
>প্রতিশোধ সাময়িক শান্তি দেয় বটে, তবে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করে। যা ব্যক্তির চিন্তা আর আচরণে প্রকাশ পায়। এই সমস্যার কারণে প্রতিশোধপরায়ণ ব্যক্তি মানসিক শান্তি থেকে বহু দূরে থাকে।
এক.
রুনিয়া (ছদ্মনাম) আর মাহবুবের (ছদ্মনাম) বিচ্ছেদ হয়েছে মাস চারেক। এর আগে থেকেই তাদের মধ্যে কেবল ঝগড়া আর হাতাহাতি। নিত্য অশান্তি। বিচ্ছেদের পর আবার পাল্টাপাল্টি মামলা। এর মধ্যে রুনিয়ার পাঠানো লোকজন গিয়ে মাহবুবের অফিস ভাঙচুর করে এসেছে। আর কে বা কারা রুনিয়াকে ক্রমাগত টেলিফোনে হুমকি দিচ্ছে। দুজন একেবারে প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত। একজন আরেকজনকে ধ্বংস না করতে পারলে যেন শান্তি নেই।
দুই.
একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আনিস (ছদ্মনাম) আর সাইফুদ্দিন (ছদ্মনাম)। আনিসের একটি ভুলে কোম্পানির বেশ কিছু লোকসান হয়ে গেল। এই লোকসান যে আনিসের কারণেই হয়েছে, তা সাইফুদ্দিনই কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। এতে আনিসের পদোন্নতি বন্ধ হয়ে যায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আনিস তক্কে তক্কে থাকে, কখন বাগে পেয়ে সাইফুদ্দিনের ওপর প্রতিশোধ নেবে। একদিন আনিস ইচ্ছা করেই অফিসের কিছু গোপনীয় দলিল প্রতিপক্ষÿকোম্পানির কাছে তুলে দেয়। আর এতে এই দলিলের দায়িত্বে থাকা সাইফুদ্দিন যায় ফেঁসে। প্রতিশোধ নিতে পেরে আনিস কিছুটা তৃপ্ত হয়।
একদল সুইস গবেষক গবেষণাগারে কিছু মানুষের ওপর একটি গেমের মধ্যে তাদের প্রতি কিছু অবিচার করান। পরবর্তী সময়ে অবিচারের বা ক্ষতির শিকার হওয়া মানুষদের সামনে গেমের চরিত্রদের হাজির করান যারা তাদের ক্ষতি করেছে। গেমের মধ্যে মানুষেরা সেই গেমের চরিত্রকে ইচ্ছেমতো শাস্তি দেয়, প্রতিশোধ নেয়। এর ঠিক কয়েক মিনিট পর সেই মানুষদের মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক অ্যাকটিভিটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তাদের ‘কডেট নিউক্লিয়াস’ নামক স্থানে বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, যা প্রতিশোধ নেওয়ার আগে ছিল না। এটাকে বিজ্ঞানীরা বলেছেন ‘প্রসেস রিওয়ার্ডস’। এই প্রসেস রিওয়ার্ডস বা পুরস্কারকেন্দ্র তৃপ্ত হওয়ার বিষয়টিকে বিজ্ঞানীরা প্রতিশোধ গ্রহণের কারণে তৃপ্তি বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ যাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা অবিচারের শিকার হয়েছে বলে মানুষ মনে করে, তাদের ওপর যেকোনো পীড়ন ঘটলে মানুষের পুরস্কারকেন্দ্র তৃপ্ত হয়। এটাই প্রতিশোধ।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা পরবর্তী সময়ে এ–ও দেখিয়েছেন যে প্রতিশোধ সাময়িক শান্তি দেয় বটে, তবে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করে। যা ব্যক্তির চিন্তা আর আচরণে প্রকাশ পায়। এই সমস্যার কারণে প্রতিশোধপরায়ণ ব্যক্তি মানসিক শান্তি থেকে বহু দূরে থাকে। যে ‘অবিচার’কে কেন্দ্র করে সে প্রতিশোধ নিচ্ছে, তা নিয়ে তার মনে চিরস্থায়ী স্মৃতিক্ষত জমা হয়। এ প্রসঙ্গে ইংরেজ দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও লেখক ফ্রান্সিস বেকন লিখেছিলেন ‘প্রতিশোধের মধ্য দিয়ে একজন মানুষ তার তথ্যগুলোকে সব সময় তাজা রাখে, যা হয়তো আপনা-আপনি শুকিয়ে যেত।’ আবেগের যে অংশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রতিশোধ কিন্তু সেটাকে মেরামত করতে পারে না, বরং সেই ÿক্ষতিগ্রস্ত আবেগকে আরও জটিল করে। প্রতিশোধের মধ্য দিয়ে মানুষ মূলত নিজের ওপরেই আরও অত্যাচার করে। এখন প্রশ্ন আসে, তাহলে কি অপরাধের জন্য শাস্তি থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। কিন্তু এই শাস্তির মধ্য দিয়ে যেন কারও পুরস্কারকেন্দ্র তৃপ্ত না হয়। শাস্তি যেন হয় মানুষের সংশোধনের পন্থা মাত্র। শাস্তির উদ্দেশ্য আরেকজনের প্রতিশোধস্পৃহাকে তৃপ্ত করা নয়—শাস্তির উদ্দেশ্য শৃঙ্খলা আনা, অপরাধীকে সংশোধন করা এবং অবশ্যই পরবর্তী সময়ে এ ধরনের অপরাধ বা অবিচারের হার কমানো। শাস্তি, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতিশোধস্পৃহার অস্ত্র হতে পারে না।
কর্মক্ষেত্রে প্রতিশোধ
মার্কিন গায়ক, অভিনেতা ও প্রযোজক ফ্রাংক সিনাত্রা বলেছেন ‘সবচেয়ে বড় প্রতিশোধ হচ্ছে আরও, আরও বড় সফলতা’। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নিজের সফলতার চেয়ে অপরের পাতে কী আছে, সেটা দেখতে গিয়েই প্রতিশোধের নেশা তৈরি হয়। ‘আরেকজন কেন আমার চেয়ে এগিয়ে গেল’, ‘ক্ষমতাবান ব্যক্তি কেন আমার নাম উচ্চারণ না করে আরেকজনের নাম উচ্চারণ করলেন’, ‘আরেকজন কেন ফাঁকি দেয়’, ‘আমি কেন অমুকের চেয়ে পিছিয়ে আছি’, ‘ওকে এবার বাগে পেয়ে নিই-এমন শিক্ষা দেবে বাবার নাম ভুলিয়ে দেব’, ‘আমার কেন প্রমোশন হয় না’—এসব ভাবতে ভাবতে নিজের সাফল্যের জন্য করণীয় কাজগুলোই করা হয়ে হয়ে ওঠে না। ‘হেলদি রিভেঞ্জ’ বলে একটি শব্দ আছে—সেটা হচ্ছে অপরের ক্ষতি না করে নিজের উৎকর্ষতা বাড়ানো।
কর্মক্ষেত্রে প্রতিশোধপরায়ণতা কমাতে যা করা উচিত:
পরিবারে, সম্পর্কে প্রতিশোধ
পরিবারে, স্বামী-স্ত্রী বা ভাইবোনের সম্পর্কেও প্রতিশোধস্পৃহা দেখা যায়। সামান্য কারণে পছন্দের মানুষই হয়ে যেতে পারে সবচেয়ে দূরের। সেই তার সব ধরনের ক্ষতিই হয়ে উঠে চরম কাঙ্ক্ষিত। সম্পর্কের জটিলতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত আর বৈষয়িক ইস্যুগুলো নিয়েই সবচেয়ে বেশি রেষারেষি ঘটে। তখন প্রতিশোধই হয় পরস্পরের উপজীব্য। আরেকজনের শেষ না দেখে রাতের ঘুম হয় না।
পরিবার আর সম্পর্কগুলোর মধ্যে যাতে প্রতিশোধের ঘটনা না ঘটে, সে জন্য যা যা করণীয়—
আহমেদ হেলাল
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।