Thank you for trying Sticky AMP!!

'বড় আব্বু'দের কাছেও নিরাপদ নয় শিশুরা

.

সাইফুলকে মনে আছে নিশ্চয়ই! দিনাজপুরের পাঁচ বছরের যে শিশুটি ঢাকায় হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে, তার প্রতিবেশী। তিন মেয়ে, এক ছেলের জনক সাইফুলকে সে ‘বড় আব্বু’ বলে ডাকে। এই বড় ‘আব্বু’ই তাকে ধর্ষণ করেছে, মাথা-গা থেঁতলে দিয়েছে, সিগারেটের আগুনে পুড়িয়েছে বলে অভিযোগ। বাংলাদেশের শিশুরা এখন এসব ‘বড় আব্বু’ গোছের লোকজনের কাছে বড় অসহায়।
নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালিত প্রকল্পের (ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার—ওসিসি) তথ্য বলছে, শিশুদের ধর্ষণ করছে যারা, তাদের একটা বড় অংশ চেনা-জানা লোকজন। এই তালিকায় গাজীপুরের গার্মেন্টস কর্মী মা-বাবার আট মাসের কন্যাশিশু আছে, আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিন বছরের শিশুও। গাজীপুরে ধর্ষক শিশুর প্রতিবেশী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আত্মীয়। ধর্ষকদের কেউ বৃদ্ধ, কেউ প্রৌঢ় এবং একটি অংশ কিশোর। খুব সামান্য কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে তারা শিশুদের সঙ্গে ভাব করছে। তারপর ধর্ষণ করছে।গত জুলাই মাসে পুলিশ সদর দপ্তর তিন বছরের নিচে ২৪টি শিশু ধর্ষণের ঘটনার বিচার সুনিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়। তাদের মধ্যে বরিশালের উজিরপুরের তিন বছরের শিশুকে বরই, নেত্রকোনায় বিস্কুট, চুয়াডাঙ্গায় চকলেট খাওয়ানোর কথা বলে এবং ঢাকার রায়েরবাজার, রামপুরা ও মিরপুরে খেলা করার কথা বলে ধর্ষণ করা হয়েছে।

যখনই দেশের কোনো প্রান্তে কোনো শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় হচ্ছে। মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সাইফুলকে দিনাজপুর আদালত প্রাঙ্গণে জনরোষের হাত থেকে বাঁচাতে পুলিশকে বেগ পেতে হয়েছে। 

ওসিসির হিসাবে ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় বিচারের হার শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশনা আছে, তবে এর বাস্তবায়ন নেই। পুলিশ বলে, সরকারপক্ষের কৌঁসুলি যত্নবান নন, তাই বিচার হয় না। সরকারপক্ষের কৌঁসুলি বলেন, পুলিশ সাক্ষী ও আসামি আনতে পারে না। সামাজিক চাপে ধর্ষণের শিকার পরিবারও চুপ করে যায়। 

বরিশালের উজিরপুরের তিন বছর বয়সী এক শিশুর বাবা বলেন, ‘কোর্টে মামলা চলছে চলুক। বিচার পেতে অনেক সময় লাগবে। আমি যখনই আদালতে যাব, তখনই লোকে জানবে, আমার বাচ্চাটা ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, তার চেয়ে চুপচাপ থাকি। লোকে একসময় ভুলে যাবে।’

বিচারহীনতা, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি কারণে শিশু নির্যাতনের ঘটনার সেই অর্থে সুরাহা হচ্ছে না। ফলে অপরাধের সংখ্যাও বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ১৬১ দশমিক ৮১ শতাংশ, গণধর্ষণ বেড়েছে ৩৫০ শতাংশ, ধর্ষণের পর হত্যার হার বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। 

মনোরোগ চিকিৎসকেরা বলছেন, যারা এমন অপরাধে জড়াচ্ছে, তারা বেড়ে ওঠার সময়টায় সঠিক শিক্ষা পায়নি। যৌন হয়রানি করাকে তারা অপরাধ বলে গণ্য করে না। প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের হয়রানি করা কঠিন বলে তারা শিশুদের বেছে নেয়। শিশুদের ওপর জোর খাটানো সহজ এবং শিশুরা ঠিকমতো ঘটনার বর্ণনা দিতে না পারায় অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। 

পুলিশ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, মুঠোফোন ও ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় কৈশোরে অনেকেই অসুস্থ যৌনাচার দেখছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কৌতূহল মেটাতে শিশুদের ধর্ষণ করছে। ঢাকার কল্যাণপুরের পোড়া বস্তিতে মাস কয়েক আগে এমন ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় অভিযুক্ত কিশোর এখন কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ধর্ষণের শিকার শিশুরা অনাস্থা, অবিশ্বাস নিয়ে বড় হয়। আর অন্য সব জটিল মানসিক রোগের মতো তাদের প্রকাশ ঘটে শারীরিক কোনো সমস্যা দিয়ে। কখনো কখনো তারা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তাদের খিঁচুনিও হতে পারে।’ মানসিক সমস্যার পাশাপাশি শিশু মারাত্মক শারীরিক সমস্যায় ভোগে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুর যোনিপথ আর পায়ুপথ এক হয়ে যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিশুটির পেটে ছিদ্র করে মল বের করার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। একাধিক অস্ত্রোপচারের পর এখন সে কিছুটা সুস্থ।

সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এই ধর্ষণের মামলাগুলো জিইয়ে রাখে। নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের পরিচালক আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশু এবং তাদের স্বজনেরা মনে করে, ধর্ষণের দায় ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর ওপর বর্তাবে। ভবিষ্যতে মেয়েটি আর স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যেতে পারবে না—এই ধারণা থেকে অভিভাবকেরা চুপ করে থাকেন। কিন্তু এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।

২০০১ সালে নির্বাচনের পর দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলায় এক কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই কিশোরীকে নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়েছিল। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, একদিন নিজের নামে ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট খোলার সময় দেখেন, তাঁর নামে একটি প্রোফাইল চালু আছে, সেটি পর্নোগ্রাফি প্রকাশের পেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাজ্জব বনে যাওয়া ওই নারী এ নিয়ে নানা উপহাসের সম্মুখীন হন। ১৫ বছর পর তিনি মুখ খুলেছেন, বলেছেন ‘অসম্মান তো আমার নয়, এই সমাজের।’