আইন অধিকার

স্বামী-স্ত্রীর লেনদেন!

টাকাপয়সা-সংক্রান্ত লেনদেনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটি আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আইনের পাশাপাশি নৈতিক অধিকারবোধ তো আছেই।

দেনমোহর ও ভরণপোষণ
মুসলিম আইনে বিয়ের ক্ষেত্রে দেনমোহর স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীর একটি বিশেষ অধিকার। সাধারণত দুজনের সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় দেনমোহর হিসেবে যেকোনো পরিমাণ অর্থ নির্ধারণ করা যায়। এটি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈধ লেনদেনের একটি। সাধারণত দেনমোহরের কিছু পরিমাণ বিয়ের সময় তাৎক্ষণিক পরিশোধ করা হয় এবং তা কাবিননামায় লিখিত থাকে। বাকিটা বিলম্বিত দেনমোহর হিসেবে ধরা হয়। আইন অনুযায়ী দেনমোহরের পুরোটা স্বামীকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। কারণ, দেনমোহর সব সময়ই স্বামীর ঋণ। দেনমোহরের পাশাপাশি স্ত্রীর ভরণপোষণও স্বামীকে বহন করতে হয়। ভরণপোষণের পরিমাণ স্বামী-স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক সংগতির ওপর নির্ভর করে। সাধারণ অবস্থায় স্বামীই স্ত্রীর খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে থাকেন। আইনসংগত বা যুক্তিযুক্ত কারণে যদি স্ত্রী আলাদা বসবাস করেন, তখন স্বামী নগদ অর্থ দ্বারা ভরণপোষণ জোগাবেন। তবে স্বামী যদি কোনো কারণে প্রতিবন্ধী বা কাজ করার অক্ষম হয়ে যান এবং স্ত্রী যদি অর্থ উপার্জন করেন, তাহলে স্ত্রী নৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করে স্বামীর খরচ দিতে পারেন। এত কোনো বিধিনিষেধ নেই।

স্বামী-স্ত্রীর জমানো টাকা থাকলে
স্বামী বা স্ত্রীর নিজের কোনো টাকা জমানো থাকলে বা ব্যাংকে কিংবা সঞ্চয়পত্র কেনা থাকলে জীবিত থাকা অবস্থায় একজনের টাকা অন্যজন দাবি করতে পারবেন না। তবে কেউ যদি স্বামী বা স্ত্রীর নামে কোনো টাকা জমা রাখেন, তাহলে এটি যাঁর নামে জমা হচ্ছে, আইনত তাঁরই মালিকানা গণ্য হবে। ধরা যাক, স্বামী যদি স্ত্রীর নামে কোনো সঞ্চয়পত্র কিনে কিংবা কোনো ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন, তাহলে এটি আইনত স্ত্রীরই মালিকানা গণ্য হবে। তবে যৌথ কোনো হিসাব থাকলে এবং দুজনের মধ্যে একজনের যদি টাকা উত্তোলনের ক্ষমতা থাকে, সে ক্ষেত্রে যিনি টাকা জমা রেখেছেন, তিনি যেকোনো সময় তুলে নিতে পারবেন। অনেক ক্ষেত্রে নমিনি হিসেবে স্বামী বা স্ত্রী পরস্পরকে মনোনয়ন দেন। এ ক্ষেত্রেও যাঁর নামে হিসাব নম্বর আছে, তাঁর জীবিত থাকাকালীন নমিনি টাকা তুলতে পারবেন না। মনে রাখতে হবে যে টাকাপয়সাও কিন্তু সম্পত্তি এবং একজনের টাকায় জীবিত অবস্থায় অন্যজন মালিকানা দাবি করতে পারেন না। একজনের মৃত্যু হলে উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী টাকাও ভাগ হবে। ২০১৬ সালে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে একটি রায় এসেছিল যে মৃত ব্যক্তির টাকা উত্তরাধিকারীরা পাবেন, কিন্তু রায়ের কার্যকারিতা বর্তমানে আপিল বিভাগ কর্তৃক স্থগিত রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার জারি করে বলেছে যে নমিনি মৃত ব্যক্তির টাকা তুলতে পারবেন। অনেক সময় আদালত থেকে উত্তরাধিকারের সনদও লাগতে পারে।

শেষ কথা
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টাকা লেনদেন নিয়েও অনেক মামলা-মোকদ্দমা হতে দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ হলে একে অপরের বিরুদ্ধে চুরির মামলা করার মতো হাস্যকর ঘটনাও দেখা গেছে। মামলা-মোকদ্দমা কোনো বিরোধের সমাধান নয়। আইনত যে অধিকার যাঁর তাঁকে ততটুকু দিতে হবে। অনেক সময় একে অপরের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ফেরত না দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবে স্বামী যদি বিয়ের সময় বা পরে কোনো টাকাপয়সা স্ত্রীর কাছ থেকে অনৈতিকভাবে দাবি করতে থাকেন, তা যৌতুকের অপরাধ হবে। স্বামীর আয়ের অনুপাতেই স্ত্রীর খরচ দাবি করা উচিত। আবার স্বামীকেও তাঁর স্ত্রীর অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করা উচিত। সংসার তো দুজনেরই। এর মধ্যে কোনো টাকাপয়সা বা লেনদেন-সংক্রান্ত কোনো বিরোধ হওয়া একদমই মানায় না।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট