
এ বছর রসায়নে নোবেল পেয়েছেন জাপানি রসায়নবিদ সুসুমু কিতাগাওয়া। তিনি জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একটি সাক্ষাৎকারে গবেষণা, জীবনদর্শনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। পড়ুন তাঁর কথামালার নির্বাচিত অংশ।
ছাত্রাবস্থায় একটি দারুণ বই পড়েছিলাম—দ্য ওয়ার্ল্ড অব জিনিয়াস। লিখেছেন নোবেলজয়ী পদার্থবিদ অধ্যাপক হিদেকি ইউকাওয়া। বইতে চীনা দার্শনিক চুয়াং সুর একটি দর্শন পড়ে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। বিশেষ করে তাঁর একটি ধারণা আমাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল—‘অপ্রয়োজনীয়র প্রয়োজনীয়তা’ (দ্য ইউজফুলনেস অব ইউজলেস)।
আজকের দিনে অধিকাংশ গবেষক সেই বিষয়েই মনোযোগ দেন, যেগুলো ‘প্রয়োজনীয়’ বলে বিবেচ্য। ওসব বিষয়েই তাঁরা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন; কিন্তু ‘অপ্রয়োজনীয়র প্রয়োজনীয়তা’ এমন সব বিষয় নিয়ে ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছিল, যেগুলো শুরুতে ‘অপ্রয়োজনীয়’ মনে হয়। যেমন পোরাস (ছিদ্রওয়ালা কাঠামো)।
পোরাসকাঠামো নিয়ে কাজ করাকে কেউ গুরুত্ব দিত না। কারণ, সবাই ঘন কাঠামো নিয়েই কাজ করছিলেন। কারণ, ওগুলোকেই কার্যকর কঠিন পদার্থ তৈরির জন্য দরকারি মনে করা হতো; কিন্তু আমরা ভাবলাম, পোরাসের ‘ফাঁকা জায়গাগুলো’ হয়তো আয়ন বা অণুকে ধরে রাখা, চেনা, পরিবহন কিংবা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে। তাই এ নিয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম।
সে সময় সবাই বিশ্বাস করতেন, জৈবপদার্থ দিয়ে কোনো স্থিতিশীল ছিদ্রযুক্ত গঠন তৈরি করা সম্ভব নয়। ফলে অনেকেই ভাবতেন, আমরা ‘অপ্রয়োজনীয়’ গবেষণা করছি। কারণ, তাঁরা বুঝতে পারেননি এই আপাততুচ্ছ ছিদ্রগুলোর ভেতরের ফাঁকা জায়গা কতটা সম্ভাবনাময় হতে পারে।
কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের গবেষণার একটি শক্তিশালী ধারা হলো—সব সময় এমন কিছু বেছে নেওয়া, যেটি নিয়ে কেউ ভাবেননি, কেউ আগ্রহ দেখাননি। তারপর সেটির ভেতর থেকে একেবারে নতুন একটি জ্ঞানের দরজা খুলে দেওয়া।
আমার কাছে ৫০ বছর বয়স একটি জাদুর সময়। পঞ্চাশের আগ পর্যন্ত আমার গবেষণার কাজ রসায়নের কোনো ক্ষেত্রেই তেমন স্বীকৃতি পায়নি, এমনকি বড় কোনো গবেষণা অনুদানও আমি পাইনি। ১৯৯৭ সালে আমার বয়স যখন ৪৬, তখন প্রথমবার দৃঢ় বা মজবুত এমওএফ (মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক) নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করি।
তখন সেটি কোনো স্বীকৃতি পায়নি। কিন্তু এরপর থেকেই এমওএফ–সংক্রান্ত গবেষণার কারণে রসায়নের জগৎ আমাকে দ্রুত আপন করে নেয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বহু গবেষক এ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। কারণ এর ধারণা ছিল সহজ ও সরল। পঞ্চাশে পৌঁছানোর পরই আমি যথেষ্ট পরিমাণ গবেষণা তহবিল পেতে শুরু করি।
পরে যখন আরও বড় সাফল্য অর্জন করলাম, ভালো কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশ করলাম, তখন স্বাভাবিকভাবেই আরও বড় তহবিল পেলাম। জাপান সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এজেন্সি (জেএসটি) আমাদের অর্থায়ন করতে শুরু করল।
সাফল্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দলগত কাজ, অর্থাৎ দলের সঙ্গে কাজ করার দক্ষতা। জাপানে এ বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন আমাদের দলে শুধু সহকারী আর সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন; পূর্ণকালীন পোস্টডক বা গবেষক নিয়োগের মতো অর্থায়ন ছিল না। পিএইচডি শিক্ষার্থীরাও সাধারণত তাঁদের মা-বাবার আর্থিক সহায়তায় পড়াশোনা করতেন।
এমন সীমিত মানবসম্পদ নিয়ে দলগত কাজ করার প্রথম শর্ত হলো—দলের প্রত্যেককে বুঝতে হবে আমরা যা করছি তার মূল্য কী। সবাইকে একই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু অন্যদের সেই দলে যোগ দিতে রাজি করানো সহজ ছিল না।
আমি কীভাবে দল পরিচালনা ও সাংগঠনিক কাজে দক্ষ হয়ে উঠলাম, বলি।
কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার পর ওসাকার কিনদাই বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক জীবন শুরু করি। সেখানে ১৩ বছর কাজ করেছি। এটি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে গবেষণা করা বেশ কঠিন ছিল। গবেষণাগারের অবস্থা ভালো ছিল না। তা ছাড়া আমাকে প্রচুর ক্লাস নিতে হতো। বিভাগীয় ও নানা প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করতে হতো।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণাপত্র লেখা এবং ১৩ জন স্নাতক শিক্ষার্থীকে পড়ানো—এই তিন কাজ আমি একসঙ্গে করতাম। সময়টা ছিল খুব কঠিন; কিন্তু এটিই ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কর্মজীবনের বাস্তবতা।
পরে চলে যাই টোকিও মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে। এটি জাতীয় নয়, একটি পৌর (মিউনিসিপ্যাল) বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল আরও কম। আর আমার ল্যাবে কিছু শিক্ষার্থী ছিল খুবই স্বাধীনচেতা। তাদের পরিচালনা করতে গিয়ে আমি দল গঠন ও একসঙ্গে কাজ করার কলাকৌশল ভালোভাবে রপ্ত করি।
এরপর আবার ফিরে আসি কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী খুব মেধাবী; কিন্তু তারা খুব একটা অনুগত নয়। তবু ধীরে ধীরে অনেক ভালো শিক্ষার্থী, পোস্টডক এবং গবেষককে রাজি করিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছি, আমরা অসাধারণ ফল পেয়েছি।
এভাবে বেসরকারি, পৌর এবং জাতীয়—তিন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা আমার গবেষকজীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। এর মাধ্যমে আমি শিখেছি, কীভাবে একটি গবেষণাগার পরিচালনা করতে হয়। অধ্যাপকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কীভাবে সবাই মিলে এক লক্ষ্য অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করতে হয়। কীভাবে পাঠদান ও নেতৃত্ব দুটি একসঙ্গে সামলাতে হয়।
সূত্র: এসিএস পাবলিকেশনস