সংস্কৃতি সংবাদ

সমাজের সঙ্গে নারীর সংলাপ

বিস্তার আর্ট কমপ্লে​েক্স আয়োজিত শিল্পী মেহেরুন সুমির চিত্র প্রদর্শনী দেখছেন দর্শনার্থীরা l প্রথম আলো
বিস্তার আর্ট কমপ্লে​েক্স আয়োজিত শিল্পী মেহেরুন সুমির চিত্র প্রদর্শনী দেখছেন দর্শনার্থীরা l প্রথম আলো

একটি বিকট দর্শন সরীসৃপের বিশাল হাঁ–র ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে একজোড়া পা। এক পা ভাঁজ করা, অন্য পা আরামে এলিয়ে আছে। জন্তুর মুখটি গাঢ় কমলা বর্ণের হলেও নারীর পা জোড়া সাদা-কালো। শিল্পী মেহেরুন সুমি সমকালের চোখে নারীর সংহারের যে ছবি এঁকেছেন তাতে বিজ্ঞাপনের চাকচিক্য আছে। যে চাকচিক্য বা দ্যুতির আড়ালে হারিয়ে যায় নারীর যন্ত্রণা।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিস্তার আর্ট কমপ্লেক্সে শেষ হওয়া সুমির প্রথম একক শিল্পকর্মের প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল চিত্রকর্মটি। আত্মকথোপকথন শিরোনামে আট দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া প্রায় সব শিল্পকর্মেই নারীর ভেতর ও বাইরের সত্তার সঙ্গে বোঝাপড়া দেখা গেছে। সেদিক থেকে প্রদর্শনীর নামটি অনায়াসেই হতে পারত সমাজের সঙ্গে নারীর সংলাপ।
বিস্তারের দুটি কক্ষজুড়ে হওয়া এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে একটি স্থাপনাকর্ম, ১০টি ড্রয়িং ও ১৪টি পেইন্টিং। প্রদর্শনীতে বেশ কিছু সিরিজ কাজ করেছেন শিল্পী। গ্যালারির প্রথম কক্ষে স্থান পেয়েছে সেলফ কনভারসেশন সিরিজের বেশ কয়েকটি ছবি। শিল্পী যার বাংলা নামকরণ করেছেন আত্মকথোপকথন। পাশাপাশি ড্রপ বা ফোঁটা, ইচ্ছে, সরল গল্প ও দৈনন্দিন জীবন শিরোনামে আরও কয়েকটি সিরিজ ছবি স্থান পেয়েছে।

প্রদর্শনীতে স্থান প​াওয়া একটি চিত্রকর্ম


এই সিরিজের চিত্রকর্মগুলোতে শক্তিশালী ড্রয়িং, স্থানের ব্যবহার ও পরিমিতিবোধ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শক। চিত্রকর্মে মাতৃগর্ভ, গর্ভস্থ শিশু, জননেন্দ্রিয়ের প্রতীক ব্যবহার করে নারীর সত্তার সঙ্গে দর্শকের সংযোগ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। রংতুলির পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়েছে সুই-সুতাও। যন্ত্রণা ও ব্যবচ্ছেদের উপকরণ হিসেবে ক্যানভাসে স্থান পেয়েছে ব্লেড।
বেশ কয়েকটি ক্যানভাস জোড়া দেওয়া হয়েছে মোটা কালো সুতো দিয়ে। বোতামঘরের মতো গোল কালো গর্তের ভেতর দিয়ে টানটান হয়ে থাকা সমান্তরাল সুতার সঙ্গে আবার আড়াআড়ি করেও সুতা বেঁধে দিয়েছেন তিনি। দেখে মনে হয়েছে দেহের ওপর বড় কোনো ক্ষতের সেলাই বুঝি খুলে যেতে চাইছে। আর এই যন্ত্রণা ও না–বলা কথার ঘোরটোপ সুমির প্রায় সব ছবিতেই উপস্থিত।
‘সেলফ কনভারসেশন অব রিপিটিং’ শিরোনামে স্থাপনাকর্মটির পুরোটা জুড়েই আছে সূচিকর্ম। ফ্রেমবন্দী সেলাইয়ের বৃত্তে ফুল নয় রয়েছে স্টেনগান। যুদ্ধ আর হিংসার কবলে পড়া সাম্প্রতিক দুনিয়ার ছবিই যেন দেখা গেল।
বলিষ্ঠ রেখা, উজ্জ্বল রং ও স্থানের ব্যবহারে দক্ষতা দেখিয়েছেন সুমি। অনেক ক্যানভাসকে দিয়েছেন ছাপচিত্রের চেহারা। দৈনন্দিন জীবন শিরোনামে সিরিজ চিত্র যেন কবিতার অনুবাদ। এর একটির বিবরণ তুলে ধরা যাক। হলদে-সবুজ পটভূমিতে লাল জামা পরা এক নারী বসে আছে হাঁটু গেড়ে। লাল চিত্রিত ফ্রকের প্রান্ত ছড়ানো মেঝেতে। নারীর মাথা অদৃশ্য পেছনের একজোড়া ডানার খাঁজে। এই ডানায় ভর করেই কী সুমির নারীরা আরও বহুদিন নিজেদের স্বপ্ন-বাস্তবতার কথা বলে যাবে? প্রদর্শনীস্থল ছেড়ে এসেও এমন প্রশ্নে মুখোমুখি হতে হয় দর্শককে।