
কুড়িতে বুড়ি। এই প্রবাদের দিন ফুরিয়ে গেছে অনেক দিন আগেই। বরং এখন ৪০ বছর বয়সেও তারুণ্যের দীপ্তি ছড়াচ্ছেন অনেকেই। কয়েক দিন আগেই বাংলাদেশ থেকে ঘুরে গেলেন ভারতীয় অভিনেত্রী ও সাবেক বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেন। আসছে নভেম্বরেই ৪০-এর কোঠায় পা রাখবেন তিনি। না বলে দিলে কেউ সেটা বিশ্বাস করবেন না। মঞ্চে সেদিন সুস্মিতার তারুণ্যে আর উচ্ছলতায় মুগ্ধ ছিলেন সবাই।
একটি বেসরকারি বিমান সংস্থায় কাজ করেন মারুফা মাহফুজ। জানালেন, বেশ কিছুদিন আগেই ৪০-এর ঘর পেরিয়েছেন তিনি। চেহারায় বয়সের ছাপটা দূর করতে সব সময়ই মনকে প্রফুল্ল রাখার চেষ্টা করেন। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই পরিবার আর বন্ধুদের নিয়ে মেতে ওঠেন হই-হুল্লোড়ে। এড়িয়ে চলেন মিষ্টি-জাতীয় খাবার। নিয়মিত হাঁটা ও সাঁতার কাটাই তাঁকে এখনো এত সজীব রেখেছে বলে জানান মারুফা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বয়স বাড়ার গতিটাকে হয়তো রোধ করা যায় না। কিন্তু চেহারায় বয়সের ছাপটাকে এড়ানো যেতে পারে। এমনটাই জানালেন রূপবিশেষজ্ঞ রাহিমা সুলতানা। এই বয়সে এসে যে সমস্যাটা প্রবলভাবে দেখা দেয়, তা হলো শরীরের মেটাবলিজম রেট (হজম-প্রক্রিয়া) কমে যায়।
এ ছাড়া মাধ্যাকর্ষণের ফলে মুখের টিস্যুগুলোও ঝুলে যায় এ সময়। মুখের নিচে পড়ে ডাবল চিন। ফুলে গোল হয়ে যায় চোয়ালের দুই ধার। এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে নিয়মিত নিচে থেকে ওপরের দিকে ম্যাসাজ করা উচিত। পারলারে সাধারণত এ ধরনের ম্যাসাজে স্টোন বা পাথরের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। হাতের কাছে সেটা থাকলে ভালো। তবে না থাকলে চামচ ব্যবহার করার কথা জানালেন রাহিমা সুলতানা। প্রথমে মুখের ত্বকে ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে নিন। এবার দুটো টেবিল চামচ দুই হাতে ধরে চোয়ালের নিচে থেকে ধীরে ধীরে ওপরের দিকে টেনে নিন। চিনা আকুপ্রেসারের এই থেরাপিটি মুখে প্রয়োগ করলে ধীরে ধীরে মুখ একটা সুন্দর গড়ন পায়। চাইলে পাথরের চিরুনিও ব্যবহার করতে পারেন। এ সময় কপালের ত্বকে বলিরেখা পড়তে শুরু করে। বাজারে এখন অনেক ম্যাসাজ রোলার পাওয়া যায়। এ ধরনের পাথর বসানো রোলার দিয়ে কপালের নিচ থেকে ওপর বরাবর ম্যাসাজ করুন। দুটো ম্যাসাজই সপ্তাহের দুই দিনের বেশি না করাই ভালো।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘুমের গতিও কমতে থাকে। যদি ঘুম না আসে তাহলে কোনো সুগন্ধি তেল নিয়ে মাথার তালু, হাত ও পায়ের তালুতে ম্যাসাজ করুন। কারণ, স্নায়ুর এন্ডিং পয়েন্টগুলো এখানেই থাকে।
বয়সটা ৩০-এর কোঠা পার হলেই হজম ক্রিয়ার গতি ধীর হতে থাকে। এ জন্য ৪০-এর দরজায় পা দেওয়ার আগেই খাবারদাবারে একটা নিয়ন্ত্রণ আনা উচিত বলে মনে করেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার আলো। এই বয়সে খাবার থেকে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কমিয়ে বাড়াতে হবে প্রোটিনের পরিমাণ। কারণ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোষের যে ক্ষয় হয়, সেটা একমাত্র প্রোটিনের সাহায্যেই পূরণ করা সম্ভব।
দুধ, ডিম, মাছ ছাড়াও প্রোটিনের অন্যতম উৎস মাংস। তাই অনেকেই খাবারের তালিকা থেকে যে মাংস বাদ দিয়ে দেন, এটা করা একেবারেই ঠিক নয় বলে জানালেন এই পুষ্টিবিদ। দিনে প্রতিটি খাবার গ্রহণের মধ্যে তিন ঘণ্টা বিরতি রাখার পাশাপাশি দিনে অন্তত পাঁচবার খাবার গ্রহণের পরামর্শ দিলেন আখতারুন নাহার আলো। এদিকে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় একটা ব্যালান্স ডায়েট মেনে চলা ভালো। যেমন, সকালের খাবারে দুটি আটার রুটি, কম তেলে রান্না সবজি আর একটি সেদ্ধ ডিম খেতে পারেন।
এরপরে তিন ঘণ্টা বিরতি দিয়ে এক বাটি মুড়ি বা দুইটা টোস্ট বিস্কুট বা পপকর্ন খাওয়া যেতে পারে। দুপুরের খাবারে দুই কাপ ভাতের সঙ্গে এক টুকরো মাংস বা মাছ খেতে পারেন। সঙ্গে থাকবে এক বাটি পাতলা ডাল আর প্লেটভর্তি সালাদ। আবারও নির্ধারিত বিরতিতে দুধ বা ফলের তৈরি কোনো খাবার খেতে পারেন। এবার দুপুরের খাবারের মেনুটাই বেছে নিতে পারেন রাতের খাবারে। এ ছাড়া যেকোনো সময় মুখে পুরে নিতে পারেন একমুঠো বাদাম, কিশমিশ বা খেজুর।
হরমোনের ইমব্যালেন্সের ফলে ৪০-এর পরে শরীরে দেখা দেয় নানা ধরনের সমস্যা। এর ফলে শারীরিকভাবে অনেকেই নমনীয় হয়ে পড়েন। তাই ইয়োগা বা জিমের ব্যায়ামগুলো যদি ২৫ বছর বয়স থেকেই শুরু করা যায়, তাহলে শারীরিকভাবে অনেকটাই ফিট থাকা যায়—বললেন পারসোনা হেলথের প্রধান প্রশিক্ষক ফারজানা খানম। জানালেন, ব্রিদিং এক্সারসাইজের মধ্য দিয়েও চেহারায় প্রশান্তি ধরে রাখতে পারেন। যেমন ঘরের কোনো খোলা স্থানে হাত দুটোকে প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে পড়ুন। এবার চোখ বন্ধ করে নাক দিয়ে এক থেকে পাঁচ গুনতে গুনতে বুক ভরে শ্বাস নিন।
এবার ধীরে ধীরে এক থেকে ১০ গুনতে গুনতে শ্বাস ছাড়ুন। সপ্তাহে পাঁচ দিন আট থেকে দশবার নিশ্বাস ছাড়া ও নেওয়ার এই ব্যায়ামটি করতে পারেন। এই ব্যায়ামটি স্নায়বিক দুর্বলতা কাটানোর পাশাপাশি ত্বকের উজ্জ্বলতা, স্মৃতিশক্তি ও মানসিক প্রশান্তি বাড়াতে সাহায্য করে। এ ছাড়া রক্ত সঞ্চালন ও শারীরিক কাঠামো ঠিক রাখতে নিয়মিত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটা ও সাঁতার কাটাটা বেশ উপকারী। এসব কিছু মেনে চললেও ঘুমের বেলায় একটা অনীহা কাজ করে অনেকের ভেতর। যেমন সারা রাত ফেসবুক বা ছবি দেখে সময় কাটিয়ে দেন। ঘুমোতে যান সেই ভোরবেলা। এভাবে অল্প সময়ের ঘুমও ওজন বাড়ানোর একটা কারণ। কারণ, ঘুম কম হলে শরীরের মেটাবলিজম রেট কমে যায়। বাড়তে থাকে ওজন। সুস্থ ও সতেজ থাকতে প্রতিদিন রাতে আট ঘণ্টা ঘুমানো খুব জরুরি বলে জানালেন ফারজানা খানম।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে চল্লিশের পর নারীদের নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। পাশাপাশি বহুমূত্র ও উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগগুলো যদি কারও পরিবারে থেকে থাকে, সেগুলো শরীরে এই বয়সেই বাসা বাঁধতে শুরু করে। এ জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাপনের প্রক্রিয়া বাতলে দিলেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মানস কুমার গোস্বামী। তবে রোগগুলোর বংশগত কারণ না থাকলে অতটা চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। এ ছাড়া চল্লিশের পরেই চোখের লেন্সের সম্প্রসারণশীলতা কমতে শুরু করে। যেকারণে কাছের জিনিসগুলো ঝাপসা দেখায়। এ জন্য চক্ষু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে অবশ্যই চশমা ব্যবহার করতে হবে। যাঁদের কাছের জিনিস দেখতে সমস্যা নেই, তাঁদের কিন্তু নিশ্চিন্ত হলে চলবে না। কারণ, এই বয়সে দৃষ্টি স্বাভাবিক থাকাই চোখের জন্য অস্বাভাবিক বলে মনে করেন চিকিৎসকেরা।