
মানবসভ্যতার বিকাশে বিদ্যুতের আবিষ্কার একটি মাইলফলক। এ বিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের হাতে ধরা দিয়েছে অনেক অধরা বিষয়, যা একটা সময় হয়তো মানুষ কল্পনাও করতে পারত না। কিন্তু যেকোনো বড় শক্তি হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় দায়িত্বও কাঁধে আসে। আর সেটা হলো সেই শক্তির যথার্থ ব্যবহার। শক্তি ব্যবহারে সামান্য অসাবধানতা ডেকে আনে ভয়ংকর বিপদ।
১.
বাড়ির ছাদে কয়েকজন বাচ্চা খেলা করছে। খেলতে খেলতেই বাসার পাশ দিয়ে যাওয়া আমগাছের ডালে আম দেখে হাতে একটি রড তুলে নিল একজন। সেই রড দিয়ে ডালের ফলটিতে আঘাত করার চেষ্টা করছে সে। এই হাসিখুশি পরিবেশের মধ্যেই হঠাৎ এক বিকট চিৎকার দিয়ে বাচ্চাটি মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
গাছের ডালের আড়ালে মোটা বৈদ্যুতিক তার ছিল। লোহার রড গিয়ে স্পর্শ করেছিল সেই তারে।
২
রমিজ মিয়া পল্লী বিদ্যুতে চাকরি করেন। খুঁটি বেয়ে তরতর করে উঠতে পারেন খুবই দক্ষতার সঙ্গে। আজকাল আর এত সচেতনতার ধার ধারেন না। মাথায় হেলমেট, হাতে প্লাভস, পায়ে রবারের বুট ছাড়াই চড়ে যান খুঁটির শীর্ষে। এমনি একদিন বৈদ্যুতিক খুঁটিতে কাজ করছিলেন, কিন্তু নিমেষেই কী যেন হয়ে গেল। ছিটকে পড়লেন ২০ ফুট উঁচু খুঁটি থেকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন তিনি।
৩
বাসার বৈদ্যুতিক সুইচ–সকেটের মধ্যে দু–একটি দেওয়া আছে নিচু উচ্চতায়। যা সহজেই শিশুদের নাগালে। এমনই এক সকেটে সবার চোখের আড়ালে চাবি ঢুকিয়ে খেলছিল দুই বছরের শিশুটি। শিশুর হাতটি নিমেষেই পুড়ে কাঠের মতো হয়ে গেল। বাচ্চার মা–বাবা তাকে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে হাসপাতালে। হাত তো বাঁচানো যায়নি, কোনোভাবে যদি জীবনটি বাঁচানো যায়!
ওপরের তিনটি ঘটনাই কাল্পনিক, তবে সত্য ঘটনা অবলম্বনে। এ রকম ঘটনা অহরহই ঘটছে আমাদের আশপাশে এবং আমরা প্রতিদিনই এই ধরনের রোগী পাচ্ছি আমাদের হাসপাতালে। চলুন আজ জেনে নিই এ বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় আসলে কী হয়, হলে কী করণীয় আর এ ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে কী করা যেতে পারে?
সরাসরি স্পর্শে উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ যখন শরীরের এক জায়গা দিয়ে ঢুকে আরেক জায়গা দিয়ে বের হয়, তখন তা শরীরের উপাদানভেদে একেক জায়গায় একেক রকম রোধের সম্মুখীন হয়। যেখানে রোধ যত বেশি, সেখানে তত বেশি তাপ উৎপন্ন হয়। যেমন হাড়ের রোধ বেশি, তাই হাড়ের কাছে তাপও হয় বেশি। এ তাপ থেকেই থার্মাল ইনজুরি, বার্ন বা পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।
আপাত চোখে দেখে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার বার্ন বা পোড়া যতটা দেখা যায়, আসলে ক্ষতি তার চেয়ে অনেক বেশি।
বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় আগুন ধরে: এ পোড়া আগুনে পোড়ার মতোই।
সরাসরি স্পর্শ না করে: এ পোড়াকে বলা হয় ফ্লাশ বার্ন। অর্থাৎ আপনি সরাসরি বৈদ্যুতিক উৎস স্পর্শ করেননি। তবু বিদ্যুৎক্ষেত্রে যে আর্ক বা বলয় তৈরি হয়, সে বলয়ে আপনার উপস্থিতি থাকলেও ঘটতে পারে বার্ন।
কিসের ওপর নির্ভর করবে ক্ষতির পরিমাণ
বিদ্যুতের ভোল্টেজ
বিদ্যুতের ধরন
শরীরের কোন জায়গা দিয়ে প্রবেশ করেছে আর কোন জায়গা দিয়ে বের হয়েছে
কতক্ষণ ধরে চলেছে এ বৈদ্যুতিক ঘটনা
উৎসের স্পর্শে ছিল কি না।
এমন অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ক্ষতির পরিমাণ।
বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় যথাযথ চিকিৎসা করলে বেশির ভাগ সময় জীবন বাঁচানো গেলেও হাত বা পায়ের পোড়ার ক্ষেত্রে সেই হাত বা পা রক্ষা করা হয়ে যায় কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। কারণ, এ বিপদ শুধু চামড়া আর মাংস পোড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, পুড়িয়ে দেয় হাড়, স্নায়ু ও রক্তনালিও। তাই অনেক ক্ষেত্রেই পুড়ে যাওয়া হাত রক্ষা করা সম্ভব হয় না এবং রোগীর জীবন বাঁচানোর স্বার্থে তা অস্ত্রোপচার করে কেটে ফেলতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আংশিক রক্ষা করা গেলেও তা নিয়মিত অবয়বে আনতে প্রয়োজন হয় দীর্ঘমেয়াদি কয়েক দফা প্লাস্টিক সার্জারির।
অনেক ক্ষেত্রে হাত বা পা এমনভাবে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় পুড়ে যায় যে তা সরাসরি পুরোপুরি পুড়ে যায়নি। কিন্তু হাতে বা পায়ে উচ্চ চাপে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হাত বা পা মৃত হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ সময়ই হাতকে বাঁচানো যেতে পারে ফেসিওটোমি নামের এক সার্জারির মাধ্যমে। এর জন্য সময়মতো বার্ন ইউনিটে প্লাস্টিক সার্জনের কাছে আসাটা আবশ্যক। সময় গেলে সাধন হবে না।
হাত–পায়ের বিকলাঙ্গতা
বৈদ্যুতিক পোড়ার অনেক রোগী থাকে, যাদের হাত বা পা টিকে থাকলেও তা আর স্বাভাবিক কর্মক্ষম থাকে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে লম্বা সময় ধরে প্লাস্টিক সার্জারি ও ফিজিওথেরাপির সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা চেষ্টা করে থাকি হাতের কর্মক্ষমতা যতটা সম্ভব ফিরিয়ে আনার।
বৈদ্যুতিক পোড়ায় যে শুধু হাত–পা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা নয়, এর ফলে কিডনি ও হার্ট ফেইলরও হতে পারে। এ দুর্ঘটনার ভয়াবহতা এতই বেশি, যা অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবে না।
প্রথম কথা, আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে আনতে হবে। যদি সম্ভব হয় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটটি বন্ধ করে আক্রান্তকে সরাতে হবে। যদি সার্কিটটি বন্ধ না–ও করা যায়, তবে বিদ্যুৎ অপরিবাহী বস্তু, যেমন কাঠ, রবার গ্লাভস ইত্যাদি ব্যবহার করে খুবই সতর্কতার সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সরাতে হবে।
আক্রান্ত ব্যক্তিকে সরিয়ে নিরাপদ জায়গায় এনে তার পরিধানের সব কাপড় খুলে ফেলত হবে। সাধারণত উচ্চতা থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলে পোড়ার পাশাপাশি মাথায়, বুকে, হাত–পায়ে ইনজুরি থাকতে পারে। সেসব ভালোভাবে লক্ষ করতে হবে। এরপর একজন সাহায্যকারী হাসপাতালে নেওয়ার জন্য পরিবহন ও অন্যান্য ব্যবস্থা করবেন, আরেকজন সাহায্যকারী স্বাভাবিক তাপমাত্রার বহমান পানি দ্বারা পোড়া স্থানটুকু ধুতে থাকবেন। এভাবে ২০ থেকে ৩০ মিনিট ধোয়া হতে হতে অন্যান্য সব ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। যদি রক্তপাতের ঘটনা ঘটে, মাথা ফাটা, বুকের হাড়, হাত–পায়ের হাড় ভাঙার মতো ঘটনা ঘটে, তবে রক্তের গ্রুপ জানা থাকলে দু–একজনকে লেগে যেতে হবে রক্তের সন্ধানে। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে অন্তত দু–একজন ডোনার খুঁজে রাখতে পারলে সুবিধা। এরপর যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ বার্ন ইউনিট বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে আসতে হবে। হাসপাতালের চিকিৎসক রোগীকে দেখে পরীক্ষা করে পরবর্তীর চিকিৎসার নির্দেশনা দেবেন।
প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর। বিশেষ করে সমস্যাটা যদি ইলেকট্রিক বার্নের মতো ভয়ংকর হয়, যা সেরে ওঠা পুরোপুরি প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। চলুন জেনে নিই কী কী সাবধানতা অবলম্বন করলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
• বৈদ্যুতিক লাইন এবং খুঁটিতে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁরা অবশ্যই হাতে মোটা রবারের গ্লাভস, পায়ে সেফটি শু এবং মাথায় হেলমেট ব্যবহার করবেন।
• বাচ্চারা কোনোভাবেই ছাদে বা বারান্দার বাইরের মোটা বৈদ্যুতিক তার যেন হাতে রড বা ধাতব কিছু দিয়ে স্পর্শ না করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের তার মানুষের নাগালে থাকলে তা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিভাগকে লিখিত অভিযোগ করে জানাতে হবে।
• কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্র যেমন মোবাইল, এসি, ল্যাপটপ অতিরিক্ত গরম হলেও তা অতিসত্বর মেরামত করাতে হবে।
• ঘরের ভেতরের বৈদ্যুতিক লাইনগুলো, যেগুলো ছোট বাচ্চাদের নাগালে, সেগুলো অবশ্যই সিকিউরড করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় হলে সেগুলো সিল করে বন্ধ রাখতে হবে।
• মোবাইল ফোন চার্জে লাগিয়ে কথা না বলাই উত্তম।
সব কথার শেষ কথা, ইলেকট্রিক অ্যাকসিডেন্ট বা বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা প্রিভেন্ট করতে প্রয়োজন তিন স্তর সচেতনতা।
প্রথমত, ব্যক্তি পর্যায়ে
দ্বিতিয়ত, সামাজিক পর্যায়ে
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে।
এ তিন পর্যায়ের সম্মিলিত আন্তরিক প্রচেষ্টাই পারে আমাদের এমন বীভৎস একটি বিপর্যয় থেকে মুক্তি দিতে। দিন শেষে আমরা সবাই চাই একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। এমন চাওয়াটা কি খুবই স্বাভাবিক নয়?
ডা. জামান সানি, প্লাস্টিক সার্জন এবং বার্ন বিশেষজ্ঞ, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ঢাকা।