
সৈয়দ শামসুল হক ফোন রিসিভ করেন না। কাজেই প্রথম আলোর মুনির হাসান আমাকে সৈয়দ শামসুল হকের ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হকের ফোন নম্বর দিলেন।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬। ঢাকা। দুপুর। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।
আমার মনে পড়ছে হক ভাইয়ের লেখা ‘বুনোবৃষ্টির গান’ কবিতাটি। এটি সম্ভবত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা।
‘বৃষ্টি এসে ভেজায় কখন নাগেশ্বরীর মাঠ।’
তাঁর ‘কবিতাসমগ্র’ বইটা আমার কাছে ছিল। ওই বইটায় উৎসর্গপত্রটাও বারবার মনে পড়ছে।
‘নদীর ওপারে, মঞ্জু, পাখিদের গ্রাম।’
মঞ্জু—আমাদের ভাবি, আনোয়ারা সৈয়দ হকের ডাকনাম।
গাড়িতে চলেছি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। পরের দিন ঈদ আমাদের এই শহরে। হক ভাই ‘বুনোবৃষ্টির গান’ কবিতায় লিখেছেন,
‘ইচ্ছা আসে মেঘের মতো অন্ধ সীমানায়
একলা এক জানালা খোলা বাংলাবাড়ির ঘর:
একলা এই রংগপুরে হঠাৎ কি যে হয়!
পাবো না জানি তোমাকে পেলে হৃদয় দেয়া যায়;
বৃষ্টি এসে ভেজায় আবার সেই দুরাশার মাঠ।’
আমাদের শহর রংপুর থেকে, হক ভাই তাঁর কুড়িগ্রাম থেকে, নাগেশ্বরী থেকে কিংবা তাঁরই রচিত জলেশ্বরী থেকে দূরে এই ঢাকা শহরেই আছেন। গুলশানের একটা পাঁচতারা হাসপাতালে। লন্ডন থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে এসেছেন নিজের দেশে, আপন মানুষদের মধ্যখানে। যেখানে জানালা দিয়ে দেখা যায় বাংলার আকাশ, বৃষ্টি, ঘাস, লেকের জলে মৃদু কম্পন।
আমি জানি, হক ভাইয়ের সঙ্গে দর্শনার্থীদের দেখা করার ব্যাপারে ডাক্তারের বারণ আছে। ক্যানসারের রোগী তিনি। কেমো নিয়ে ফিরেছেন। এই সময় শরীরটা নাজুক থাকে। যত কম লোকে তাঁর কাছে যাবে, ততই তাঁর মঙ্গল।
কিন্তু আমার যদি ফোন করতে হয়, আমি দ্বিতীয় হককে করব না, প্রথম হককেই করব।
লন্ডনের হাসপাতালে তিনি যখন, তখনও আমি তো তাঁকেই ফোন করেছি। এবং তিনি ফোন রিসিভ করেছেন। আমাদের কথা হয়েছে। আমি তাঁর কাছে ১৫ আগস্ট সংখ্যা প্রথম আলোর জন্য কবিতা চেয়েছি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন এবং আমার ই-মেইলে পাঠিয়েছেন।
এরপর একটা শব্দ নিয়ে তিনি তিনবার খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন। শব্দটা বদলাতে হবে। তাতে ছন্দটা ঠিক থাকে। অর্থটা পরিষ্কার হয়।
আমি বলেছি, ‘হক ভাই, আপনার কাছে আমাদের শিখবার আছে। আপনি লন্ডন থেকে, কর্কটাক্রান্ত শরীর নিয়ে, কবিতার একটা শব্দ নিয়ে, তরুণতম কবিটির মতো, ভীরুতম প্রথম প্রেমিকের মতো থরথর করে কাঁপছেন।’ তিনি আমাকে উপদেশ দিয়েছেন খুদে বার্তার মাধ্যমে। বলেছেন, ‘আনিস, আমি এবং তুমি, আমরা লেখক, আমাদের দায়িত্ব হলো ভালোবাসা দিয়ে লেখা। লেখার জন্য এই ভালোবাসাটুকু ধরে রেখো। আমাদের মধ্যে কতজনই তা ধরে রাখতে পারে না।’
আমি গাড়িতে বসেই ফোন করলাম সৈয়দ শামসুল হককে। রিং হচ্ছে। রিং হচ্ছে। অবশেষে ধরলেন, ‘আনিস...’
‘হক ভাই। কেমন আছেন?’
‘ভালো। সামনে ডাক্তার এসেছেন। একটু পরে কথা বলি?’
‘হক ভাই। দেখা করা যাবে?’
‘যাবে। এসো।’
আমি গাড়ি সোজা নিয়ে এলাম বাড়িতে। গোসল করলাম। কাপড় বদলালাম। যেন কোনো জীবাণু না থাকে শরীরে। হক ভাইয়ের একটা স্কেচ করেছি, সেপ্টেম্বরের শুরুতে, তিনি যেদিন ঢাকা ফিরছেন লন্ডন থেকে, নাসির উদ্দীন ইউসুফের মাধ্যমে সেই খবর জানার পরই। সেটা একটা ফ্রেমে ভরে নিয়ে চললাম হক ভাইয়ের হাসপাতাল কক্ষে।
মুখে মাস্ক পরে নিতে হলো। রুমে ঢোকার পর দেখি দ্বিতীয় হক, আনোয়ারা ভাবি আর হক ভাই। অন্যপ্রকাশের মাজহার আর নাসের ছিলেন, বেরিয়ে গেলেন।
ভাবি বললেন, ‘হাতটা পরিষ্কার করে নাও।’
স্যানিটাইজার দিয়ে হাত মুছে নিলাম।
হক ভাই হাত বাড়িয়ে দিলেন। ‘কাছে এসো আনিস।’
আমি গিয়ে তাঁর হাত ধরলাম।
তিনি আবৃত্তি করলেন একটা শায়েরি থেকে, অশ্রুপাত করতে হয় না। আমাদের দিন ভালো গেছে, আরও ভালো যাবে, আজকের এই দিন নিয়ে যেন আমরা দুঃখ না করি।
আমি রেকর্ডার অন করিনি, তাই শায়েরিটা হুবহু শোনাতে পারলাম না।
দ্বিতীয় হকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আমি আমার আঁকা স্কেচটা তাঁর হাতে দিলাম। তাতে তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিও তুলিতে এঁকে রেখেছি, ‘মানুষ এমন তয় একবার পাইবার পর, নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর’, ‘এ বড় দারুণ বাজি তারে কই বড় বাজিকর, যে তার রুমাল নাড়ে পরাণের গহীন ভিতর।’ আর তাঁর সেই অমর আহ্বান, ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়।’ তিনি নিজেই সশব্দে সেই লাইনগুলো পাঠ করলেন।
আনোয়ারা ভাবি ছবি তুললেন তাঁর মোবাইলে। বললেন, ‘মুখের মাস্কটা দুজনেই খানিকক্ষণ সরিয়ে রাখো।’
রাখলাম।
ভাবি বললেন, ‘এই ছবি এখন প্রকাশ কোরো না। তিনি যখন থাকবেন না, তখন কোরো। তাঁর দুর্বল শরীরের ছবি তিনি প্রকাশ করতে চান না।’
আমি বললাম, ‘আরে কী বলেন, হক ভাই থাকবেন। কে কখন যাবে, কে বলতে পারে। আমরা যাওয়ার পরেও হক ভাই থেকে যাবেন।’
ভাবি বললেন, ‘না, তিনি তা চান না। তোমরা অনেক দিন থাকো, তিনি তা-ই চান।’
হক ভাই বললেন, ‘কে একজন তোমার কোন একটা নতুন উপন্যাসের খুব প্রশংসা করছিল, ঈদসংখ্যায়।’
আমি বললাম, ‘তা হলে প্রথম আলোরটাই, প্রেক্ষাপট কুড়িগ্রাম।’
বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তিনি তা-ই বলছিলেন যে “আপনি রংপুরের উপভাষা সংলাপে ব্যবহার শুরু করেছিলেন, আনিস সেটাকে আরো বহু দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে”।’
আমি বললাম, ‘না না, এগিয়ে নিয়ে যাইনি। যা করার আপনিই করেছেন।’
তারপর বললাম, ‘বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল, আমার বারবার মনে পড়ছিল, ওই কবিতাটা, বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে দিল নাগেশ্বরীর মাঠ। আর মনে পড়ছিল, নদীর ওপারে, মঞ্জু, পাখিদের গ্রাম।’
হক ভাই বললেন, ‘মঞ্জু, শোনো আনিস কী বলে। মঞ্জু তোমার মনে আছে?’
ভাবি বললেন, ‘থাকবে না কেন?’
আমি বললাম, ‘হক ভাই, আমি তো দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাই, কিশোর তরুণদের উদ্দেশে গল্প বলি, আপনার সেই উপদেশটার কথা সব জায়গায় বলি।’
হক ভাই বললেন, ‘তুমি পুরো ঘটনাটা ওদের আবার শোনাও। দ্বিতীয়, মঞ্জু, শোনো।’
আমি বললাম, ‘আমি তখন রংপুরে। আইএসসি পাস করে বুয়েটে ভর্তি হয়েছি। ক্লাস শুরু হয়নি। এই সময় হক ভাই রংপুর গেলেন। সার্কিট হাউসে উঠেছেন। আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গেলাম। বয়স আমার ১৮ কি ১৯। আমি তাঁকে বললাম, আপনি বিচিত্রার মার্জিনে মন্তব্য কলামে লিখেছেন, “তরুণ লেখকদের কর্তব্য হলো বইপড়া।” পড়ার বাইরে তরুণ লেখকদের উদ্দেশে আপনি কি আর কোনো উপদেশ দেবেন? তিনি বললেন, “পড়ার বাইরে তরুণ লেখকদের উদ্দেশে আমার তিনটা উপদেশ আছে, পড়ো, পড়ো, এবং পড়ো”।’
‘অনেকেই বলে, বাংলাদেশে বই পাওয়া যায় না। আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা করি, আমাদের মধ্যে কজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরোটা পড়েছেন?
‘আমাদের মধ্যে কজন বঙ্কিমচন্দ্র পুরোটা পড়েছেন? আমি সেই সাক্ষাৎকারের পর একজন বাংলার অধ্যাপিকার বাড়িতে গিয়ে মাইকেল, বঙ্কিম, আলাওল, মধ্যযুগের পদাবলি, চর্যাপদ সব নিয়ে এলাম।’
হক ভাই হাসপাতালের বিছানায় আমার হাত ধরে বললেন, ‘বাংলা সাহিত্য করে, বাংলা সাহিত্যটা জানে না, বোঝো!’
আমি বললাম, ‘হক ভাই, আজকে আপনাকে দেখতে এলাম, এটা নিয়েও একটু লিখব।’
তিনি বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কথাটাও লিখো।’
ভাবি বললেন, ‘তিনি এসেছেন প্রটোকল ভেঙে গেছেন।’
হ্যাঁ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুদিন আগে সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে দেখা করতে এই হাসপাতালের এই কেবিনেই এসেছিলেন। ৪০ মিনিট ছিলেন। কবির হাত ধরে বলেছেন, চিকিৎসার দায়িত্ব তিনি নিচ্ছেন।
সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী কবি মাহবুবুল হক শাকিল।
ছবিতে কবি তারিক সুজাতকেও দেখেছি।
হক ভাই প্রধানমন্ত্রীকে নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমার ৮০তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম, লালনের মতো ১১৭ বছর অন্তত বাঁচতে চাই। তবে অন্তত ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আর ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীটা দেখে যেতে ইচ্ছা করে।’
হক ভাই কিন্তু এই রোগশয্যাতেও কবিতা লিখে চলেছেন। তিনি মুখে বলেন, আনোয়ারা সৈয়দ হক লিখে নেন।
তাঁর অনেক কাজ বাকি। সেসব তিনি করবেন, এসব নিয়ে পরিকল্পনা আঁটেন। ছক কষেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে কেউ অশ্রুসজল হলে তিনি তাঁকে বলেন, ‘হাসো।’
দ্বিতীয় হক বাড়িতে যাবেন বলে উঠলেন। ভাবি বললেন, ‘আনিস বসো। তা নাহলে হঠাৎ শূন্য মনে হবে ঘরটা।’ বসে রইলাম। টুকটাক গল্প করছি। ভাবি, ওই দুপুরবেলা, সকালের নাশতা করলেন দুটো রুটির টুকরা।
দরজায় নক। ভেতরে এলেন শাইখ সিরাজ ভাই।
হক ভাই বললেন, ‘আনিস, এবার তুমি উঠতে পারো। তোমার ছুটি।’
আমি ফিরছি—বাংলা ভাষার একজন প্রধান কবি, পরাণের গহীন ভিতর কিংবা বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালার কবি, প্রধান নাট্যকার, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কিংবা ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’-এর রচয়িতা, প্রধান কথাসাহিত্যিক—‘অন্তর্গত’, কিংবা ‘নিষিদ্ধ লোবান’ কিংবা ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’-এর লেখক—এখনো সমান সক্রিয়, এবং যাতে হাত দেন, তা-ই সোনা হয়ে ওঠে এখনো যাঁর স্পর্শে, সেই লেখকের হাসপাতাল-কেবিন থেকে আমি বেরিয়ে এলাম।
আমার মাথার ভেতরে তাঁর ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’র শেষ লাইনগুলো বারবার করে গুঞ্জন তুলছে-
‘জন্মে জন্মে বার বার কবি হয়ে ফিরে আসব এই বাংলায়।’
রচনাকাল: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ঢাকা।