'সাদা' বারবিকে হারিয়ে দিল 'কালো' আফ্রিকার রানি

‘কুইন্স অব আফ্রিকা’ সিরিজের পুতুলে নাইজেরিয়ার ইয়োরুবা, ইগবো ও হাউসা নারীদের সাজ-পোশাক। ছবি: রয়টার্স।
‘কুইন্স অব আফ্রিকা’ সিরিজের পুতুলে নাইজেরিয়ার ইয়োরুবা, ইগবো ও হাউসা নারীদের সাজ-পোশাক। ছবি: রয়টার্স।

আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া ইউরোপীয়দের উপনিবেশ মুক্ত হয়েছে অর্ধশতাব্দী পার হলো। কিন্তু কোনো দেশের সমাজ আর জনসংস্কৃতির খোলনলচে তো রাতারাতি পাল্টে যায় না। রাজনৈতিক কাঠামো তো বটেই, সমাজের গভীরে ছোট ছোট আচার-আচরণ আর উপকরণেও থেকে যায় ঔপনিবেশিক চর্চার রেশ। সে জন্যই হয়তো মাত্র কয়েক বছর আগেই ছোট্ট ভাগনির জন্য খেলার পুতুল কিনতে গিয়ে বাজারে কোনো কালো পুতুল খুঁজে পাননি নাইজেরিয়ার তাওফিক ওকোইয়ো।

নাইজেরিয়ার রাজধানী লাগোস এবং অন্যান্য শহর-বন্দরেও অবস্থাটা একইরকম ছিল। পশ্চিমা বারবি পুতুলেই ভরা বিপণিবিতানের শিশু-খেলনার তাকগুলো। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের ঘরে ঘরেও ‘কালো মেয়ের’ হাতে ‘সাদা বারবি’ দেখে দেখে এটাই হয়তো চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছিল সবার। কিন্তু জীবন সংগ্রামে হিমশিম খাওয়া যুবক তাওফিক ওকোইয়োর চোখ পরিচিত এই দৃশ্যেও অন্য এক সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল। ভাগনির জন্য পুতুল কিনতে গিয়েই তাঁর মনে হয়েছিল বানাতে পারলে কালো মানুষের দেশে তো কালো পুতুলের বাজার ভালোই হওয়ার কথা।    

কোনো স্থানীয় প্রতিযোগী না থাকায় ব্যবসা খুলে বসতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি ওকোইয়োকে। দুনিয়াজুড়ে জনপ্রিয় পুতুল বারবির প্রস্তুতকারক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাটেল ইনকরপোরেশন ছাড়া আর কোনো বিদেশি কোম্পানিরও তেমন কোনো প্রতিযোগিতা নেই। চীনের বাজার থেকে কমদামে পুতুলের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ নানা উপকরণ কিনে আনতে শুরু করেন ওকোইয়ো। পুতুল বানানো হলো। এবার সাজসজ্জার পালা। আর এখানেই চমক দেখালেন তিনি। কালো মেয়ের হাতের পুতুল সাজল স্থানীয় রীতিতে আর ঐতিহ্যবাহী নাইজেরীয় পোশাক-আশাকে।

লাগোসে নিজের কারখানায় উদ্যোক্তা ও পুতুলশিল্পী তাওফিক ওকোইয়ো। ছবি: রয়টার্স।


‘কুইন্স অব আফ্রিকা’
শুধু সাজ-পোশাকেই নয়, নামকরণ আর ভাবনায়ও ওকোইয়োর পুতুল অনন্য। দেশজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে তিনি পুতুলের নাম দিলেন ‘কুইন্স অব আফ্রিকা’ বা আফ্রিকার রানিরা। আর রানি হিসেবে ওকোইয়ো সাজালেন নাইজেরিয়ার বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নারীদের। দেশটির বহু জাতি-সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় তিনটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ইয়োরুবা, ইগবো ও হাউসা নারীদের পোশাক-রীতি এবং সাজসজ্জা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আফ্রিকার রানিরা নামে এই পুতুলের সিরিজে। এর পাশাপাশি ইতোমধ্যেই বাজারে এসেছে ওকোইয়োর আরেক পুতুল ‘নাইজা প্রিন্সেস’। পরবর্তী সময়ে একইভাবে অন্যান্য জাতি-সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিকেও তুলে ধরতে চান বলে জানিয়েছেন এই পুতুলশিল্পী।
‘আফ্রিকার রানি’দের হাতের কাছে পেয়ে খুশি স্থানীয় বাসিন্দারাও। লাগোসের একটি বিপণিবিতানে পাঁচ বছর বয়সী ইফুনানিয়া ওদিয়াহ ভীষণ উদ্বেলিত এই পুতুল পেয়ে। এই পুতুল ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছে জানিয়ে ছোট্ট শিশুটি বলছিল, ‘এটা কালো, আমার মতোই।’

দেশ থেকে দেশান্তরে যাত্রা

লাগোসে একটি ছোট্ট কারখানা নিয়ে কাজ শুরুর পর ৪৩ বছর বয়সী এই যুবককে এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাত বছরের মাথায় ওকোইয়োর ‘আফ্রিকার রানি’ এবং ‘নাইজা প্রিন্সেস’ প্রতি মাসে ছয় থেকে নয় হাজার পিস বিক্রি হচ্ছে। আর নাইজেরিয়ার ছোট্ট কিন্তু দ্রুত বর্ধিঞ্চু পুতুল বাজারের ১০ থেকে ১৫ ভাগই ইতোমধ্যেই ওকোইয়োর দখলে চলে এসেছে বলেও জানালেন তিনি। ‘আফ্রিকার রানি’ সিরিজের পুতুলগুলোর দাম এক হাজার ৩০০ থেকে তিন হাজার ৫০০ (নাইজেরীয় মুদ্রা) নাইরা (এক মার্কিন ডলার সমান প্রায় ১৬০ নাইরা)। অপেক্ষাকৃত কমদামি ‘নাইজা প্রিন্সেস’-এর দাম ৫০০ থেকে এক হাজার নাইরা। ওকোইয়ো জানালেন গড়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুনাফা করেন তিনি।

দেশের বাজারে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পাশাপাশি ইতোমধ্যেই বিদেশে যাত্রা শুরু করেছে আফ্রিকার রানি আর নাইজা প্রিন্সেস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বাজারে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে এই কালো পুতুলের। পশ্চিমা দেশগুলোতে অভিবাসী আফ্রিকানরাই এর ক্রেতা বলেও জানালেন ওকোইয়ো।


স্বজাতি, স্বদেশের মুখচ্ছবি
কালো মানুষের দেশে কালো পুতুলের মধ্য দিয়ে স্থানীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার এ সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে এই ভাবনাকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন ওকোইয়ো। আফ্রিকার অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোকে নিয়েও পুতুল বানাতে চান তিনি। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকার একটি কোম্পানির সঙ্গে কথা চলছে তাঁর। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার নানা শহরের প্রায় ৭০টি দোকানে বিক্রি হতে পারে ওকোইয়োর পুতুল।


নামে চেহারায় আর সাজ পোশাকে স্বজাতি, স্বদেশকে তুলে ধরার চেষ্টা হয়তো অনেকটাই সফল। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে আফ্রিকার রানি বা নাইজা প্রিন্সেসরা কেন পশ্চিমা বারবির মতোই হালকা-পাতলা দেহবল্লরীর। আফ্রিকার বেশির ভাগ মানুষই যেখানে শারীরিক সৌন্দর্যে ‘স্লিম’ হওয়ার পশ্চিমা মানদণ্ড পছন্দ করেন না, সেখানে এই পুতুলরা কেন ‘স্লিম’ হবে। ওকোইয়ো জানালেন প্রথমে মোটাসোটা দেহবল্লরীর পুতুলই বানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্করা তা পছন্দ করলেও এর প্রধান ভোক্তা শিশুরা মোটা পুতুল পছন্দ করেনি। ওকোইয়ো মনে করেন, ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে একবার ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা পেলে সাজসজ্জা আর পোশাকের মতোই পুতুলের দেহবল্লরি নিয়েও আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ পাবেন তিনি। এভাবেই হয়তো একসময় শিশুর হাতের খেলার পুতুলেও পুরোপুরি ফুটে উঠবে স্বদেশ-স্বজাতির মুখচ্ছবি।