গলায় মিষ্টি সুর ছাড়া কিছুই নেই তাঁর। এমনকি ভিটেমাটিও। যা নেই তা নিয়ে পিছুটানও নেই। যে সুর আছে, তা-ই সাধেন। মানুষকে সুরে ভাসাতে পারেন, হাসাতে পারেন, কাঁদাতে পারেন। পাখির মতোই মনের সুখে শুধু গানই করেন। প্রতিদানের আশা করেন না। এই শিল্পীর নাম রেজাউল করিম (৪৫)।
পাখির গানের যেমন কেউ কোনো মূল্যায়ন করে না, রেজাউল করিমের গানেরও এত দিন কোনো মূল্যায়ন হয়নি।
রেজাউল করিমের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার দিঘা গ্রামে। ১৩ বছর বয়সে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বাবা-মাকে হারান। ওই বয়সে ছোট চার ভাই বোনের অভিভাবক হয়ে ওঠেন তিনি। বাবা আয়েজউদ্দিন ছিলেন যাত্রার অভিনেতা। তাঁর গলায় ছিল অসাধারণ সুর। মা মমতাজ বেগমের গলাতেও ছিল সুর। মায়ের কোলে বসে শিশু রেজাউলের বাবার কাছে গানের হাতেখড়ি হয়। কিন্তু সেই সুন্দর শুরুটা আর পরিণতি পায়নি।
যাত্রার নায়ক-বাবা বড় বিলাসী জীবনযাপন করতেন। কোনো সঞ্চয় ছিল না তাঁর। ফলে পথে বসে যান রেজাউল। ছোট চার ভাইবোনের হাত ধরে পথে পথে মানুষ হয়েছেন। কিন্তু সুরের সন্ধান যেখানেই পেয়েছেন, ছুটে গেছেন। গলায় তুলে নিয়েছেন। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে যাত্রাপালায় শিশুশিল্পীর অভিনয় শুরু করেন। বড় হয়ে অভিনয় ছেড়ে দিয়ে যাত্রায় যন্ত্রসংগীত বাজিয়েছেন। যাত্রাপালার দুর্দিন পড়ে গেলে রেজাউল করিম রিকশা চালাতে শুরু করেন। রাজশাহী শহরে রিকশা চালানোর সময় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তাঁকে তাদের সংগীত প্রশিক্ষক হিসেবে কাজে নেয়, কিন্তু পরে তাঁকে দিয়ে পিয়নের কাজ করানো হয়। একপর্যায়ে অভিমান করে ২০১১ সালের মার্চ মাসের দিকে রাজশাহী থেকে ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালাতে শুরু করেন তিনি। রিকশা চালানোর সময় গুন গুন করে গান করেন তিনি। এই গুন গুন শুনে এক যাত্রী একদিন মাছরাঙা টেলিভিশনে ধরে নিয়ে যান তাঁকে। কর্তৃপক্ষ এক ঘণ্টার একটি গানের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করে। সেখানে এক চলচ্চিত্র নির্মাতার সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি রেজাউল করিমকে নিয়মিত টেলিভিশন শিল্পী করে দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যান। তারপর তাঁর সেটে ফুটফরমায়েশের কাজে লাগান। একসময় তিনি বুঝতে পারেন, তাঁকে শুধুই খাটানো হচ্ছে। কয়েক মাস পরে তিনি ঢাকা থেকে চলে আসেন।
বাড়ি ফিরে রেজাউল একেবারে বেকার হয়ে পড়েন। সম্প্রতি একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় তাঁর স্ত্রী ছাপিয়া বেগমকে একটি গাভি দেওয়া হয়েছে। এখন রেজাউল করিম সেই গাভির ঘাস কাটেন। দুধ বিক্রি করে প্রতিদিন ১২০ টাকা পান। এটিই সংসারের আয়ের প্রধান উত্স।
রেজাউল করিমের একমাত্র ছেলে সাগর ও মেয়ে রোকসানারও রয়েছে বাবার মতোই গানের গলা। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই গলা সাধেন। ছেলে সাগর দশম শ্রেণিতে পড়ে। সংসারের অনটনের কারণে মেয়েটিকে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানেও মেয়ের সুখ হয়নি। সে এখন ঢাকায় তৈরি পোশাক কারখানার কাজ করেন।
রেজাউল করিম বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ বেতারের শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন। সেখান থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। সম্প্রতি রাজশাহী বেতারে তাঁর জন্য বিশেষ অডিশনের আয়োজন করা হয়। রেজাউলের গান শুনে বিচারকেরা মুগ্ধ। তাঁরা বিস্মিত—এত দিন তাঁকে কেন শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বেতারের নজরুলসংগীতশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে নেওয়া হয়।
এখনো রেজাউল করিম মাঠে ঘাস কাটেন আর গান করেন। এই দৃশ্য দেখে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজ গত রোজার ঈদে ‘আনসাং স্টার’ অনুষ্ঠানে তার কয়েকটি গান প্রচার করে। অনুষ্ঠানে তাঁকে ‘স্টার অব দ্য স্টারস’ ঘোষণা করা হয়।
এমন জাত শিল্পী রেজাউল করিমের হারমোনিয়াম-তবলা কিছুই নেই। প্রতিবেশীর একটি হারমোনিয়াম চেয়ে নিয়ে রেওয়াজ করেন। তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁকে একজোড়া তবলা উপহার দেন। কিন্তু তবলা নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন প্রতিবেশী তাঁর হারমোনিয়ামটা নিয়ে গেছেন। তারপরেও এগিয়ে চলেছেন রেজাউল করিম।