গ্রীষ্মকালে গরম তো থাকবেই। বৃষ্টি হওয়ায় কিছুদিন হয়তো স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে। বারান্দা বা ছাদে আমাদের শখের বাগানজুড়ে যে গাছগুলো আছে, গরম থেকে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে আমরা কী করছি? এই গরমে নিজের খেয়াল রাখার পাশাপাশি গাছপালারও যত্ন নিতে হবে। এ বিষয়ে জরুরি কিছু পরামর্শ দিয়েছেন এ আর গ্রীন গার্ডেনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবেল ইসলাম আকন্দ।
গাছ রাখার উপযুক্ত জায়গা
ছাদ বা বারান্দাবাগানের ক্ষেত্রে গাছ রাখার জায়গা নির্বাচনটা সঠিক হতে হবে। তপ্ত রোদের ধকল থেকে বাঁচাতে গাছকে এমন স্থানে রাখতে হবে, যেখানে নিয়মিত আলো-বাতাস আসে, তবে সরাসরি কড়া রোদ পড়ে না। এই গরমে টবে লাগানো গাছের যত্ন নেওয়া সবচেয়ে জরুরি। প্রথমেই সরাসরি চড়া রোদ পড়ে, এমন জায়গা থেকে টবগুলো সরিয়ে ফেলুন।
ছায়ার ব্যবস্থা
যেখানে বাগান করছেন, সরাসরি রোদের তীব্রতা ঠেকাতে সেই জায়গায় গ্রিনশেড দিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করে দিন। একটা লোহা বা কাঠের নির্দিষ্ট ফ্রেমের ওপর বাজার থেকে কেনা ঘন তারজালি বা ঘন প্লাস্টিকের নেট বা বিশেষ কোনো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে পারেন। ঘরের পুরোনো চাদর, পুরোনো জানালার পর্দা বা কাঠের ছাউনিও ব্যবহার করতে পারেন। যা-ই হোক, নিশ্চিত করুন যেন কভারটি গাছের অন্তত কয়েক ইঞ্চি ওপরে রাখা হয়। ঠিকঠাকভাবে তৈরি করা গেলে কভারগুলো সূর্যের আলোর প্রায় ৫০ শতাংশ ঠেকাতে পারে। ফলে গাছগুলো যথেষ্ট শীতল থাকে।
বড় গাছের পাশে ছোট গাছ
গাছেরাই হতে পারে গাছের বন্ধু। ছাদের বেড বা হাফ ড্রামে থাকা বড়, শক্ত-সমর্থ গাছপালা তার চেয়ে আকারে ছোট গাছপালা ও সবুজ শাকসবজির জন্য ছায়া প্রদান করতে পারে। এই কৌশল মেনে আপনি আপনার বাগানের গাছের বিন্যাসে পরিবর্তন আনতে পারেন।
গাছের সমস্যা বুঝতে শিখুন
গরমের প্রভাব কোন গাছকে কাবু করে দিচ্ছে, তা চট করে যদি ধরতে পারেন, তাহলে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে গাছকে রক্ষা করতে পারেন। যে গাছের পাতা অধিক পুরো ও রসালো, তা রোদের তীব্রতায় শুকিয়ে যেতে থাকে। একসময়ের উজ্জ্বল সবুজ পাতা ধীরে ধীরে হয়ে আসতে পারে ফ্যাকাশে। পাতা ও কাণ্ডের রুক্ষ বাদামি বা হলুদ দাগেও রোদে পোড়ার বিভিন্ন দিক প্রকাশ পায়। বেঁকে গিয়ে শুকিয়ে যেতে পারে পাতা। অত্যধিক গরমের কারণে পাতা, ফুল ও ফল প্রায়ই ঝরে পড়ে। এমন সমস্যা খেয়াল করামাত্রই দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
গাছের গোড়ায় মালচিং
বাগানে নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করে গাছের গোড়ায় মালচিংয়ের ব্যবস্থা করে দিন। মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণে ও ঠান্ডা রাখতে মালচিং বিশেষ উপকারী। প্রায় ১০-২৫ শতাংশ আর্দ্রতা ধরে রাখা সম্ভব। সাধারণত কচুরিপানা, গাছের শুকনো ঝরা পাতা, পরিষ্কার করা আগাছা, ঘাস, ধান বা গমের খড়, কম্পোস্ট, ভালোভাবে পচানো রান্নাঘরের জৈব আবর্জনা ইত্যাদি সহযোগে গাছের চারপাশের মাটির উপরিভাগ ঢেকে দিতে পারেন। গাছের গোড়া, সবজির বেড এবং ফলবাগানে মালচিং দেওয়ার ক্ষেত্রে গাছের গোড়া থেকে এক থেকে দুই ইঞ্চি বা আড়াই থেকে ৫ সেন্টিমিটার দূর থেকে মালচিং করা ভালো। মালচিংয়ের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদার্থ অবশ্যই ৫ সেন্টিমিটার বা ২ ইঞ্চির বেশি পুরু করে দেওয়া ঠিক নয়।
পানি দেওয়ার উপযুক্ত সময়
এই গরমে পানি দেওয়ার উপযুক্ত সময় খুব সকাল। রোদের তেজ বাড়ার আগে এবং শেষ বিকেলে বা সন্ধ্যায় যখন রোদের তেজ কমে আসবে। প্রখর রোদে কখনোই পানি দেওয়া যাবে না। যদি কৃত্রিমভাবে বৃষ্টির মতো চারপাশজুড়ে পানি ছিটিয়ে দেওয়ার মতো স্বয়ংক্রিয় স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম থাকে, তাহলে তা রাতে ব্যবহার করুন।
গরমেও গাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি দেওয়া যাবে না। পানি দেওয়ার আগে মাটির অবস্থা দেখে নিতে হবে। মাটি যদি স্যাঁতসেঁতে থাকে, তাহলে গাছে পানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। গাছের গোড়ায় পানি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন বিকেলে সম্পূর্ণ গাছের পাতা পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিন।
বাগানের যে অংশটি ঘাসে আবৃত, সেখানে খুব একটা পানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এই সময়ের রোদে পুড়ে ঘাস একটু বিবর্ণ হয়ে এলেও বর্ষার বৃষ্টিতে আবারও সবুজ-সতেজ হয়ে উঠবে।
এখন টব বদল নয়
সাধারণত একই টবে একটি গাছ অনেক বছর ধরে থাকলে শিকড়ে পুরো টব ছেয়ে যায়। গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। একইভাবে ফুল-ফল ধরাও কমে যায়, ক্ষেত্রবিশেষে ফুল-ফল ধরা বন্ধ হয়ে যেতেও পারে। এমন হলে ওই টব থেকে গাছটিকে তুলে বড় আকারের টব বা ড্রামে স্থানান্তর করি। কিন্তু এই রি-পটিং বা টব বদলের জন্যও এই সময় উপযুক্ত না।
প্রুনিং বা ডালপালা ছাঁটাই
সদ্য ফলন শেষ হওয়া কুল বা বরইগাছ ছাড়া অন্য কোনো গাছের ডালপালা প্রচণ্ড গরমের এই সময়ে ছাঁটাই করা উচিত নয়। তবে রোগাক্রান্ত ও মরা ডালপালা প্রয়োজনে ছাঁটাই করা যেতে পারে।
সার প্রয়োগে সতর্কতা
যদিও সার গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও খাদ্যচাহিদা মেটায় তবুও সার প্রয়োগের জন্যও সময়টা ভালো না। অতিরিক্ত গরমে সারের প্রয়োগ গাছের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষ করে রাসায়নিক সার এই সময় ব্যবহার না করাই ভালো। প্রয়োজন হলে জৈব সার ব্যবহার করতে পারেন। যেমন শুকনো গোবর সার, কেঁচো সার, কলার খোসা, পেঁয়াজ-রসুনের খোসা, ফেলে দেওয়া চা-পাতা, ডিমের খোসার চূর্ণ করা পাউডার সার ইত্যাদি।
ভিটামিন ও কীটনাশক স্প্রে করায় সতর্কতা
এই সময় ভিটামিন-জাতীয় পুষ্টি উপাদান যেমন ফ্লোরা ও পিজিআর এবং কীটনাশক ব্যবহার না করাই ভালো। তবে ১০-১৫ দিন পরপর কপার অক্সিক্লোরাইড ও ম্যানসার ইত্যাদি ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে পারেন।
এতে গাছগুলো গ্রীষ্মের প্রচণ্ড এই তাপপ্রবাহের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবে। গাছকে রাখবে সবুজ-সতেজ ও প্রাণবন্ত—ঠিক আগে যেমনটা ছিল।