
বিশ্বের নীতিনির্ধারকেরা ২০৩০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়নের জন্য ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। এসব লক্ষ্যমাত্রা সারা বিশ্বের পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমতার বিভিন্ন বিষয়কে আমলে নিয়েছে। এর মধ্যে সঠিকভাবে মায়ের দুধ খাওয়ানো সব কটি লক্ষ্যমাত্রাকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করবে। এ রকম আর একটা কার্যক্রমও নেই, যা সব কটি লক্ষ্যমাত্রাকে টেকসই করতে সাহায্য করে। তাই মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোকে টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি বলা হচ্ছে। ১ থেকে ৭ আগস্ট ছিল বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মায়ের বুকের দুধ নবজাতকের জন্য আদর্শ পুষ্টিকর খাবার। এতে সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণ অনেক কমে যায়। মাতৃদুগ্ধ পানকারী শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটে পরিপূর্ণভাবে। মায়ের দুধে প্রায় ২০০ উপাদান রয়েছে, যার প্রতিটি উপাদানই শিশুর জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়, যা অন্য কোনো ফর্মুলা দুধে নেই।
এতে মায়েদের স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের ঝুঁকিও কমে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে জাতি উপকৃত হয়। মাতৃদুগ্ধ পানের মধ্য দিয়ে সন্তান ও মায়ের মধ্যে তৈরি হয় এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো হলে নবজাতক মৃত্যুর হার ২২ শতাংশ কমানো সম্ভব।
তাই আগামী ১৫ বছর, অর্থাৎ ২০৩০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়নের জন্য মায়ের দুধের উন্নয়ন, সহায়তা ও সুরক্ষা হবে অত্যন্ত জরুরি একটি কার্যক্রম। মায়ের বুকের দুধ শুধু যে শিশুমৃত্যুর হার কমায় তা নয়, বরং মায়ের স্বাস্থ্যের জন্যও তা উপকারী বটে। এ ছাড়া মায়ের বুকের দুধ দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ, ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব, সুস্বাস্থ্য ও জীবনমানের উন্নয়ন, মানসম্মত শিক্ষা, নারী-পুরুষ সমতা, বিশুদ্ধ পানি ও সুষ্ঠু পয়োনিষ্কাশন নিশ্চিত, সাশ্রয়ী ও দূষণমুক্ত পরিবেশ, বৈষম্য হ্রাস, টেকসই নগর ও জনগোষ্ঠী, স্বাভাবিক খাদ্য উৎপাদন ও গ্রহণ নিশ্চিতসহ অনেক বিষয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারীর ক্ষমতায়ন মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে।
কেন শালদুধ?
শিশুর জন্য শালদুধ অতি প্রয়োজনীয়। শিশু জন্মের পরপরই মায়ের বুকের যে হলুদ ও আঠালো দুধ নিঃসরিত হয়, সেটিই শালদুধ। জন্মের পর পাঁচ দিন পর্যন্ত এই শালদুধ নিঃসরণ হতে পারে। অজ্ঞতাবশত মায়েরা অনেক সময় শিশুকে না খাইয়ে ফেলে দেন।
l শালদুধ শিশুর জন্য প্রথম খাবার। এতে অধিক পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিন থাকে।
l প্রিটার্ম/সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের চাহিদা পূরণের জন্য এতে থাকে অধিক পরিমাণে ক্যালরি।
l বাচ্চার জন্মের পরপর জন্ডিস হওয়া থেকে এটি রক্ষা করে।
l শালদুধের ইম্যুনোগ্লোবিন শিশুর রোগ প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
l শালদুধ ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিপক্ষে শিশুর প্রথম প্রতিষেধক।
কেন মায়ের বুকের দুধ?
l মায়ের দুধ পরিষ্কার, নিরাপদ এবং শিশুর জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রায় নিঃসরিত হয়।
l ছয় মাস পর্যন্ত নবজাতকের পুষ্টিচাহিদা সম্পূর্ণরূপে পূরণ করে থাকে।
l মায়ের দুধে এমন উপাদান থাকে, যা শিশুকে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।
l সহজে হজম হয়।
l মা ও শিশুর মাঝে নিবিড় বন্ধন তৈরি করে।
l পুষ্টিহীনতা থেকে রক্ষা করে ও শিশুমৃত্যুর হার কমায়।
l মায়ের দুধ শিশুর ব্রেন ডেভেলপ করে বুদ্ধির বিকাশ ঘটায়।
কেন মা বুকের দুধ খাওয়াবেন?
l মায়ের জরায়ু স্বাভাবিক আকারে দ্রুত ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
l প্রসব-পরবর্তী রক্তপাতের আশঙ্কা কমায়।
l প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে।
l মায়ের স্তন ও জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।
l মায়ের অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে।
পরিশেষে বলা যায়, মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। তাই মায়ের দুধ খাওয়ানোকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। আনন্দের বিষয় হলো, ইতিমধ্যে এই আন্দোলন শুরু হয়েছে। সবার নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা ও শ্রম পারে মায়ের দুধের উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে; যা সমতাপূর্ণ, বৈষম্যহীন, সমৃদ্ধ, সুস্বাস্থ্য, দূষণমুক্ত পরিবেশ ও সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
অধ্যাপক এম কিউ-কে তালুকদার, শিশুবিশেষজ্ঞ, চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ