প্রতি বছর আনুমানিক ১২ থেকে ১৩ লাখ মেয়েশিশুকে পাচার করে যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হয় সেই দেশে। সেই দেশেরই কলকাতা নামের শহরে আছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় যৌনপল্লিগুলোর একটি— সোনাগাছি। সব দেশ আর শহরের লোকেরাই যেমন নিজেদের গল্পটা জানেন, তেমনি ভারত আর কলকাতা শহরের এই চিত্রও সেখানকার সবারই জানা। আসলে হয়তো সবাই জানেন কারা কোথায় কীভাবে যায়। তবুও সবাই বলেন, ‘হারিয়ে যাওয়া’।

দেশ-দেশান্তরে, সীমান্তের এপারে-ওপারে, হারিয়ে যাওয়া সেই সব ফুলদের নিয়ে কলকাতা শহরের শিল্পীরা একসময় গান বেঁধেছিলেন— ‘রাবেয়া কি রুখসানা ঠিক তো মনে পড়ে না/অস্থির এ ভাবনা শুধু করে আনাগোনা/ফেলে আসা দিন তার মিছে মনে হয় ... জানি সে কোথায়/এই শহরের কোন বাগানে সে হয়ে আছে ফুল/প্রতি সন্ধ্যায়/পাপড়ি মেলে দিয়ে সে আবার ভোরে ঝরা বকুল’
মহীনের ঘোড়াগুলি সেই কবে এই গান গেয়েছিল, গানে গানেই ওরা বলে দিয়েছিল, ‘জানি সে কোথায়।’ কিন্তু দশকের পর দশক পেরোলেও হারিয়ে যাওয়া সেই ফুলের দলের বাস্তবতা খুব একটা পাল্টায়নি। এ কারণেই হয়তো কলকাতার শিল্পী লীনা কেজরিওয়াল সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে বার বার বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে চান। এই লক্ষ্যে তিনি শুরু করেছেন এক অভিনব শিল্প প্রকল্প— M. I. S. S. I. N. G বা ‘হারিয়ে যাওয়া’।
২০১৪ সালে নয়াদিল্লিতে ইন্ডিয়া আর্ট ফেয়ারে তাঁর এই ‘মিসিং’ বা ‘হারিয়ে যাওয়া’ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন আলোকচিত্রী ও ইন্সটলেশন শিল্পী লীনা কেজরিওয়াল। আর্ট ফেয়ারের এক প্রবেশদ্বারের ওপরই ছিল লীনার করা দুটো মেয়ে শিশুর শক্তিশালী ‘সিল্যুট’ এর কাজ। প্রখর ড্রয়িংয়ে কার্ডবোর্ডের কাটআউটে গড়া ওই দুই কালো মেয়েকে তিনি বসিয়ে দিয়েছিলেন আকাশের ক্যানভাসে। লীনার এই কাজ সবার নজর কেড়েছিল।
মেয়ে শিশু পাচার এবং যৌন ব্যবসায় তাদের লিপ্ত করা বন্ধ করার লক্ষ্যে মানুষকে সচেতন করতে ভারতের বড় বড় দশটি নগর-বন্দর-শহরে এই ‘হারিয়ে যাওয়া’ মেয়েদের ভাস্কর্য বসাতে চান এই লীনা। লোহা ও ফাইবার গ্লাসে তৈরি ১২ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার ৩০টি ভাস্কর্য নির্মাণে তাঁর প্রয়োজন প্রায় ১৬ লাখ রুপি। শিল্পী চান সাধারণ মানুষের চাঁদার টাকাতেই এসব ভাস্কর্য নির্মিত হোক। তহবিল জোগাড়ের পাশাপাশি এখন চলছে বিভিন্ন শহরে সচেতনতা তৈরির কাজ।
কলকাতার মেয়ে লীনা এখন তাঁর সঙ্গে যোগ দেওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে শহরের দেয়ালে দেয়ালে স্টেনসিলে আঁকছেন হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের ছবি। ভাস্কর্য নির্মাণ এবং দেয়ালে দেয়ালে হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের প্রতীকী ছবি আঁকা সম্পর্কে লীনা বলেন, ‘আমি চাই একজন বাস চালক কিংবা একজন ব্যবসায়ী এই তীব্র কালো শরীরগুলোর দিকে তাকান এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হওয়ার আগে দ্বিতীয়বার ভাবুক।’
নিজের শহর কলকাতার পাশাপাশি বেঙ্গালুরু, নয়াদিল্লি, চেন্নাইয়েও চলছে লীনার ‘হারিয়ে যাওয়া’ মেয়েদের প্রচারের কাজ। ভারতের দশটি শহুরে এলাকার মোট ১৫০টি জায়গায় দেয়ালে ছবি এঁকে এই প্রচার অভিযান চালাবেন এই শিল্পী। এরপর শুরু হবে তাঁর ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ। ‘মিসিং’ নামে ভাস্কর্যের পাশাপাশি তৈরি করা হবে একটি মোবাইল অ্যাপসও। অ্যাপসটি ডাউনলোড করে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করা ভাস্কর্যগুলোর ছবি-ভিডিও দেখানোর পাশাপাশি অ্যানিমেটেড একটি চরিত্র কথা বলে বলে মানুষকে সচেতন করবে শিশুদের পাচার ও যৌন ব্যবসায় লিপ্ত করা বন্ধের জন্য।
লীনা কেজরিওয়ালের কাজে শহর-বন্দরের সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর বিষয়ে মনোযোগ বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসে। ‘ক্যালকাটা: রিপ্রোসেসিং দ্য সিটি’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে ৪৮ বছর বয়সী শিল্পী লীনা কেজরিওয়ালের। ফ্রান্সে আবাসিক শিল্পী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি কলকাতা, নয়াদিল্লি, বার্লিন, ভাইমার ও তেহরানে বড় আকারের ফটোগ্রাফিক ইনস্টলেশন প্রকল্প নিয়ে কাজ করেছেন এই শিল্পী।
(হিন্দুস্তান টাইমস, গার্ডিয়ান ও হার স্টোরি অবলম্বনে)