শ্রেয়ার কাছে বিজু কেবলই বিষাদের

বিজুর আনন্দ নেই ছোট্ট শ্রেয়া চাকমার কাছে। বিজু এলেই বাবার ছবি নিয়ে বিষাদে কাটে তার সারা বেলা প্রথম আলো
বিজুর আনন্দ নেই ছোট্ট শ্রেয়া চাকমার কাছে। বিজু এলেই বাবার ছবি নিয়ে বিষাদে কাটে তার সারা বেলা  প্রথম আলো

সবাই যখন বিজুর আনন্দে মশগুল, তখন শ্রেয়া চাকমা(১১) বাড়ির একটা কোনে নীরবে চোখের পানি ফেলে। গত দুটি বিজু এমন শোকের আবরণে ঢাকা ছিল। নতুন জামা পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সমবয়সীদের সঙ্গে বিজুর আনন্দে যোগ দেওয়া হয় না ওর। এই দিনটি শ্রেয়ার পরিবারের সব সদস্যের কাছে কেবলই বিষাদের।
২০১২ সালের বিজু উৎসবের প্রথম দিন শ্রেয়া তার চোখের সামনেই বাবাকে খুন হতে দেখে। তার বাবা সুপ্রাণো চাকমা (৪২) ছিলেন জেএসএস (এমএন লারমা) পক্ষের দীঘিনালা উপজেলার সাধারণ সম্পাদক। বাবা খুন হওয়ার পর দুই বছর পার হয়েছে। তবু শ্রেয়ার চোখে ভাসে বাবার বুলেটবিদ্ধ ছবিটাই। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে দিশেহারা শ্রেয়ার পরিবার। অভাব-অনটনে এগোচ্ছে না সংসারের চাকা। এর মধ্যে বছরের একটাই উৎসবের উপলক্ষ পরিণত হয়েছে শোক পালনের দিনে।
গত শুক্রবার দীঘিনালার বড়াদমে অবস্থিত সুপ্রাণো চাকমার বাড়িতে গিয়ে বিজুর কোনো আয়োজন চোখে পড়েনি। কথা হয় তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না চাকমার সঙ্গে। কেমন আছেন জানতে চাইলে কান্না সংবরণ করতে পারলেন না। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমাদের খবর আর কে রাখে? কোনো রকমে লোকজনের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে গ্রামে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান দিয়েছি। সেখানকার আয় দিয়ে সংসার চলে না। আর বিজু এখন আমাদের কাছে কেবলই শোকের দিন।’
জ্যোৎস্না আরও বলেন, ‘লোকটি আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করছিলেন। অথচ সন্তানের সামনে তাঁকে এভাবে গুলি করে মারা হলো! এই উৎসব আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। তবু সংসারের মঙ্গল কামনায় একটু পাচন রান্না করব।’
সুপ্রাণোর বৃদ্ধ বাবা বরেন্দ্রলাল চাকমা(৮০), মা প্রীতি প্রভা চাকমা(৭৫) সন্তানের শোকে শয্যাশায়ী হয়েছেন। ছেলের মৃত্যুর পর নাওয়া-খাওয়াও ছেড়েছেন একরকম। টাকার অভাবে তাঁদের চিকিৎসাও করানো যাচ্ছে না। সুপ্রাণোর মৃত্যুর বছরই ছিল বড় ছেলে জেন্টল চাকমার এইচএসসি পরীক্ষা।
পারিবারিক বিপর্যয়ের কারণে পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়েছে তার। টাকার অভাবে আর পরীক্ষাও দেওয়া হয়নি। মেজো ছেলে মেগলিন চাকমা পড়ছে নবম শ্রেণীতে। তার পড়াশোনার খরচও জোগানো যাচ্ছে না।
ছোটখাটো ব্যবসা করতেন সুপ্রাণো চাকমা। তাঁর পরিবারের সদস্যদের দাবি, সুপ্রাণোর মৃত্যুর পর অনেকেই পাওনা টাকা ফেরত দেননি। সামনের অজানা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না চাকমার। তবু জোৎস্নার একটাই চাওয়া, বন্ধ হোক এই ভাতৃঘাতী সংঘাত।
এদিকে সুপ্রাণো চাকমা হত্যায় মামলা হলেও পুলিশ এখনো আসামিদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি বলে জানান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দীঘিনালা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. এহতেশাম।
পরিবারের সদস্যরা সুপ্রাণোর ছবি লুকিয়ে রাখেন শ্রেয়ার কাছ থেকে। বাবার ছবি দেখলেই সে অপলক তাকিয়ে থাকে। শোকের স্মৃতিটা এতটুকুন মেয়ের মনে পাথরের মতো চেপে বসেছে। শ্রেয়ার মুখেই শোনা যাক সে কথা, ‘কিছু লোক বাড়িতে এসে আমার বাবাকে গুলি করে মেরেছে। সে কথা আমি ভুলতে পারি না। আমি কাঁদব বলে মা বাবার ছবিও লুকিয়ে রাখে। আমার আনন্দ নেই, আমার কোনো বিজু নেই।’