গল্প

শীতনিদ্রা

‘রাত সাড়ে এগারোটায় আমার বাসায় চলে আসবি। চমক আছে।’ ও-লেভেলে পড়ুয়া মেয়েটা এত সুন্দর করে বাংলায় খুদে বার্তা পাঠায়, পড়তেও ভালো লাগে। মেয়েটাকে তো ভালো লাগে আরও। বাংলাদেশে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি হতে পারে, মৌসুমি জলবায়ু বলে কথা। জিমির আমন্ত্রণ আমার কাছে যেন সাহারাতে হঠাৎ ঝড়। কাল ওর জন্মদিন। কত্তকিছু ঠিক করে রেখেছি দিনটার জন্য। দিনপঞ্জিকার প্রথম সপ্তাহের শীতের এই দিনটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি দুই বছর হলো। যাকে ভালো লাগে তার জন্মদিনটায় আসলেই কেমন উড়ু-উড়ু অনুভূতি তৈরি হয়। মাত্রই গতকাল একটা কালো জ্যাকেট কিনেছি অনেক দাম দিয়ে, জন্মদিনের পার্টিতে পরব বলে। কালো জ্যাকেট জিমির খুব পছন্দ।
১০টা বাজতেই গাড়িটা বের করলাম। দেরি সহ্য হচ্ছে না। শায়না, মিতু, রকি, জিকোরাও কি আজ আমন্ত্রিত? হলে হোক। আজ আমি কাউকে কিছু বলব না, জানাব না কিছুই। শুধু জিমির হাতটা ধরে জানাব মনের কথা। অনেক ভালোবাসি তোকে। কেন যে কখনো এই কথা বলা হয়নি, জানি না। তুই কি আমার মনের কথা বুঝিস? আড্ডায় মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকি তোর দিকে, দেখিস? তোর একেকটা প্রোফাইল পিকচার ভালো লাগা কমেন্টসে ভরিয়ে দিই, খুশি লাগে? সবার সঙ্গে তুই থাকলে, সেই গ্রুপ ছবি থেকে আমি দূরে সরে যাই, বুঝিস? আমার সব ছবি তোর সঙ্গে, শুধু তুই আর আমি, ভেবে দেখেছিস?
আধঘণ্টায় জিমিদের বাসায় এসে গেছি। যা আশঙ্কা করেছিলাম তা-ই। আমাদের দস্যু বাহিনী প্রায় সবাই এসে গেছে। একটু অবাক হলাম। কোনো সাজসজ্জা নেই, কেক নেই, মোমবাতি নেই, বেলুন নেই। সবই আছে হয়তো, চমক বলে কথা। কিন্তু চমক ছিল অন্য কোথাও। ‘দোস্ত, আমার জন্মদিনে তোদের কাছে একটা উপহার চাইব, দিবি?’
‘জাস্ট দুইটা ঘণ্টা আমাকে সঙ্গ দিতে হবে। একটা বছর টাকা জমিয়ে কিছু কম্বল, সোয়েটার কিনেছি। আব্বুও কন্ট্রিবিউট করেছে। আমাদের কাজ হচ্ছে শহরের রাস্তায় রাস্তায় শীতের রাতে যারা কষ্ট করছে, তাদের হাতে এসব তুলে দেব। প্লিজ, সঙ্গে থাকবি বল।’
বলে িক মেয়েটা। দাঁতে দাঁত চেপে রাজি হলাম। জিমিকে খুশি করা বলে কথা।
আমরা সাতজন এখন কমলাপুর রেলস্টেশনে। কম্বল বিতরণে সবাই প্রথমে এই জায়গাটাই বেছে নেয়। কেন, কে জানে? জিমির কড়া মানা, তবু আমি ছবি তুলছি ‘দানের’। শুধু জিমিকে মনে হচ্ছে মনমরা। চোখটা একটু ছলছলে নাকি!
যা-ই হোক, কষ্টের শেষ পর্যায়ে আমরা। কম্বল, সোয়েটার শেষ। এখন ফিরতে হবে। জিমিকে না জানিয়ে আমরা কেকটেকের ব্যবস্থা করে ফেলেছি। এবার চমক দেব আমরা। একটা মেয়ে প্যান্টটা ধরে টান দিল আচমকা। ‘ভাইজান, জারে মরতাছি। হাড্ডি কাঁপাইয়া ফেলল এই জার। এত্তু গরম কাফর দেবেন ভাইজান।’ কে যেন একটা ধাক্কা মারল আমাকে, খুব জোরে। সেই ধাক্কায় তাকিয়ে দেখি, একটা পাঁচ-ছয় বছরের শ্যামলা মেয়ে, শীতে কাঁপছে।
গায়ে একটা ছেঁড়া ফ্রক আর ময়লা চিটচিটে পাতলা চাদর। আমি ভুলে গেলাম আমার নিজের কথা, জিমিদের কথা। দামি জ্যাকেটটা খুলে পরিয়ে দিলাম মেয়েটার গায়ে। পৃথিবীতে তখন কোনো জন্মদিন নেই, নেই কোেনা পার্টি। আমি জানতাম না, আমি কাঁদতে পারি। আমি জানতাম না, কান্নার সময় আমি ভুলে যেতে পারি আমি কাঁদছি।
আমি এখন আরেকটা আমি। একটা অতি দীর্ঘ শীতনিদ্রা ছোট্ট মেয়েটি এক ধাক্কায় ভেঙে দিল!