আইন অধিকার

সন্তান আটকের অভিযোগ!

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হলে অনেক সময় তাঁদের সন্তান কার কাছে থাকবে—এ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। কোনো কোনো সময় এ বিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অনেক বাবা-মা তাঁদের সন্তানকে কাছে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন আদালতের কাছে। প্রায় সময়ই দেখা যায় সন্তানকে আটক রেখেছে মর্মে সন্তান উদ্ধারের জন্য তল্লাশি পরোয়ানার মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। আবার অনেকে অপহরণের অভিযোগও উত্থাপন করে। কিন্তু সন্তান আটকের অভিযোগ কি আনা যায় এবং আনলেও এর কতটা ভিত্তি রয়েছে?

আইন কী বলে

কোনো মা বা বাবা যদি পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্তান আটকের অভিযোগ করেন, তাহলে শুনতে খটকা লাগলেও আইনে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০০ ধারায় সন্তান আটকের অভিযোগ আনতে দেখা যায়। সাধারণত পারিবারিক আদালতে সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্বের মামলা করতে হয়। কিন্তু এ মামলা নিষ্পত্তিতে সময় লাগে বলে অনেকেই ১০০ ধারায় দরখাস্ত করে থাকেন। তবে এ ধারার মূল বক্তব্যের সঙ্গে সন্তান আটক রাখার অভিযোগের বিষয়টি অনেকটাই অসামঞ্জস্য।

অনেকে আবার পারিবারিক আদালতেও যান এবং একই সঙ্গে ১০০ ধারায়ও মামলা করতে দেখা যায়। ফৌজদারি কার্যবিধির ১০০ ধারায় বলা আছে, কেউ যদি কোনো ব্যক্তিকে বেআইনিভাবে আটক রাখেন তাহলে যিনি বা যাঁরা আটক রেখেছেন নিশ্চিত জানা যাবে, তাঁর বিরুদ্ধে এই তল্লাশি পরোয়ানার মামলা করা যাবে। সাধারণত বেআইনি আটক ব্যক্তির উদ্ধারের জন্য এ বিধান আছে। এ মামলা করতে হয় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।

সন্তান আটকের অভিযোগ যদি এ ধারায় আনা হয়, তখন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বিষয়টি ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। যদিও এ অভিযোগ আনতে হলে প্রমাণ করতে হবে যে সন্তানকে আসলেই বেআইনিভাবে আটক রাখা হয়েছে। অন্যথায় এ ধারায় আবেদন চলবে না। সন্তান ফেরত পেতে ও হেফাজতে রাখতে উপযুক্ত ফোরাম হচ্ছে পারিবারিক আদালত। পারিবারিক আদালতই তখন আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেবেন সন্তান কার কাছে থাকবে। পারিবারিক আদালত সন্তানের সুস্থ, স্বাভাবিক বিকাশের দিকটি বিবেচনা করে বাবা বা মা যে কারও কাছে রাখার জন্য আদেশ দিতে পারেন। আবার বাবা-মা পর্যায়ক্রমে সন্তানকে কাছে রাখা কিংবা একজনের কাছে থাকলে অন্যজনকে দেখা করার অনুমতিও প্রদান করে থাকেন। পারিবারিক আদালতে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সন্তানকে কাছে রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। সন্তান আটকের অভিযোগের মামলা প্রসঙ্গে ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদ এলাহী বলেন, ‘আমাদের কাছে এ ধরনের অভিযোগ প্রায়ই করতে দেখা যায়। আমরা প্রথমে খুব সূক্ষ্মভাবে আবেদনকারীর জবানবন্দি নিয়ে তা যাচাই-বাছাই করি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিই। আর অভিযোগের বিষয়ে যদি কিছুটা বিশ্বাস করার কারণ থাকে, তখন যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর ওপর নোটিশ জারি করি। তাঁরও বক্তব্য শুনে তারপরই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। সাধারণত অপহরণের অভিযোগের বিষয়টি অনেকÿক্ষেত্রেই দেখা যায় সন্তানকে নিয়ে আদালতে হাজির হয়ে নিজেরাই মীমাংসা করে নেয়।’

অযথাই সন্তান আটক রাখার মতো মিথ্যা অভিযোগ না এনে পারিবারিক আদালতের আশ্রয় নেওয়াই উচিত। বাবা-মা উভয়কে মনে রাখা উচিত নিজেদের মধ্যে বিচ্ছেদ হলে তাঁরা পরস্পর স্বামী-স্ত্রী না থাকতে পারেন, তাঁরা কিন্তু বাবা-মা হিসেবে ঠিকই রয়ে যান। নিজেদের রেষারেষি আর জেদের কারণে সন্তান মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সন্তান নিয়ে আদালতে যুদ্ধ না করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ঠিক করে নেওয়া ভালো। সন্তান ভালো থাকুক—এটাই তো আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট