এখনো গ্রামের কোথাও কোথাও টিকে আছে কাছারিঘর
এখনো গ্রামের কোথাও কোথাও টিকে আছে কাছারিঘর

এ রকম কাছারিঘরে থাকার অভিজ্ঞতা কি আপনারও আছে

জমিদারদের কাছারিবাড়ির ধারণা নিয়ে একসময় গ্রামের সম্ভ্রান্ত বাড়িগুলোতেও তৈরি হতে থাকে কাছারিঘর। মূল বাড়ির চৌহদ্দির একটু বাইরে এই ঘর হয়ে ওঠে পুরুষদের আড্ডা, সমাজ–সামাজিকতার প্রধান কেন্দ্র। বাড়ির উঠতি কিশোর–তরুণদের পড়াশোনার কাজেও ব্যবহৃত হতো এসব ঘর। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা গ্রামীণ জীবনের সেই কাছারিঘরে থাকার অভিজ্ঞতা লিখেছেন তুহিন সাইফুল্লাহ

কাছারি-ঘরের পিছন দিকে একখানা ছোটো পুকুর। তার দক্ষিণ পারে একমুঠো মতো একটুখানি মাঠ। তার পরে শাল, পিয়াল, সেগুন, গাব, অশ্বত্থ ইত্যাদি গাছের জঙ্গল।’

ছিন্নপত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    সাঁইথিয়া, ১৮৯৩

রবীন্দ্রনাথের কল্যাণে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর কিংবা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে ঠাকুর পরিবারের জমিদারির কাছারিবাড়ি আমাদের কাছে অতিপরিচিত। জমিদারির তদারক করতে শিলাইদহে পদ্মাতীরের কাছারিবাড়িতে অনেক সময় কাটিয়েছেন কবি। রচনা করেছেন অনেক বিখ্যাত কবিতা ও গান। শাহজাদপুর ও পতিসরের কাছারিবাড়িগুলোতেও তিনি বেশ কিছু সময় কাটান।

কালের পরিক্রমায় লুপ্ত হয়েছে জমিদারি প্রথা। তবে কাছারিবাড়ি উঠে যায়নি, গ্রামের উচ্চ ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে কাছারিঘর নামে পরিবর্তিত রূপে রয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে সেটা বৈঠকঘর, বাংলাঘর নামেও পরিচিতি। তেমন একটি ঘরে কেটেছে আমার শৈশব–কৈশোর।

কাছারিঘর যেন বাড়ির বুকের কাছে রাখা এক গোপন মন, যেখানে শুধু তারুণ্য, স্বাধীনতা আর সৃষ্টির স্বপ্ন খেলা করত। বর্ষার দিনে কাছারিবাড়ির চারপাশের উঠানে পানি জমে ছোট ছোট পুকুরের মতো হয়ে যেত

ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার কোঠাপাড়া গ্রামে আমার নানার মূল বাড়ির বাইরে এক পাশে একটু নিরালায় ছিল এই কাছারিঘর। নানার কাছ থেকে শোনা, একসময় এই ঘরের বারান্দায় বসে নানার বাবা এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। সমাজ–ইতিহাস নিয়ে কথা বলতেন। দেশভাগ, গান্ধী–জিন্নাহ–নেহরু–প্যাটেল—অনেক কিছুই থাকত সেই আলোচনায়। বাবার মৃত্যুর পর নানা এই বারান্দায় মাঝেমধ্যে আসতেন, বসতেন। আমার স্কুলজীবন শুরুর পর খুব কমই তাঁকে দেখেছি। হাতে গোনা কয়েকবার এসেছেন মূলত আমার পড়াশোনার খোঁজ নিতে। আরেকবার এসেছিলেন লাঠি হাতে—মারতে নয়, ভয় দেখাতে। কারণ, আমরা সমবয়সী কয়েকজন উচ্চ স্বরে কথা বলছিলাম, তা–ও আবার নামাজের সময়। পাশেই ছিল পাকা মসজিদ, আশপাশের অনেক মানুষ সেখানে আসতেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে।

লাল ইটের দেয়াল, মাটির মেঝে, শণের চাল আর চারপাশে গাছগাছালি মিলিয়ে ঘরটির ছিল যেন এক নিজস্ব জগৎ। বড়দের আনাগোনা খুব কম, তাই আশপাশের তরুণদের প্রিয় আড্ডাস্থল হয়ে ওঠে এই ঘর। সকাল থেকে বিকেল—প্রতিদিন সেখানে চলত আলো-ছায়ার খেলা। জানালা-দরজাগুলো সব সময় খোলা থাকত। পুবের ফুরফুরে বাতাস সারাক্ষণ ঘরে ঢুকে প্রাণ জুড়াত। সেই বাতাসে কখনো মিশে থাকত কাঁঠালের গন্ধ, কখনো আমের মিঠে সুবাস।

ফরফর করে ওড়াউড়ি করত বইয়ের পাতা। রাত হলে দূরের বাঁশঝাড়ে ঝিঁঝি পোকার ডাক মিশে তৈরি করত অন্য এক সুর। এই কাছারিঘর যেন বাড়ির বুকের কাছে রাখা এক গোপন মন, যেখানে শুধু তারুণ্য, স্বাধীনতা আর সৃষ্টির স্বপ্ন খেলা করত। বর্ষার দিনে কাছারিবাড়ির চারপাশের উঠানে পানি জমে ছোট ছোট পুকুরের মতো হয়ে যেত। বাতাসে থাকত কাঁচা মাটির ঘ্রাণ আর নতুন ঘাসের সজীবতা। মাঝেমধ্যে বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠত আকাশ, ঘরে চলত আলো-আঁধারির খেলা। শীতের সকালে কাছারিবাড়ির চারপাশে ঘাসের ফোঁটায় জমে থাকত শিশির। মাঝেমধ্যে কেউ শাল জড়িয়ে আসত, কেউ বারান্দার মাদুরে বসে আগুন পোহাত। কাঁথা গায়ে জড়িয়ে মিষ্টি রোদে বসে মুড়ি খাওয়া আর কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে উঁকি দেওয়া ছিল শীতের সকালের নিয়মিত চিত্র। হেমন্তে কাছারিবাড়ির সামনের উঠানে শুকানো হতো ধান। চারপাশে তখন থাকত বাড়তি এক ব্যস্ততা। বাতাসে থাকত ধান আর ঘামের ঘ্রাণ।

এসএসসি পাস করার পর ঢাকায় চলে আসি, ভর্তি হই ঢাকা কলেজে। এইচএসসি পরীক্ষার পর গিয়ে দেখি, ঘরটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে মনোজগতে এই ঘর আজও বেঁচে আছে। শহরের ব্যস্ত জীবনে একাকী মুহূর্তে পুরোনো দিনের কথা ভাবলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে কাছারিবাড়ি। প্যাঁচার ডাক, বাতাসে ফরফর করে ওড়া বইয়ের পাতা—সব মিলিয়ে অপূর্ব এক শান্তি।