বিশ্ব সোরিয়াসিস দিবস উপলক্ষে প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত হলো বিশেষ অনুষ্ঠান, এসকেএফ নিবেদিত ‘সোরিয়াসিস ও আমাদের করণীয়’। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সোরিয়াসিস অ্যাওয়ারনেস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. মো. সামিউল হক, ইউনাইটেড হসপিটাল ঢাকার ডার্মাটোলজি বিভাগের কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. জিনাত মিরাজ স্বপ্না এবং এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকার ডার্মাটোলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. হাসিবুর রহমান। সঞ্চালনায় ছিলেন এভারকেয়ার হসপিটালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. রুবাইয়া আলী। অনুষ্ঠানটি ৩০ অক্টোবর প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং এসকেএফের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
সোরিয়াসিস একটি দীর্ঘমেয়াদি চর্মরোগ। একবার সেরে যাওয়ার পর এই রোগ আবার হতে পারে। অনেক কারণে রোগটি হয়ে থাকে। যেমন রোগ প্রতিরোধব্যবস্থায় কোনো সমস্যা হলে বা জেনেটিক কারণে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগটা শরীরে সুপ্ত থাকে। আবার কোনো বিশেষ কারণে চামড়ায় প্রকাশ পায়। এই ফ্যাক্টরগুলোর ভেতর আছে খাবার, রোদ, আবহাওয়া, পরিবেশ, ওষুধ ইত্যাদি। সোরিয়াসিস দেখতে লাল বা রুপালি মসৃণ আঁশের মতো। ত্বকের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এটি হয় না।
ডা. হাসিবুর রহমান বলেন, ‘কয়েক রকমের সোরিয়াসিস আছে। একেক রকম সোরিয়াসিসের লক্ষণ একেক রকম। যেমন মাথার ত্বকের কোনো একটি জায়গায় খুশকির চেয়ে পুরু রুপালি মাছের আঁশের মতো চামড়া ওঠে। একে স্ক্যাল্প সোরিয়াসিস বলে। এখানে চামড়া তুললে তা সব জায়গায় ছড়িয়ে যাবে। হাঁটু কনুইয়ে রুপালি রঙের প্লেক টাইপ চামড়া ওঠা ধরনের সোরিয়াসিস রোগের লক্ষণ। পুরো শরীরের ত্বকেই এমন দেখা যেতে পারে। কুঁচকির ভেতর, পায়ের পাতা, নখে, হাতের তালুতে এমন রুপালি আঁশের মতো চামড়া শক্ত হয়ে গেলে বা এর সঙ্গে পুঁজ বের হলে বুঝতে হবে সোরিয়াসিস হয়েছে। কখনো কখনো দেখা যায়, সারা শরীর থেকে এমন চামড়া উঠছে। একে এক্সফোলিয়েটিভ ডার্মাটাইটিস বলা হয়। জয়েন্টে সোরিয়াসিস হলে চলাফেরা করতে অনেক সমস্যা হয়। এখানে আর্থ্রাইটিসের জন্য সোরিয়াসিস হতে পারে, আবার সোরিয়াসিসের জন্য আর্থ্রাইটিস হতে পারে। জয়েন্টে রোগটি হলে অনেক সময় তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। সঠিকভাবে ডায়াগনসিস করতে না পারলে এটি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তাই লক্ষণগুলো দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এই রোগ যেকোনো বয়সে হতে পারে। কিন্তু মধ্যবয়সীদের (১৫ থেকে ৩৫) ভেতর এটি হওয়ার প্রবণতা বেশি।
সোরিয়াসিস রোগটি যদি মুখে বা হাতে–পায়ে হয়, তাহলে রোগীদের দুটি সমস্যা হয়ে থাকে—তারা নিজেরা খুব হতাশ হয়ে নিজেদের আত্মবিশ্বাস হারাতে থাকে এবং আশপাশে যারা থাকে, তারা ছোঁয়াচে রোগ মনে করে তাদের এড়িয়ে চলে। এমন যাতে না হয়, এ জন্য রোগটি নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন ডা. জিনাত মিরাজ স্বপ্না। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথমে রোগীকে কাউন্সেলিং করি। এরপর সরাসরি চিকিৎসায় চলে যাই। যেখানে সোরিয়াসিসের লক্ষণ দেখা দেয়, ত্বকের সেই অংশে চিকিৎসা করা হয়। প্রথমে আমরা টপিক্যাল স্টেরয়েড ব্যবহার করতে বলি নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য। রোগীদের একটা ব্যাপারে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে। সেটি হলো কোথায় প্লেক বা স্কেল দেখা দিলে সেটা টেনে তোলা যাবে না। মোটা চামড়াটি উঠিয়ে ফেললে অন্য জায়গায় আবার সেটা দেখা। আবার বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু ড্রাগ অল্প সময়ের জন্য দেওয়া হয়। এ ছাড়া সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা ওষুধ ও টপিক্যাল ক্রিম আছে।’
তবে সব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে বলে যখন ইচ্ছা তখন দোকান থেকে কিনে এনে সেবন করার ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে। আর সোরিয়াসিস রোগটি যদি শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে এক্সফোলিয়েটিভ ডার্মাটাইটিসের পর্যায়ে চলে যায়, তাহলে শরীরে প্রোটিনের অভাব দেখা দেয়। এমনকি এ জন্য কনজেস্টিভ কার্ডিয়াক ফেইলিউর পর্যন্ত হয়ে যায়। রোগীর এমন অবস্থা দেখা দিলে বেশ সতর্কতার সঙ্গে চিকিৎসা করতে হবে।
ডা. মো. সামিউল হকের কাছ থেকে জানা গেল, সোরিয়াসিস ক্লাবের একটি নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে, যেখানে এই রোগ সম্পর্কে সব তথ্য পাওয়া যাবে। দেশব্যাপী একটি রেজিস্টার প্রক্রিয়া চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী জানুয়ারি মাসে ঢাকায় একটি সোরিয়াসিস ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করা হবে, যেখানে রোগীদের ফটো-থেরাপি ইউনিট থাকবে। এখানে সব রোগী ফলোআপ করতে পারবে।
সোরিয়াসিস এমন কোনো মারাত্মক রোগ নয়, তবে ত্বকের ওপর হয় দেখে দেখতে খারাপ দেখায়। এ জন্য রোগীরা মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়। সারা পৃথিবীতেই রেজিস্টার্ড সোরিয়াসিস রোগীর সংখ্যা ছয় কোটি। এর বাইরেও অসংখ্য রোগী আছে। এ রোগ নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। ডা. মো. সামিউল হকের কাছ থেকে জানা গেল, সোরিয়াসিস রোগবিষয়ক অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরি হয়েছে। এই সংস্থাগুলো এক হয়ে ২৯ অক্টোবরকে বিশ্ব সোরিয়াসিস দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
ডা. মো. সামিউল হক বলেন, ‘আমাদের দেশে ২০১৬ সালে সোরিয়াসিস অ্যাওয়ারনেস ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। চিকিৎসক, রোগী ও শুভাকাঙ্ক্ষী—সবাই এই ক্লাবের সদস্য।কোভিডের আগে আমরা একটি গাইডলাইন তৈরি করেছি সোরিয়াসিস রোগীদের জন্য। ফ্রি ফ্রাইডে ক্লিনিক চালু করেছি, ক্লাবের উদ্যোগে আমরা অনেক সিম্পোজিয়াম, ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারের আয়োজন করছি। এ ছাড়া চিকিৎসকদের ট্রেইনিংয়ের জন্য ওয়েবিনার করছি, রোগীদের সচেতন করছি লিফলেট দিয়ে, টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করছি। সোরিয়াসিস নিয়ে যে ভয় ও কুসংস্কার আছে, সেটা দূর করার জন্য এভাবে সবাইকে সচেতন করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সোরিয়াসিস কোনো ভয়ানক রোগ নয়। এর অনেক ভালো চিকিৎসা এখন আছে। কিন্তু রোগীরা মানসিকভাবে বিপর্যয়ের শিকার হয়। তারা সহজে কারও সঙ্গে মিশতে চায় না। আমরা এই ক্লাবের মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নত করতে চাচ্ছি।’