সাফওয়ান আখতার সদ্য
সাফওয়ান আখতার সদ্য

সদ্যকে কেন মরতে হলো?

৫ আগস্ট সরকার পতনের পরও সাভারে দিনভর ছাত্র-জনতার ওপর নৃশংসতা চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হতাহত হয় অনেক মানুষ। প্রথম আলোর এক তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে সেই দিনের ঘটনার পূর্বাপর। ‘জুলাই-জাগরণ’-এ এটি প্রদর্শিত হবে। তথ্যচিত্রটি নির্মাণের অভিজ্ঞতা লিখলেন আব্দুল্লাহ আল হোসাইন

সাফওয়ান আখতারকে আমরা ডাকতাম ‘সদ্য’। সবার আদরের সদ্য সম্পর্কে আমার শ্যালক, ফুফু শাশুড়ির একমাত্র ছেলে। সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল ও। সাভারেই বাসা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের খবর পাওয়ার পর অনেকের মতো সদ্যও বিজয় মিছিলের যোগ দিতে বেরিয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার আর বাসায় ফেরা হয়নি। বিকেলে সাভার থানার কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে সেদিনই মারা যায়।

সদ্যর মৃত্যুসংবাদ আমাদের শোকাতুর করেছিল, একই সঙ্গে আমাকে কিছু প্রশ্নেরও মুখোমুখি করেছিল। ৫ আগস্ট তো শেখ হাসিনা সরকারের পতনই হয়ে গিয়েছিল, তারপরও সদ্যকে কেন মরতে হলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই জানতে পারি, হাসিনা সরকারের পতনের পরও সাভারের অলিগলি থেকে মহাসড়কে দিনভর একের পর এক গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ঝরেছে অনেক প্রাণ। ৫ আগস্ট সাভারের সেসব ঘটনার কথা যেন অগোচরেই রয়ে গেছে। পেশাগত দায়িত্ব থেকেই তাই শুরু করলাম ভিজ্যুয়াল অনুসন্ধানের কাজ। সেটা সেপ্টেম্বরের কথা।

গুলিবিদ্ধ একজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে ছাত্র-জনতা, ৫ আগস্ট ২০২৪, সাভার

দুই মাস ধরে সাভারের অলিগলি চষে বেড়ালাম। ৫ আগস্ট ধারণ করা শত শত ফুটেজ সংগ্রহ করলাম। দিনের বিভিন্ন সময় ধরে ধরে সেসব মিলিয়ে নিলাম। জানতে পেলাম, ৫ আগস্ট ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে জাহাঙ্গীরনগর থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে আসা মিছিলটিতে সাভারের ছাত্র-জনতার সঙ্গে ছিল আশুলিয়া, বাইপাইল ও ধামরাইয়ের লোকজন। সেটিকে প্রতিহত করতে শুরু হয় পুলিশের প্রাণঘাতী গুলি। ফলাফল, কয়েকজনের মৃত্যু। তারপর সময় গড়িয়েছে, সরকারের পতন হয়েছে, কিন্তু সাভারে গুলি থামেনি, বরং তীব্রতা আরও বেড়েছে। শুধুই কি পুলিশ গুলি করেছে? না। অনুসন্ধানে জানা গেল, কয়টি ভবন থেকেও গুলি করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী থেকে আহত—অনেকের সাক্ষাৎকার নিলাম। শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করলাম। কে, কোথায়, কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, গুলি কি পুলিশ করেছে, নাকি অন্য কেউ—এসব অনুসন্ধান করলাম। একজনের মৃত্যুর চেয়ে আরেকজনের মৃত্যুকে মনে হচ্ছিল আরও ভয়াবহ। অনুসন্ধান কাজে সাভার থানা রোড ধরে যতবার হেঁটেছি, ততবারই ট্রমার মধ্যে পড়েছি। কখনো সদ্যর মুখ, কখনো বাসচালক মানিকের বাঁচার আকুতি চোখের সামনে এসে যন্ত্রণা দিত। অনুসন্ধানের শুরুর দিকে কয়েকটা রাত নির্ঘুম কেটেছে।

এভাবেই প্রতিটি মৃত্যুর হিসাব অনুসন্ধান করে বের করেছি। এমনকি কতজন আহত হয়েছে, সেটাও বের করেছি। আন্দোলন করেছেন হাজারো মানুষ। একেক জায়গায় ছিলেন একেকজন। অংশ নিয়েছেন একেক সময়। গুলির মুখে পড়ার অভিজ্ঞতাও ভিন্ন। সবকিছু একটি জায়গায় এনেছি। আতঙ্ক, ছোটাছুটি, লাশ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, হাসপাতাল প্রাঙ্গণে গিয়ে গুলি—পুলিশি বর্বরতার সব নিদর্শন সেদিন ছোট্ট এই উপজেলা শহরে মিলেছে।

এসবের মধ্যেও বাসচালক মানিক হোসেনের মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরার অভিজ্ঞতাটা ভোলা যায় না। সরু একটা গলিতে এক দল পুলিশের মুখে পড়ে যান বিক্ষোভকারীরা। সবচেয়ে সামনে মানিক হোসেন, পুলিশের চেয়ে কয়েক হাত মাত্র দূরে। হঠাৎ মানিকের পায়ে এসে লাগে গুলি। আর সারা গায়ে এসে লাগে কিছু ছররা গুলি। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যান তিনি। গড়ান দিয়ে রাস্তার পাশের দেয়ালের কাছে যান। কোনোমতে হেলান দিয়ে বসেন। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে থাকে তাঁর শরীর। ৫–১০ মিনিট পর জ্ঞান হারান।

প্রামাণ্যচিত্রের কাজে তাঁর মুখোমুখি হলাম যখন, তিনি বললেন, ‘আমরা তিন–চারজন রাস্তায় পড়ে রইছি। তারপরও গুলি করছে…। পুলিশ তখন কইলো খালি, নিয়া যান। এই কথাটা আমার কানের আসে। কয় কী, এই লাশগুলো নিয়ে যান।’

সাক্ষাৎকার নেওয়া যে কত কঠিন, শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মিঠুর বাবার সামনে বসে বেশ টের পেলাম। মিঠুর বুকে গুলি লেগে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়, সে বর্ণনাই দিচ্ছিলেন তাঁর বাবা শাহজাহান। বেশ শক্ত হৃদয়ের মানুষ। হাহাকার চেপে রেখেছেন, বোঝা যাচ্ছে। একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার ছেলের পছন্দের খাবার কী ছিল?’

এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আমার হৃদয়ে গিয়ে শেলের মতো আঘাত হানল সেই কান্না।