আজ ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে চারটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত হয়ে গেল ফ্যাশনজগতের সবচেয়ে জমকালো আয়োজন মেট গালা। দুনিয়ার সব ফ্যাশনিস্তা অপেক্ষায় থাকেন এই আয়োজনের জন্য। মে মাসের প্রথম সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টে আসর বসে দুনিয়ার সেরা তারকাদের।
মেট গালা অবশ্য যে সে আসর নয়; বরং তারকা থেকে শুরু করে তাঁদের পোশাক, সবকিছু থাকে আতশি কাচের নিচে। আভিজাত্য ও এক্সক্লুসিভিটিই যার মূল লক্ষ্য। কয়েক মাস আগেই জানিয়ে দেওয়া হয় মেট গালার থিম। সব তারকাই নিজের পোশাক তৈরি করেন সেই থিম মেনে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এ বছরের মেট গালার থিম ছিল ‘সুপারফাইন: টেইলরিং ব্ল্যাক স্টাইল’।
প্রতিবছর মেট গালার থিম নির্ধারিত হয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাম্প্রতিক পটভূমির ওপর ভিত্তি করে। এবার থিম ঠিক করা হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের ফ্যাশন কেন্দ্র করে। এবারের অতিথিদের জন্য পোশাক কোড ‘টেইলরড ফর ইউ’। দাসপ্রথা–পরবর্তী কৃষ্ণাঙ্গদের ফ্যাশন যেভাবে পুরো আমেরিকায় প্রভাব বিস্তার করেছে, নতুন জোয়ার সৃষ্টি করেছে, তার প্রদর্শনীই হবে এবারের মূল লক্ষ্য।
উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে আব্রাহাম লিংকনের প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিরতরে নিষিদ্ধ হয় দাসপ্রথা। যদিও তার প্রায় ৬০ বছর আগে থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আফ্রিকা থেকে দাস আনা নিষিদ্ধ হয় যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হলে কী হবে, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বিরূপ মনোভাব তখনো বেশ ভালোভাবে বিদ্যমান ছিল। নিজেদের অধিকার ফিরে পেলেও সমাজে তখনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি কৃষ্ণাঙ্গরা। ফ্যাশন থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক কার্যক্রম, সমাজের প্রতিটি পদে মুখোমুখি হতে হয়েছে বর্ণবাদের। সমাজের নিচু স্তরে ছিল তাঁদের অবস্থান।
ফ্যাশন–বিশেষজ্ঞরা উপলব্ধি করেছিলেন, সমাজের এই অচলাবস্থা থেকে বের হতে চাইলে সবার আগে প্রয়োজন অর্থনৈতিক মুক্তি, অতঃপর ফ্যাশনের মুক্তি। কথায় আছে, প্রথমে দর্শনদারি এরপর গুণবিচারি। ফ্যাশনের দিক থেকে যদি শ্বেতাঙ্গদের টেক্কা দেওয়া সম্ভব হয়, তবেই সমাজে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করা সম্ভব।
সেই চিন্তাধারা থেকে ফ্যাশনজগতে আবির্ভূত হয় নতুন এক ধারা—‘ব্ল্যাক ড্যান্ডিইজম’। ড্যান্ডিইজম যতটা না ছিল ফ্যাশন, তার চেয়ে বেশি ছিল স্টেটমেন্ট। সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে নিজেদের অবস্থান দেখিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। ড্যান্ডিইজমের সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশ লেখক বাও ব্রামেলের হাত ধরে। আঠারো শতকের দিকে ব্রিটেন তখনো অ্যারিস্টোক্রেটিক ফ্যাশনে মশগুল। সেখান থেকে সরে এসে নতুন ধাঁচের পোশাক পরতে শুরু করেন বাও ব্রামেল। তাঁর কথা ছিল, ‘এমন পোশাক পরো, যাতে তোমার পোশাক নিয়ে কথা না বলতে হয়; বরং পোশাক তোমার হয়ে কথা বলে।’
ধীরে ধীরে ব্রামেলের পোশাক পরিণত হয় নতুন ট্রেন্ডে। কৃষ্ণাঙ্গরা উপলব্ধি করেছিলেন, সমাজে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ফ্যাশনে নতুন কিছু করতে হবে। আর সে পথটা তৈরি করে দিয়েছিল ব্ল্যাক ড্যান্ডিইজম।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নিউইয়র্ক শহরের হারলেম ছিল কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির চারণভূমি। ফ্যাশন থেকে শুরু করে আন্দোলন, সবকিছুর সূচনালগ্নে জড়িয়ে আছে হারলেম। ব্ল্যাক ড্যান্ডিইজম ডানা মেলে এই হারলেম থেকেই। যে কারণে অনেকে বিংশ শতাব্দীর ব্ল্যাক ড্যান্ডিইজমকে আখ্যা দেন ‘হারলেম রেনেসাঁ’ হিসেবে। হারলেম রেনেসাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটাই, কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য আলাদা একটি ফ্যাশন ট্রেন্ড তৈরি করা। যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গে মিশ্রণ ঘটবে ইউরোপীয় স্টাইলের। শার্প স্যুট, উজ্জ্বল রং, পালিশ করা জুতা, বো–টাই, হ্যাট—কৃষ্ণাঙ্গদের নতুন করে সমাজের সামনে পরিচয় করিয়ে দেয় হারলেম রেনেসাঁ। তথাকথিত হোয়াইট ফ্যাশনের বিপরীতে ব্ল্যাক ড্যান্ডিইজম ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিবাদের ভাষা। সমাজের উঁচু পদে যখন শ্বেতাঙ্গরা ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, তখন ব্ল্যাক ড্যান্ডিইজম ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের ফ্যাশনে মুক্তির পথ।
তাই তো প্রায় দেড় শতাব্দী পরও ব্ল্যাক ড্যান্ডিইজম টিকে আছে স্বমহিমায়। টেইলরড স্যুট, উজ্জ্বল রং আর ডিজাইনের সমাহার, হ্যাট—কৃষ্ণাঙ্গ ফ্যাশন ট্রেন্ড এখনো বহাল তবিয়তেই আছে। ব্ল্যাক ড্যান্ডিইজম মিশে গিয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের প্রতিটি পদে পদে। প্রাত্যহিক কাজ থেকে শুরু করে অধিকার আদায়ের আন্দোলন, ব্ল্যাক ড্যান্ডিইজম ছিল নিজেদের খুঁজে পাওয়ার গল্প। হারলেম রেনেসাঁ থেকে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট, ব্ল্যাক ড্যান্ডিইজম কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে যুগে যুগে।
এবারের মেট গালা সেই ইতিহাস আরেকবার সামনে হাজির করল। কয়েক শতাব্দী ধরে কৃষ্ণাঙ্গদের বঞ্চনা ও সংগ্রামের গল্প ফুটে উঠেছে ড্যান্ডিইজমের মাধ্যমে।
সূত্র: ভোগ