স্বাস্থ্যখাতে অগ্রযাত্রার ৫০ : পর্ব–৩১

স্বাস্থ্যসেবায় অনন্য কুমুদিনী

কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট বিশ্বাস করে, মানুষের বেশি প্রয়োজন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। দুটি ক্ষেত্রেই ট্রাস্ট গুরুত্ব দেয় নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে।

  • ২০ শয্যার কুমুদিনী হাসপাতাল এখন ১ হাজার ৫০ শয্যার হাসপাতাল।

  • বহির্বিভাগে মেডিকেল কর্মকর্তাকে দেখাতে ফি ২০, অধ্যাপককে দেখাতে ৫০ টাকা।

১৯৩৮ সালে রণদাপ্রসাদ সাহা নিজের জন্মস্থান টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে স্বাস্থ্যের উন্নতি ও শিক্ষার প্রসারে দুটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একটি ভারতেশ্বরী হোমস, অন্যটি শোভাসুন্দরী ডিসপেনসারি। শোভাসুন্দরী ডিসপেনসারি আজকের কুমুদিনী হাসপাতাল। আট দশকের বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠান দুটি দেশে ও বিদেশে সেবামূলক কাজের অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে।

রণদাপ্রসাদ সাহা দেশবাসীর কাছে দানবীর আর পি সাহা নামে পরিচিত। তাঁর শৈশব কেটেছে কষ্টে, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে’ কাজের সময় পাওয়া প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে তিনি মানুষের সেবার কাজে লাগিয়েছেন। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের জন্য তিনি ১৯৪৭ সালে ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মে তিনি পুত্র ভবানীপ্রসাদসহ নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কম্পাউন্ড থেকে অপহৃত হন। পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরসূরিরা ট্রাস্টের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়েছেন, নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরু থেকেই কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট নতুন নতুন চিকিৎসা ও সেবা ব্যবস্থা প্রবর্তন করার চেষ্টা করেছে। উদাহরণ হিসেবে ক্যানসার চিকিৎসার কথা বলা যায়। ১৯৫৪ সালে আর পি সাহা ক্যানসার চিকিৎসার জন্য ডিপ এক্স–রে যন্ত্র এনেছিলেন। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) এর আগে এই যন্ত্র কোনো প্রতিষ্ঠান আনেনি। যন্ত্রের একটি ছবি রয়েছে মির্জাপুরে ট্রাস্টের লাইব্রেরিতে। নিজেদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানকেও সহযোগিতা করেছিলেন আর পি সাহা। ১৯৫৮ সালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ম্যাটারনিটি বিভাগ প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন।

কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব প্রসাদ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা আর পি সাহা বিশ্বাস করতেন, মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। এ ক্ষেত্রে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন জাতি–ধর্মনির্বিশেষে নারী ও সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে। আমরা তাঁর সেই বিশ্বাসকে ধারণ করে ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করে চলেছি।’

কুমুদিনী হাসপাতাল

১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত শোভাসুন্দরী ডিসপেনসারির একটি বহির্বিভাগও ছিল। ১৯৪৪ সালে এই ডিসপেনসারিকে ২০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা হয়। হাসপাতালের উদ্বোধন করেন বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড আর জি কেসি। এটি ছিল এ দেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম দাতব্য আবাসিক হাসপাতাল। গ্রামে এই হাসপাতাল গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের মানুষের কল্যাণ।

বিভিন্ন সময়ে কুমুদিনী হাসপাতালের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০ শয্যা থেকে হয়েছিল ৭৬০ শয্যা। বর্তমানে এটি ১ হাজার ৫০ শয্যার হাসপাতাল। সারা বাংলাদেশের মানুষ এখানে চিকিৎসার জন্য আসেন।

শুরু থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা ছিল বিনা মূল্যে। ১৯৯৪ সাল থেকে কিছু ফি নেওয়া শুরু হয়। হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলেছেন, আর্থিক চাপ কিছুটা কমাতে এটা করতে হয়েছিল। এ ছাড়া এটাও দেখা গেছে যে বিনা মূল্যের চিকিৎসাকে সমাজের একটি অংশ গুরুত্বহীন মনে করে।

বর্তমানে বহির্বিভাগে সেবা নিতে একটি টিকিট কিনতে হয়। টিকিটের মেয়াদ এক মাস। একজন মেডিকেল কর্মকর্তাকে দেখাতে ফি ২০ টাকা। একজন অধ্যাপকের ক্ষেত্রে তা ৫০ টাকা। হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের থাকা, খাওয়া, নার্সিং সেবা ও চিকিৎসা বিনা মূল্যে। প্রতিদিন ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ রোগী ভর্তি থাকে। আর বহির্বিভাগে সেবা নেয় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ রোগী।

১৯৭০ সালে কুমুদিনী হাসপাতালে যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যক্ষ্মা সংক্রামক রোগ। হাসপাতালের ওয়ার্ডে যক্ষ্মা রোগী থাকলে তা অন্য রোগীতেও ছড়াতে পারে—এই আশঙ্কা থেকে যক্ষ্মা রোগীদের হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। হাসপাতালের পাশেই লৌহজং নদী। নদীতে ছই–ঢাকা নৌকায় রেখে যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎস্যা হতো। চিকিৎসক ও নার্সরা সেখানে গিয়ে চিকিৎসা দিতেন। এর নাম ছিল ‘ভাসমান ওয়ার্ড’।

নার্সিং সেবায় কুমুদিনী

আর পি সাহা যখন মির্জাপুরে হাসপাতাল চালু করেন, তখন সারা দেশেই নার্সের সংকট এখনকার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তিনি গ্রামের দরিদ্র, স্বামী পরিত্যাক্তা বা বিধবাদের নার্সের কাজ শিখিয়ে হাসপাতালের সেবায় যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পায় ১৯৭৩ সালে। ওই বছর প্রতিষ্ঠিত হয় কুমুদিনী নার্সিং স্কুল।

শুরুর দিকে নার্সিং স্কুলে বিনা মূল্যে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেতেন শিক্ষার্থীরা। তবে শর্ত ছিল, পাস করার পর নার্সদের কুমুদিনী হাসপাতালে সেবা দিতে হবে। অবশ্য সে সময় তাঁরা কিছু সম্মানীও পেতেন।

এরপর ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমুদিনী নার্সিং কলেজ। কলেজে এখন বিএসসি এবং এমএসসি নার্সিং কোর্স চালু রয়েছে। কুমুদিনী নার্সিং স্কুল ও কলেজ থেকে পাস করা নার্সদের সারা দেশে বিশেষ কদর ও সম্মান আছে।

আরও উদ্যোগ

পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ইচ্ছা কুমুদিনী ট্রাস্টের সব সময় ছিল। ট্রাস্ট তারই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করে কুমুদিনী ওমেন্স মেডিকেল কলেজ। এরপর ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করে কুমুদিনী মেডিকেল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট।

হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার বাইরে আউটরিচ কর্মসূচি আছে তাদের। টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর ও গাজীপুরে প্রতি মাসের নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট স্থানে বিনা মূল্যের চিকিৎসা ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। ক্যাম্পে প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিকরা অংশ নেন। যেসব রোগীকে ক্যাম্পে সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না, তাদের ট্রাস্টের পরিবহনে হাসপাতালে আনা হয়।

সারা দেশে হাসপাতাল বা মেডিকেল বর্জ্য ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা করা হয় না বলে অভিযোগ আছে। সেই অভিযোগ কুমুদিনী হাসপাতালের বিরুদ্ধে তোলার সুযোগ নেই। কর্তৃপক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ২০১৩ সালের ৫ মার্চ হাসপাতালের ‘সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেম’–এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আর ২০১৫ সালের ১ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তা উদ্বোধন করেন।

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবায় এখানেই থেমে নেই কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। ট্রাস্ট নারায়ণগঞ্জে কুমুদিনী ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস অ্যান্ড ক্যানসার রিসার্চ নামের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে। এখানে পৃথক মেডিকেল ও নার্সিং কলেজ থাকবে। গবেষণা হবে ক্যানসার নিয়ে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।