
আফসার সাহেব বাসায় ঢুকলেন রাত সাড়ে দশটায়। হাতের ব্যাগে তাজা কই মাছ। লাফালাফি করছে। তিনি মনে মনে ভীষণ আনন্দিত। ঢাকা শহরে তাজা দেশি কই মাছ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তাঁর সেই ভাগ্য আজ হয়েছে। দেশি কই বাছার জন্য চোখ থাকা লাগে। তাঁর সেই চোখ আছে। বাজারে গিয়ে মাছ কেনা একটা শিল্প। তিনি সেই শিল্পের ওস্তাদ শিল্পী।
ওস্তাদ শিল্পী ঘরে ঢুকলেন।
ঘরে ঢুকে তিনি স্ত্রী সালেহাকে ডাক দিলেন, ‘সালেহা, দেখে যাও বাজার থেকে কী নিয়ে আসলাম।’
অপরূপ শিল্পকর্ম দুজন মিলে দেখা যায় না। লোকজন আরেকটু বেশি থাকলে ভালো হয়। তিনি তাঁর যমজ কন্যাদের ডাক দিলেন, ‘নীলু-নীতু, তোমরা কে কোথায় আছ। আজকে তোমাদের পড়ালেখা বন্ধ। সবাই মিলে কই মাছ খাওয়া হবে। বিশেষ মেন্যু রান্না হবে, কই মাছের হর-গৌরী।’
তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, সালেহা গম্ভীর মুখে এগিয়ে এলেন। অন্যদিন বাসায় আসামাত্র বাচ্চারা ছুটে আসে। আজ তাদের দেখা যাচ্ছে না।
তিনি সালেহাকে বললেন, ‘দেখো, একদম দেশি কই মাছ। আজকের প্রথম আলোতে দেখেছি, দেশি কই মাছের রান্না করতে হয় “হর-গৌরী” প্রক্রিয়ায়।’
এই বলে তিনি কই মাছের ‘হর-গৌরী’ কীভাবে রান্না করতে হয়, সে বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন, ‘বুঝলা, মসলা মাখায়া কই মাছ ভালো করে ভাজতে হবে। সেই মাছের এক পিঠ ভাজতে হবে তেঁতুলের টকে। অন্য পিঠ ভাজতে হবে চিনির সিরায়। খবরদার, মাছ ওল্টানো যাবে না। এই রান্নায় একই কই মাছ একবার মিষ্টি লাগে, একবার টক লাগে। এই একটা ম্যাজিক তোমার হাতে ভালোই হবে মনে হচ্ছে।’
বিশাল বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর আফসার সাহেব বুঝতে পারলেন কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। তাঁর কন্যাদের এখনো দেখা যাচ্ছে না। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নীলু-নীতু কই?’
সালেহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলেন, ‘আজ তাদের জন্মদিন। তারা দরজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করছে।’
আফসার সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মন অসম্ভব খারাপ হলো। মধ্যবিত্তের এই এক অসুবিধা। অফিসের বড় বড় সাহেবদের ছোট ছোট কাজ করতে করতে নিজের ঘরের বড় আনন্দগুলো চাপা পড়ে যায়।
২.
তিনি নীলু-নীতুর ঘরে ঢুকলেন। দুই মেয়ে মন খারাপ করে বসে আছে। দেয়ালে এদের সূচিশিল্প ঝুলছে। নতুন নতুন এরা সেলাই শিখেছে। তিনি তাকিয়ে দেখলেন দেয়ালে একটা লাল সুতা দিয়ে তাজমহল আঁকা। তার পাশাপাশি আরেকটা তাজমহল নীল সুতার কাজ করা।
লাল তাজমহলের নিচে লেখা ‘মা’। নীল তাজমহলের নিচে লেখা ‘বাবা’।
তিনি এদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মাগো, আমি খুবই লজ্জিত। জুন মাস। কাজের চাপে আমি একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’
দুই মেয়েই একসঙ্গে তাঁর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
তিনি হালকা করে বললেন, ‘মাগো, এর শাস্তি তো আমার হতেই হবে। তোমারা একটু বসো। আমি আসতেছি।’
তিনি পাঞ্জাবি গায়ে গলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
৩.
তানজীর ফটোগ্রাফির আলোকচিত্রী তানজীর বসে আছে আফসার সাহেবের বসার ঘরে। আফসার সাহেব রাত সাড়ে এগারোটায় তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে এসেছেন। হাতে বিশাল ক্যামেরা। আলোকচিত্রীর চোখ ঘুম-ঘুম।
আফসার সাহেব গভীর মমতায় তাঁর পুরো পরিবারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘মাগো, এটা আমাদের চারজনের একসঙ্গে তোলা প্রথম ছবি। তোমাদের বিয়ের পর যেখানেই যাও নিজেদের বাসায় এই ছবি একটা করে রেখো। তোমাদের জন্মদিনে এইটাই আমার উপহার।’
আফসার সাহেবের কথা শুনে তানজীর থমকে গেল। ক্যামেরায় চোখ রেখেই তার মনে হলো আগের সব ছবি বৃথা। এই জীবনে তার তোলা হাজার বিশেক ছবির সবগুলোই বৃথা। তার নিজের পরিবারের সবার সঙ্গে এই রকম একটা সামান্য ছবি নাই। লেন্সের পেছনে তানজীরের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ঝাপসা লেন্সে ছবি তোলা কষ্টকর। কিন্তু মনে হচ্ছে ঝাপসা চোখ দিয়ে ছবি তোলা স্বর্গীয়।
আলোকচিত্রী তানজীর, খুব সম্ভব তার জীবনের সেরা ছবিটি তুলল এবং তুলে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
আফসার সাহেব দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ছেলে, কী সর্বনাশ! কাঁদছ কেন?’
তানজীর কেঁদেই চলছে। তানজীরের খুব জানতে ইচ্ছা করছে সে কীভাবে দশ বছর পেছনে ফিরে যাবে? কীভাবে সে তার বাবাকে নিয়ে আসবে? কীভাবে এই রকম একটা সামান্য ছবি তুলতে পারবে?
অতি সামান্য একটা ছবি।
হ্যাসেল্ট, বেলজিয়াম