দারুণ এক সমস্যায় পড়েছে নিউইয়র্কের টেম্পল বেথ এল সিনাগগ (ইহুদিদের উপাসনালয়) কর্তৃপক্ষ। স্থাপনার নকশা পরিবর্তন বা ভেঙে নতুন করে নির্মাণ তো হরহামেশাই ঘটে। কিন্তু স্থপতির নাম যখন লুই আই কান, তখন সেই স্থাপনার পরিবর্তন চাই নাকি সংরক্ষণ? তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-প্রতিবাদ সব শেষে পরিবর্তনের পক্ষেই মত এল। এই খবর গিয়ে পৌঁছাল স্কটের কাছে। স্থাপত্য আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করেন তিনি। স্কট চাইলেন সিনাগগটির কিছু ছবি তুলে রাখতে। ভেঙে ফেলার কয়েক দিন আগে সেটির কিছু ছবি তুলে রাখেন তিনি। সেই থেকে শুরু। তাঁকে পেয়ে বসে লুই আই কানের ছবি তোলার নেশা। ২১ মার্চ প্রথম আলো কার্যালয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তখনো দুশ্চিন্তায় তিনি। অনুমতি পাননি সংসদ ভবনের ভেতরে ছবি তোলার। সেদিনই ঘুরে এসেছেন সংসদে। স্কট মনে করেন ‘লুই কানের করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল নকশা এটি।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এর বাস্তবায়ন করেছে মূল নকশার সঙ্গে কোনো আপস না করেই, খুব ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও। এর রক্ষণাবেক্ষণও যথাযথভাবে করছে। এটাও খুব প্রশংসার বিষয়।’
স্কটের কাজ সম্পর্কে আরও জানার আগে চলুন আরও কিছু তথ্য জেনে নিই লুই কান সম্পর্কে।
লুই কান পরিচিতি
১৯০১ সালে এস্তোনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী লুই কান তাঁর মা–বাবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হন। পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে স্থাপত্যে স্নাতক হয়ে ফিলাডেলফিয়ায় তিনি তাঁর কর্ম জীবন শুরু করেন। ফিলাডেলফিয়ার রিচার্ড মেডিকেল ল্যাবরেটরি নকশার মাধ্যমে তিনি প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে ইয়েল আর্ট গ্যালারি, কিমবেল আর্ট মিউজিয়াম, ভারতে আহমেদাবাদ ম্যানেজমেন্ট সেন্টার, নেপালে ফ্যামিলি প্লানিং সেন্টার ইত্যাদি। তাঁর সেরা কাজ মনে করা হয় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবনকে। বাংলাপিডিয়া বলছে, ১৯৫৯ সালে প্রথম ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সটির পরিকল্পনা গৃহীত হয়। তখনকার খ্যাতনামা স্থপতি লুই কান ভবন কমপ্লেক্সটির নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব পান। ১৯৬২ সালে মূল নকশা প্রস্তুত হয়। কমপ্লেক্সটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮২ সালে।
স্কটের চোখে লুই কান
ফিরে যাই স্কটের সেই প্রথম ছবিটির কথায়। লুই কানের সেই স্থাপনার ছবি নিয়ে আলোচনা হয় স্থাপত্যবিদদের মধ্যে। ছবিটি দেখেন উইলিয়াম হুইটেকার। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার লুই কান আর্কাইভের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। স্কটের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তাঁকে দারুণ উৎসাহ দেন। স্কট বুঝে ফেলেন লুই কানের অন্য কাজগুলোও দেখতে হবে তাঁকে। একদম ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুরু করেন ঘুরে ঘুরে কানের স্থাপনার ছবি তোলা। ‘কিছু একটা যেন আমাকে টানছিল, তবে সেটা কী তা আমি বলে বোঝাতে পারব না।’ স্কট বলেন। লুই কানের প্রায় সব কাজই তিনি দেখেছেন, অনেক সময় নিয়ে ছবি তুলেছেন। তাঁর লেখা পড়া, তাঁকে নিয়ে বানানো ছবি দেখা-সবই করেছেন।
স্থাপনাগুলো দেখার পাশাপাশি লুই কানের লেখাও পড়েছেন স্কট। ‘আমার মনে হয়েছে, নিজেকে প্রকাশ করার একটা দ্বন্দ্ব চলছিল তাঁর মনে।’ ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার করলেন স্কট। ‘স্থাপনার মাধ্যমে যা বলতে চাইছেন তা লিখে প্রকাশ করাটা কঠিন ছিল তাঁর জন্য।’ লুই কানের স্থাপনার কথা বললে সিমেট্রি বা সমানুপাতের ব্যাপারটি আসে। বলা যায় ক্যালিফোর্নিয়ার সলক ইনস্টিটিউটের কথা। দুপাশে সমান উচ্চতার ইমারতের মাঝ বরাবর কাটা আছে পরিখা। সামনের বিশাল সমুদ্র আর আকাশ দেখার পথেও বাধা নেই কোনো। ‘সমানুপাত একটা ভারসাম্যের অনুভূতি দেয়। আশপাশের কোনো কিছু দৃষ্টিসীমায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। দর্শক হিসেবে আপনি শুধু সেই স্থাপনার সৌন্দর্যই উপভোগ করতে পারেন। খুব বেশি ভাবার বা গূঢ় অর্থ খুঁজে বের করার কোনো চাপ থাকে না।’ বেশ কয়েকটি স্থাপনা দেখে এমনটাই মনে হয়েছে স্কটের। ‘ইটস জাস্ট দেয়ার’ এটুকু বলে অন্য আলাপে গেলেন স্কট।
নিজের চোখের চেয়েও ক্যামেরার নির্দেশনায় বেশি ভরসা করেন স্কট। কিংবা করতে চান। ‘ক্যামেরাটাই আমাকে চালিয়েছে। তাঁর চোখ দিয়েই আমি দেখতে চেয়েছি লুই কানকে। এটা নিছক একটি রেকর্ডিং ডিভাইস নয়। এটি একটি সক্রিয় যোগাযোগের মাধ্যম। কীভাবে, কোথায় ক্যামেরা তাক করতে হবে, সেটাই শিখতে চেয়েছি আমি।’ বলেন তিনি।
ঢাকা শহরেই আছে লুই কানের আরেক নিদর্শন—শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। সেটিও ঘুরে এসেছেন স্কট। ঢাকা থেকেই চলে যাবেন ভারতের আহমেদাবাদ। সব ছবি নিয়ে একটি বই প্রকাশের পরিকল্পনা আছে তাঁর।
স্কট বেনেডিক্ট বৃত্তান্ত
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বাসিন্দা স্কট বেনেডিক্ট আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করছেন ১৫ বছর ধরে। শুধু স্থাপনা নিয়েই কাজ করেন তিনি। স্থাপনাবিষয়ক বই, ম্যাগাজিন এবং স্থপতিদের জন্য ছবি তুলে দেন। তবে আলোকচিত্র বা স্থাপনা কোনো বিষয় নিয়েই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করেননি। শখ থেকেই পেশাদার বনে যাওয়া। ক্যানন ফাইভ ডি মার্ক টু ক্যামেরাটাই সব সময়ের সঙ্গী ছিল। ইদানীং ব্যবহার করছেন সনি এ সেভেন আর মডেলের ক্যামেরা।
লুই কানের স্থাপনাগুলোর কাজ শুরু করার পর নিজের বাড়িতে থাকার আরাম প্রায় ভুলেই গেছেন। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা ঘুরেই দিন কাটছে। তবে যেখানেই থাকেন স্কাইপে নিয়মিত কথা হয় মা আর বান্ধবীর সঙ্গে, জানালেন স্কট।
স্কটের ক্যামেরায় লুই কানের স্থাপনা
যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটে ইয়েল আর্ট গ্যালারি। লুই কানের একটি ‘মাস্টারপিস’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এটিকে
পেনসিলভানিয়ায় অবস্থিত এ বাড়িটি কানের নকশা করা ব্যক্তিগত স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম
মাই আর্কিটেক্ট
বাবা লুই কানকে চেনেন সারা দুনিয়ার মানুষ। কিন্তু ছেলে নাথানিয়েল কানের কাছে তিনি ছিলেন প্রায় ‘অচেনা’। সেই ‘অচেনা’ বাবাকে খুঁজতেই ছেলের এক যাত্রা। নানা দেশে ঘুরেছেন নাথানিয়েল, কথা বলেছেন তাঁর বাবার চেনাজানা কাছের মানুষগুলোর সঙ্গে। ঘুরে দেখেছেন বাবার নকশা করা স্থাপনাগুলো। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই নির্মাণ করেছেন প্রামাণ্যচিত্র মাই আর্কিটেক্ট। এ জন্য নাথানিয়েল এসেছিলেন বাংলাদেশেও। কথা বলেছেন স্থপতি শামসুল ওয়ারেসের মতো মানুষদের সঙ্গে। ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া এ ছবিটি সে বছর অস্কার মনোনয়নও পেয়েছিল।