কিডনি ও হৃদ্‌রোগের সম্পর্ক এতটা ঘনিষ্ঠ যে একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটির চিকিৎসা সম্ভব নয়
কিডনি ও হৃদ্‌রোগের সম্পর্ক এতটা ঘনিষ্ঠ যে একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটির চিকিৎসা সম্ভব নয়

কিডনি ও হৃদ্‌রোগ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী, কীভাবে প্রতিরোধ করবেন

কিডনি ও হৃদ্‌রোগ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলে কার্ডিওরেনাল সিনড্রোম বা সিআরএস। বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগের মধ্যে কিডনি রোগ (ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা সিকেডি) ও হৃদ্‌রোগ (কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ বা সিভিডি) আজ মহামারি আকার ধারণ করেছে। গবেষণায় দেখা যায়, কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশেরই হৃদ্‌রোগ থাকে এবং হৃদ্‌রোগীদের মধ্যেও কিডনি রোগের হার অনেক বেশি। আজ ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবসে জেনে নিন হৃদ্‌রোগের সঙ্গে কিডনি রোগের সম্পর্ক ও সচেতনতা সম্পর্কে।

কেস স্টাডি ১

হাসান সাহেবের বয়স ৬৫ বছর, অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। বহুদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁর হৃৎপিণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে এবং হৃৎপিণ্ডের সংকোচনক্ষমতা কমে আসে। সিঁড়ি ভাঙলে শ্বাসকষ্ট হয়, পা ফুলে যায়। একদিন হঠাৎ শ্বাসকষ্ট খুব বেড়ে গেলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।

দুর্বল হৃৎপিণ্ড পর্যাপ্ত রক্ত পাম্প করতে পারছিল না, ফলে হাসান সাহেবের কিডনি পর্যাপ্ত রক্ত পাচ্ছিল না। এ কারণে কিডনি হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দেয়, প্রস্রাব কমে যায় এবং শরীরে ক্ষতিকর বিষাক্ত উপাদান জমতে শুরু করে।

এভাবে হৃদ্‌রোগের কারণে হাসান সাহেবের কিডনি বিকল হয়ে পড়ে। হাসান সাহেব জানতেন, তাঁর হৃদ্‌রোগ হয়েছে, কিন্তু এটা যে কিডনির ওপরও প্রভাব ফেলবে, তা কখনো ভাবেননি।

কেস স্টাডি ২

৩৫ বছর বয়সী গৃহিণী আমেনা বেগম বেশ কয়েক বছর ধরে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভুগছিলেন। এর মূল কারণ ছিল কিডনি প্রদাহ বা গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস ও নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চ রক্তচাপ। শুরুতে শুধু দুর্বলতা ও ক্লান্তি অনুভব করতেন, কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে থাকে। পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখা যায়, তাঁর কিডনি ৮৫ শতাংশ অকার্যকর।

যেহেতু আমেনা বেগমের কিডনি শরীরের অতিরিক্ত লবণ ও পানি বের করতে পারছিল না, তাই শরীরে পানি জমতে থাকে। এই অতিরিক্ত পানি তাঁর হৃৎপিণ্ডের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, পাশাপাশি রক্তশূন্যতার ফলে ধীরে ধীরে তাঁর হৃৎপিণ্ড বড় হয়ে দুর্বল হয়ে যায় এবং তিনি হৃদ্‌যন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর পা ফুলে যায়, রাতে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় এবং প্রচণ্ড ক্লান্ত বোধ করেন। আমেনা বেগমের ক্ষেত্রে কিডনি রোগের কারণেই পরে হৃদ্‌রোগ হয়েছে।

কিডনি ও হৃদ্‌রোগ পরিস্থিতি

সারা বিশ্বে: অনুমান করা হয়, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ কিডনি রোগে ভুগছেন। অন্যদিকে প্রতিবছর কয়েক কোটি মানুষ মারা যান হৃদ্‌রোগে।

বাংলাদেশে: বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৬-২২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও বয়োবৃদ্ধ মানুষ কোনো না কোনো পর্যায়ে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত এবং হৃদ্‌রোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ।

চিকিৎসা

দুটি রোগেরই চিকিৎসা ব্যয়বহুল। ডায়ালাইসিস, কিডনি প্রতিস্থাপন, হার্ট সার্জারি সবকিছুই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। দুটি রোগই জটিল, প্রাণসংহারী এবং উভয় রোগের কারণ ও ঝুঁকি প্রায় একই। যেমন—

উচ্চ রক্তচাপ: উচ্চ রক্তচাপ কিডনি ও হৃদ্‌রোগ—দুটিরই প্রধান কারণ। এটি কিডনির ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলো এবং হৃৎপিণ্ডের প্রধান রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং হৃদ্‌যন্ত্রে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।

ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি—কিডনি রোগের সবচেয়ে বড় কারণ। একই সঙ্গে ডায়াবেটিস ধমনি শক্ত হওয়া, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।

ডিসলিপিডেমিয়া (রক্তে চর্বি বৃদ্ধি): রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড বেড়ে গেলে ধমনি শক্ত হয়ে যায়, যা কিডনি ও হৃদ্‌যন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।

স্থূলতা ও মেটাবলিক সিনড্রোম: অতিরিক্ত ওজন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও প্রদাহ বাড়ায়।

ধূমপান ও অ্যালকোহল: এসব রক্তনালির সরাসরি ক্ষতি করে, উভয় অঙ্গ আক্রান্ত হয়।

বংশগত কারণ ও বয়স: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিডনি ও হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস: এসব প্রক্রিয়া রক্তনালির এন্ডোথেলিয়াম ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা কিডনি ও হৃদ্‌রোগ—উভয়েরই ভিত্তি।

কিডনি ও হৃদ্‌রোগ একে অপরকে সরাসরি প্রভাবিত করে

হৃৎপিণ্ড ও কিডনির আন্তসম্পর্ক

কিডনি ও হৃদ্‌রোগ একে অপরকে সরাসরি প্রভাবিত করে। একে বলা হয় কার্ডিওরেনাল সিনড্রোম (সিআরএস)। এখানে হৃদ্‌যন্ত্রের ব্যর্থতা কিডনির ব্যর্থতা ডেকে আনে, আবার কিডনির ব্যর্থতা হৃদ্‌যন্ত্রকে দুর্বল করে।

কেন এই নিবিড় সম্পর্ক

সোডিয়াম ও পানি জমা: কিডনি কাজ না করলে শরীরে তরল জমে, যা হৃদ্‌যন্ত্রে চাপ সৃষ্টি করে এবং হার্ট ফেইলিউর বাড়ায়।

অ্যানিমিয়া (রক্তাল্পতা): দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীদের রক্তস্বল্পতা হয়, ফলে হৃদ্‌যন্ত্রকে প্রয়োজনের বেশি কাজ করতে হয় এবং হার্ট ফেইল করে।

ক্যালসিফিকেশন: দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ধমনিগুলোতে ক্যালসিয়াম জমে ধমনি শক্ত হয়ে যায়, এতে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।

হরমোনীয় প্রভাব বা আরএএএস, সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম: উভয় রোগেই এসব সিস্টেম সক্রিয় থাকে, যা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং অঙ্গের ক্ষতি ত্বরান্বিত করে

আরও কারণ: কিছু হরমোন ও স্নায়ুতন্ত্রের অতিসংবেদনশীলতা উভয় রোগের কারণে বাড়ে এবং একে অপরের ক্ষতি করে।

হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলিউর হলে কিডনিতে রক্ত সঞ্চালন কমে যায়। কিডনি রোগ বহুগুণে হৃদ্‌রোগের হার বাড়ায়। এভাবেই রোগ দুটি একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।

কীভাবে প্রতিরোধ করবেন

বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত মেয়ার্স-বেরি স্ট্র্যাটেজি হলো কিডনি ও হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধের একটি সমন্বিত পদ্ধতি। এই দুই রোগ আলাদাভাবে মোকাবিলা করলে যথেষ্ট ফল পাওয়া যায় না, তাই একই সঙ্গে প্রতিরোধ করতে হয়। যাঁরা কিডনি বা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছেন অথবা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছেন, তাঁদের অকালমৃত্যু ঠেকাতে ও অযাচিত জটিলতা কমাতে কিছু পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।

প্রারম্ভিক শনাক্তকরণ: কমিউনিটি পর্যায়ে রক্তচাপ, রক্তে শর্করা ও প্রস্রাবের অ্যালবুমিন টেস্টের মাধ্যমে কিডনি ও হৃদ্‌রোগ চিহ্নিত করা।

ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ: নিয়মিত রক্তচাপ, রক্তে চিনি ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা। ঝুঁকিতে থেকে ব্যক্তিকে প্রাথমিক অবস্থায় চিহ্নিত করে চিকিৎসার আওতায় আনা।

জীবনধারার পরিবর্তন: কম লবণ, কম চর্বি, প্রচুর ফল-সবজি খাওয়া। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম। ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার। স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা।

সমন্বিত চিকিৎসা: হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ, কিডনি বিশেষজ্ঞ ও প্রাথমিক চিকিৎসকদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

রোগীর সচেতনতা: রোগীদের বোঝাতে হবে কিডনি রোগ মানেই হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বেশি।

নীতিগত উদ্যোগ: সরকারি পর্যায়ে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচি শক্তিশালী করা, প্রয়োজনীয় ওষুধ সহজলভ্য করা, ডায়ালাইসিস ও কার্ডিয়াক সেবা সাশ্রয়ী করা।

কেবল প্রস্রাব ঠিকঠাক হলেই বলা যাবে না যে আপনার কিডনি ভালো আছে

শেষ কথা

কিডনি ও হৃদ্‌রোগের সম্পর্ক এতটা ঘনিষ্ঠ যে একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটির চিকিৎসা সম্ভব নয়। উভয় রোগের ক্ষেত্রে কারণ ও ঝুঁকি একই রকম।

একই রোগপ্রক্রিয়া এবং একে অপরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা এই দুই রোগকে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসংকটের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।

কাজেই এই প্রাণঘাতী রোগ দুটি প্রতিহত করতে আলাদা করে নয়; বরং একসঙ্গে প্রতিরোধ করতে হবে।

অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ, কিডনি রোগ বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সভাপতি, কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস)