বৃষ্টির মৌসুমে বাড়ে নানান রোগবালাই। ঘরে ঘরে এখন যেমন জ্বর। জ্বরের সঙ্গে অনেকের আবার মাথাব্যথা বা গায়ে ব্যথাও আছে। কারও বমি বমি ভাব কিংবা বমিও হচ্ছে। কারও দেখা দিচ্ছে র্যাশ বা ফুসকুড়ি। কেউ অল্প কদিনের জ্বরেই হয়ে পড়ছেন দুর্বল। কারও আবার জয়েন্টে ব্যথা রয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন। কেবল বর্ষায়ই নয়, বর্ষা–পরবর্তী মৌসুমেও এ ধরনের উপসর্গ থেকে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে অন্যান্য রোগজীবাণু ছাড়াও মশাবাহিত জীবাণুর সংক্রমণ বাড়ে। তবে ঠিক কোন জীবাণুর সংক্রমণের কারণে এসব উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, সব সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তা ধরা না-ও পড়তে পারে।
ধানমন্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. সাইফ হোসেন খান বলেন, ‘এ বছর চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। আর ডেঙ্গু জ্বর তো আগে থেকেই আছে। সঙ্গে জিকা–সংক্রমণও বেড়েছে।
এ তিনটিই ভাইরাসজনিত রোগ, যা মশার মাধ্যমে ছড়ায়। কোথাও কোথাও করোনাভাইরাসের সংক্রমণও হচ্ছে। এ ছাড়া মৌসুমি ফ্লু, টাইফয়েড, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, প্রস্রাবে সংক্রমণের মতো সমস্যাও হতে পারে।
তবে ভাইরাসের কারণে জ্বর হলে কখনো কখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা না-ও পড়তে পারে। রিপোর্ট নেগেটিভ হলেও জ্বরের মতো একটি উপসর্গকে অবহেলা করার সুযোগ নেই।’
চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু জ্বর আর জিকা ভাইরাসের উপসর্গ অনেকটা একই রকম। এমনকি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মৃদু পর্যায়ে থাকলেও কখনো কখনো জ্বর আর দুর্বলতা ছাড়া তেমন কোনো উপসর্গ না-ও থাকতে পারে।
জ্বর এলেই যে বিষয়টি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, তা হলো পর্যাপ্ত পানি বা তরল গ্রহণ। এটিই সবচেয়ে জরুরি। কেবল জ্বরের কারণেই দেহ পানিশূন্যতায় ভুগতে পারেন। পানিশূন্য দেহ সহজেই অবসন্ন হয়ে পড়ে।
জ্বর এলে গোসল করলেও ক্ষতি নেই; বরং তাতে আপনি কিছুটা স্বস্তি পাবেন। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা হবে উপসর্গভিত্তিক। জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল খাবেন। কোনো ব্যথানাশক গ্রহণ করবেন না। কারণ, আপনার যদি ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে, তাহলে ব্যথানাশক সেবনের ফলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়বে।
তাই ডেঙ্গু জ্বর হয়নি, চিকিৎসক সেটি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ব্যথানাশক নয়; বরং ব্যথার স্থানে মিনিট কুড়ির জন্য দুই বেলা গরম সেঁক দিতে পারেন। বমি বা পাতলা পায়খানা হলে ওরস্যালাইন খাবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী বমির ওষুধ কিংবা অ্যান্টিহিস্টামিন–জাতীয় ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।
তবে শ্বাসকষ্টের রোগীরা আবার যেকোনো অ্যান্টিহিস্টামিন সেবন করতে পারেন না, তা–ও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করবেন না। হিতে বিপরীত হতে পারে। জ্বরের রোগীর বিশ্রাম প্রয়োজন।
শরীরকে বিশ্রাম দিন। বিশ্রাম দিন মস্তিষ্ক এবং চোখজোড়াকেও। ঘরে শুয়ে–বসে মুঠোফোন স্ক্রল করবেন না। চিকুনগুনিয়ার ব্যথা উপশমে কিছু ব্যায়াম কাজে দেয়। এসব ব্যায়ামও শিখে নিতে পারেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল নেগেটিভ হলেও এসব বিষয় মেনে চলুন। উপকার মিলবে।
শুরু থেকেই যদি উপসর্গের তীব্রতা বেশি থাকে, তাহলে চিকিৎসকের কাছে যেতে দেরি করবেন না। মাঝারি তীব্রতার উপসর্গ থাকলে দিন তিনেক অপেক্ষা করতে পারেন। এর মধ্যে উন্নতি না হলে চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে।
তবে কিছু বিপদচিহ্নের বিষয়ে খেয়াল রাখুন। মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট, তীব্র পেটব্যথা, শরীরে পানি আসা, বারবার বমি হওয়া, অতিরিক্ত দুর্বলতা, অস্থিরতা বা নিস্তেজ বোধ করার মতো উপসর্গ দেখা দিলে জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসা নিন।
খুব খারাপ লাগলে, অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হলে বা কোনো ফুসকুড়ি দেখা দিলে দ্রুততম সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন অবশ্যই। নারীর ক্ষেত্রে জ্বরের সময় বা জ্বরের কিছুদিন পর মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণও একটি বিপদচিহ্ন হতে পারে।
ভাইরাসজনিত জ্বরের ক্ষেত্রে কখনো কখনো সব পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসতে পারে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোন ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে তা বোঝা যায় না। জ্বরের কততম দিনে কোন পরীক্ষা করা হচ্ছে, তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ডেঙ্গু জ্বরের কথাই ধরা যাক। ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকলেও জ্বরের কিছুদিন পেরিয়ে যাওয়ার পর ডেঙ্গু এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসবে। আবার শুরুতেই যদি ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা হয়, তখন সেটি নেগেটিভ আসবে। জ্বরের কারণ খোঁজার পরীক্ষা নিজে নিজে না করিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া আর জিকা ভাইরাস শনাক্ত করার আধুনিক পরীক্ষা হলো আরটি–পিসিআর, যার মাধ্যমে রোগনির্ণয়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তবে দেশের সব চিকিৎসাকেন্দ্রে এই পরীক্ষার সুযোগ নেই। এমনকি বিপদচিহ্ন থাকলেও পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ এলেও জ্বরকে অবহেলা করা যাবে না।
পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও কিছু রক্ত পরীক্ষা থেকে চিকিৎসক ধারণা করতে পারেন কোন ধরনের সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে। সেই অনুযায়ী তিনি পরবর্তী নির্দেশনা দেবেন।