সন্তানের সংসার ভেঙে গেলে

মতের অমিল থেকে ঝগড়া। অতঃপর তরুণ দম্পতি সিদ্ধান্ত নিলেন বিবাহবিচ্ছেদের। এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়ে মা-বাবার ওপরও। ছবি: সুমন ইউসুফ
মতের অমিল থেকে ঝগড়া। অতঃপর তরুণ দম্পতি সিদ্ধান্ত নিলেন বিবাহবিচ্ছেদের। এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়ে মা-বাবার ওপরও। ছবি: সুমন ইউসুফ

সব মা-বাবাই চান সন্তানের জীবন মসৃণ হোক। ভালো থাকুক তাঁরা। সুখী হোক তাঁদের দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন। একটি চমৎকার জীবনের স্বপ্ন নিয়ে বিয়ের মাধ্যমে দুজন নারী-পুরুষের যে পথচলা শুরু হয়, নানা কারণে সে পথচলা সম্ভব নাও হতে পারে। মৃত্যু ঘটে স্বপ্নের, ভেস্তে যায় আবেগ ও ভালোবাসার বুনোটে মিশে থাকা একটা সম্পর্ক। বিচ্ছিন্ন হন দুজন নারী-পুরুষ।
আর বিবাহবিচ্ছেদ নামের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি যখন সন্তানের জীবনে ঘটে তখন সেটিকে সহজে মেনে নেওয়া, পরের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো সব মা-বাবার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। ফলে কেন বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে বা কার দোষে এটা হলো, কতটুকু এটা ঠিক বা বেঠিক সেই আলোচনায় না গিয়ে এমন একটা ঘটনা মা-বাবার ওপর কি প্রভাব পড়ছে আর কীভাবে তাঁরা এ বিষয়টি মোকাবিলা করবেন সেটা ভাবতে হবে।
মা-বাবা সাধারণত সন্তানের বিবাহবিচ্ছেদের কারণে যেসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হন।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া
অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য, বিবাহবিচ্ছেদের মতো স্পর্শকাতর বিষয়টি সন্তানের জীবনে ঘটলে আত্মীয় ও কাছের মানুষেরা সমব্যথী না হয়ে সমালোচনা করতে থাকেন। সন্তানের জীবনে এমন একটা ঘটনা সামলাতে না সামলাতেই এর প্রথম বা সর্বোচ্চ ধাক্কাটা আসে আশপাশের মানুষদের কাছ থেকে। ব্যক্তিগত এই বিষয়টির প্রতি অন্যদের অহেতুক ও অনাবশ্যক কৌতূহল মা-বাবার মধ্যে একটি বিব্রত ও অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি করতে পারে। এর ফলে এই মা-বাবার মধ্যে কিছু প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। যেমন: সামাজিক মেলামেশা বা যোগাযোগ কমিয়ে ফেলতে পারে; মনের মধ্যে কুণ্ঠাভাব তৈরি হতে পারে; সন্তানদের প্রতি অযথা চাপ তৈরি ও দোষারোপ করার প্রবণতা; অন্যদের সঙ্গে আচরণে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠা; বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হওয়া ও বাবা-মা হিসেবে নিজেদের ব্যর্থ মনে হওয়া।

সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক
 সন্তান যখন বিচ্ছেদের মতো একটি সিদ্ধান্তে এগিয়ে যায় তখন অনেক ক্ষেত্রেই মা-বাবারা সঠিক দিকনির্দেশনার পরিবর্তে অহেতুক চাপ তৈরি করেন। বিশেষ করে সন্তান যদি মেয়ে হয় তবে তাঁর দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় থাকলেও ‘মানিয়ে’ নেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করেন। আবার এ ক্ষেত্রে চলে নানা ধরনের ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল’ যেমন-কান্নাকাটি করা, নিজেদের বয়সের অজুহাত দেওয়া ইত্যাদি। নানা রকম হুমকি বা নেতিবাচক মন্তব্যও করতে দেখা যায়।
 আবার অনেক মা-বাবা বিষয়টা নিয়ে একেবারেই কথা বলেন না। সন্তানের দাম্পত্য জীবনে কোনো সমস্যা থাকলে সেটার সমাধানে না গিয়ে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নিজেদের একেবারেই বিচ্ছিন্ন রাখেন।
 বিবাহবিচ্ছেদের চাপ অনেক ক্ষেত্রে সামাল দিতে না পেরে সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবারা তির্যক ও নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তাঁদের হেয়প্রতিপন্ন করা, এককভাবে দায়ী করা আমাদের সমাজে দেখা যায়।
 এ ছাড়াও বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া সন্তানদের কিছুটা বিচ্ছিন্ন করে রাখেন মা-বাবা।
 অনেকে বিচ্ছেদ হওয়ার পরপরই সন্তানকে আবার বিয়ের জন্য সার্বক্ষণিক চাপ দিয়ে থাকেন। তা ছাড়া সন্তানের সাবেক স্ত্রী বা স্বামীর বিরুদ্ধে নানা রকম নেতিবাচক মন্তব্য, সমালোচনা করা ইত্যাদিও দেখা যায়।

চিন্তা কোরো না, বাবা তোমার পাশে আছে

মা-বাবা কেমন ভূমিকা রাখতে পারেন?
বিবাহের মতো বিবাহবিচ্ছেদও কারো কারো জীবনের অল্প কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি, যার প্রভাব সারা জীবন বহন করতে হয়। বিচ্ছেদের আগে একধরনের আবেগের প্রাবল্য কাজ করে বলে অনেক সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক যুক্তি আবার কাজ নাও করতে পারে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে আপনার সঠিক ভূমিকা নির্ধারিণ করতে পারে অনেক কিছুই।
 বিচ্ছেদের বিষয়ে আপনার মতামত গঠনে সন্তানের অবস্থান থেকে বিষয়টি বিবেচনা করুন এবং সবকিছু বাদ দিয়ে সন্তানের মানসিকভাবে ভালো থাকার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিন।
কোনো অবস্থাতেই সরাসরি মতামত চাপিয়ে দেবেন না বা জোর করবেন না।
 সিদ্ধান্তটি সঠিক কি ভুল—এভাবে সরাসরি না বলে এ ধরনের সিদ্ধান্তের ভালো-মন্দ দিকগুলো সন্তানের সামনে নিয়ে আসুন। তার বর্তমান দাম্পত্য জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে কথা বলুন, আপনার সন্তানের জীবনসঙ্গীর ভালো দিকগুলো আলোচনা করুন।
 আলোচনার সময় বিবাহবিচ্ছেদের পরবর্তী অবস্থা তুলে ধরুন এবং এগুলো তিনি কতখানি সামাল দিতে পারবেন, সে ব্যাপারে কথা বলুন। যেমন বিচ্ছেদ-পরবর্তী সামাজিক চাপ, নিঃসঙ্গতা এবং জীবনের ছোটখাটো নানা চ্যালেঞ্জ সম্পূর্ণ একা মোকাবিলা করার মনোবল, বিচ্ছেদ-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা, সন্তান থাকলে সন্তানবিষয়ক জটিলতা ইত্যাদি।
 যেহেতু বিচ্ছেদ একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, সে জন্য তাড়াহুড়া না করে সিদ্ধান্ত নিতে যথেষ্ট সময় নিতে বলুন।
 যে কারণে বিবাহবিচ্ছেদ নিতে চাচ্ছে সেটা কোনোভাবে সমাধানযোগ্য কি না, সেটা সন্তান ও তাঁর জীবনসঙ্গী দুজনের সঙ্গেই কথা বলুন।
 সিদ্ধান্ত কোনো কারণে সন্তানের জীবনসঙ্গীর প্রতি অবিচার বা অনৈতিক মনে হলে সরাসরি বলুন।
 সবদিক বিবেচনায় বিবাহবিচ্ছেদ সিদ্ধান্তটি সন্তানের জন্য সঠিক মনে হলে তাঁর পাশে থাকুন।

সামাজিক চাপ মোকাবিলা
 আশপাশের মানুষের অহেতুক সমালোচনা, কৌতূহল যথাসম্ভব উপেক্ষা করুন।
 নেতিবাচক মন্তব্যে প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ করা, সন্তানদের বিবাহবিচ্ছেদ সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন।
 দৃঢ়তার সঙ্গে সামাজিক চাপ মোকাবিলা করুন। মনে রাখবেন, সন্তানের বিচ্ছেদ নিয়ে আপনার আচরণের কুণ্ঠাবোধ পরোক্ষভাবে অন্যদের উৎসাহ বাড়িয়ে দেবেন।
 আপনার নিজস্ব সামাজিক মেলামেশা, নিজের প্রতি যত্ন যতটা সম্ভব বজায় রাখুন।
জীবনের একটি অদ্ভুত বাস্তবতা হলো জীবনকে আমরা যেভাবে নিজের ক্ষেত্রে বা প্রিয়জনের ক্ষেত্রে খাপে খাপ মিলিয়ে আমাদের স্বপ্ন ও ইচ্ছা অনুযায়ী দেখতে চাই। নানা কারণেই সেভাবে সম্ভব নাও হতে পারে। বিবাহবিচ্ছেদ হয়তো আপনার সন্তান ও পরিবারের সাময়িক ছন্দপতন। তবে সবারই মনে রাখা প্রয়োজন এটি চলমান জীবনের একটা ‘ঘটনামাত্র’ যার আকস্মিক তীব্রতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে অবশ্যই ফিকে হবে এবং জীবন ফিরে আসবে স্বাভাবিক ছন্দে আরও নানামুখী সম্ভাবনা নিয়ে।

সন্তানের বিবাহবিচ্ছেদের পর কী করবেন
বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত ‘সঠিক’ বা ‘বেঠিক’ যাই হোক না কেন এটা যে কারোর জন্যই অত্যন্ত সংকটপূর্ণ ও শূন্যতার একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আপনার মনের রাগ, জেদ, তর্ক, অভিমান না পুষে সন্তানের পাশে শর্তহীন ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়ান।
 কোনোরকম সমালোচনা বা বিরূপ মন্তব্য করবেন না।
 সামাজিক মেলামেশা থেকে সন্তানকে বিচ্ছিন্ন রাখবেন না।
 সন্তানের সঙ্গে গুণগত সময় কাটান, তাঁর মনের আবেগ প্রকাশে সাহায্য করুন।
 জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করুন।
 লেখক: মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
এই প্রতিবেদনে মডেল হয়েছেন: সুষ্মি, রেহান ও আশীষ কুমার চক্রবর্তী