কুমড়ো ফুল, শজনেডাঁটা, ডালের বড়ি সাজিয়ে এক শাশ্বত ফাগুনের চিত্রকল্প এঁকেছিলেন কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। সে চিত্রকল্পের প্রধান চরিত্র ছিল আমাদের ভাষা এবং ভাষার জন্য আন্দোলন। কিন্তু এক অমোঘ জাদুবলে শজনে ফুলে আর ডাঁটায় সাজানো ফাগুন আমাদের দৃশ্যকল্পজুড়ে রয়ে গেছে। আর সে জন্যই হয়তো ফাগুনের শুরুতে ভাষার মাসে শজনের কথা উঠলেই আমাদের ভাবনাজুড়ে হাজির হয়ে যান সেই দুঃখিনী মা, ‘খোকা, তুই কবে আসবি?/ কবে ছুটি?’ বলে যিনি সন্তানের জন্য নিরন্তর অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, যাঁর সন্তান ভালোবাসতেন শজনেডাঁটা, কুমড়ো ফুল, ডালের বড়ি খেতে। অথবা হয়তো মা–ই ভালোবাসতেন সেগুলো, কে জানে।
২
আমরা যাঁরা বড় হয়েছি গ্রামীণ বাংলার প্রতিটি ঋতু বুঝতে বুঝতে, তাঁরা জানি, বসন্তের আগমনী বার্তা ঘোষণায় কোকিলের কুহুতান যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি শজনে ফুলের শুভ্র রূপও অপরিহার্য। সবুজ পাতার শজনেগাছ এ সময় হয়ে ওঠে সাদা। মেঘমুক্ত আকাশের প্রেক্ষাপটে শজনের এমন রূপ দেখেই হয়তো জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘এখানে আকাশ নীল—নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল/ ফুটে থাকে হিম শাদা—রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;…’। কিন্তু আমরা যাঁরা সাধারণ মানুষ, তাঁরা কবিদের মতো বিমূর্ত সৌন্দর্য আর ভালোবাসায় ভুলি না। তাঁরা জানি, পেট থেকে ভালোবাসা উৎসারিত হয়ে অনন্তের দিকে ধাবিত হয়। আর সে জন্যই যখন জীবনানন্দ সাদা শজনে ফুলের সৌন্দর্যের গুণগান করেছেন, তখন গেরস্তের বাড়িতে রান্না হয়েছে শজনে ফুলের বড়া, মৌরলা মাছ দিয়ে শজনে ফুলের চচ্চড়ি, শর্ষেবাটা দিয়ে শজনে ফুল, শজনে ফুলের বাটি চচ্চড়ি কিংবা পোস্ত দিয়ে শজনে ফুল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম নারীকুলে চর্চা হওয়া এসব মূর্ত কবিতাও কম কাব্যিক নয়। কথা যখন উঠলই তখন আপনাদের বঞ্চিত করা কেন? আটপৌরে একটি রন্ধনপ্রণালি দিয়ে দেওয়া যাক, শজনে ফুল বেছে ধুয়ে রাখুন। আলু ছোট ছোট করে কেটে নিন। সাদা শর্ষে বেটে নিন। সাদা শর্ষের সঙ্গে এক কোয়া রসুন দিতে পারেন, না–ও পারেন। ছোট মৌরলা মাছ বা মলা মাছ ভেজে নিন। এবার কড়াইতে কালিজিরা ফোড়ন দিয়ে আলু ভেজে নিন। মোটামুটি একটু ভাজা হলে লবণ, হলুদ, শর্ষেবাটা আর ফুলগুলো দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে খুব অল্প পানি দিয়ে কাঁচা মরিচ দিন। এরপর মাছ ভাজা দিয়ে কড়াই বা ফ্রাইপ্যান ঢেকে দিন। পানি শুকিয়ে মাখো মাখো হলে কাঁচা শর্ষের তেল দিয়ে নামিয়ে নিন। গ্যারান্টি দেওয়া যায়, ঠিকঠাক রান্না করতে পারলে শজনে ফুলের এই কবিতা হবে অনবদ্য। কবি ও সাধারণ মানুষের সৌন্দর্যবোধ এবং ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য এখানেই, একজনের ভালোবাসা বিমূর্ত, অন্যজনের ভালোবাসা বস্তুবাদের চূড়ান্ত নিদর্শন।
৩
বর্তমান বিশ্বে ‘মিরাকল ট্রি’খ্যাত শজনেগাছ বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কলা-কুমড়ো-শজনে—এই তিন উদ্ভিদ বাঙালি বাড়িতে থাকবে না, একসময় তা ছিল নিতান্তই বিস্ময়কর ব্যাপার। ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’—‘বৈচিত্র্যহীন’ শব্দটিকে প্রকাশ করতে এই প্রবাদ ব্যবহার করেছেন কখনো না কখনো। যতটা বৈচিত্র্যহীন ভাবছেন, প্রবাদটির মূল গল্প কিন্তু ততটাই বৈচিত্র্যময়। কলার থোড়, কুমড়ো বড়ি আর খাড়া অর্থাৎ শজনে এই ছিল বাঙালি তরকারির অন্যতম প্রধান উপকরণ। বাঙালির রান্নাঘরে ঘুরেফিরেই এসব রান্না করা হতো বলে প্রবাদটির উৎপত্তি। বাঙালি কিন্তু জানত এর পাতা ‘নিউট্রিশনস সুপার ফুড’। নইলে বাড়ির ভিটার কোনায় তার ঠাঁই হতো না। উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত খাবার প্যালকা। এই খাবার তৈরি হয় মূলত বিভিন্ন পদের শাক একসঙ্গে মিশিয়ে, কোনো তেল ছাড়াই (এখন অবশ্য অল্প তেল ব্যবহার করা হয়)। বিভিন্ন শাকের সঙ্গে শজনেপাতা না মেশালে বসন্তকালে প্যালকা রান্না হয় না—এটাই রীতি। দেখতে সবুজ ও লম্বা শজনেকে উত্তরবঙ্গে ঘোড়ার ঝুল বলে। এই ঘোড়ার ঝুলের সবুজ কচি পাতা দিয়ে প্যালকা রান্না করা হয়। এ ছাড়া সবুজ কচি শজনেপাতার বড়া সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। হার্বস এখনকার যুগে ব্যাপক পরিচিত শব্দ। কচি সবুজ পাতা বিভিন্ন খাবারে হার্বস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আরও কিছু খাবারের কথা বলে রাখি এই বেলা। শজনেপাতা বেটে নিয়ে, অল্প তেল, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, ধনেপাতা মাখিয়ে ভর্তা করে একবার খেয়ে দেখুন। আর যদি শুকনা শজনেপাতার গুঁড়া পান তাহলে কালিজিরা বা তিল, তিসির সঙ্গে মাখিয়ে ভর্তা করে খান। মজা পাবেন তো বটেই, সঙ্গে পুষ্টি ফ্রি।
৪
প্রচলিত বিশ্বাসে, বসন্ত রোগের মহৌষধ শজনে বসন্তকালেই হয়। কমবেশি এপ্রিল মাস পর্যন্ত এর জীবনচক্র। শজনে মূলত দুই ধরনের, একটি সবুজ রঙের লম্বা ও সরু হয়ে থাকে। এটিই আসলে শজনে। ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল/মে মাস পর্যন্ত পাওয়া যায় এটি। অন্যটি কিছুটা খয়েরি রঙের, একটু মোটা আর খাটো ধরনের হয়ে থাকে। এটিকে রায়খঞ্জন, নাজনা বা লাজনা নামে ডাকা হয় স্থানীয়ভাবে। সেটি প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়। ফুল আর পাতার কথা বলেছি আগে। এবার ফল অর্থাৎ শজনে বলে যাকে আমরা চিনি, তার কথা বলি। আমার মনে হয়, শজনের আদি খাবার কাঁচা টমেটো, কাঁটাযুক্ত গোল বেগুন, আলু এবং শজনেডাঁটা দিয়ে ঘন্ট। নিরামিষ এই রেসিপিটা জেনে রাখুন, পাঁচফোড়ন, মরিচ, তেজপাতা তেলে ভেজে নিয়ে আলু দিন। লবণ ও হলুদ দিয়ে হালকা নেড়ে নিয়ে সামান্য পানি দিয়ে ঢেকে রাখুন। আলু আধা সেদ্ধ হয়ে গেলে কেটে রাখা বেগুন, টমেটো, শজনেডাঁটা দিয়ে নেড়েচেড়ে ঢেকে রাখুন অল্পক্ষণ। তারপর কষাতে থাকুন। কষানো শেষে একটু পানি দিয়ে জিরাগুঁড়া দিন। পানি কমে গেলে নামিয়ে নিন। তবে সুস্বাদু হবে যদি আপনি পানির ব্যবহার না করেন। চাইলে এতে মৌরলা মাছের শুঁটকি ভেজেও ব্যবহার করতে পারেন। তাতে স্বাদটা ভিন্ন হবে। আসছে আমের মৌসুম। কাঁচা আম মসুর ডালে দিয়ে তাতে ছোট ছোট করে কাটা শজনে দিয়ে টকও রান্না করতে পারেন।
শজনের কথা শেষ হওয়ার নয়। তাই আজ এখানেই ক্ষান্ত দেওয়া গেল।