Thank you for trying Sticky AMP!!

সুশি

রসনা নয়, জীবদর্শন

সহজ ও সুপাচ্য। স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু। রসনা মাত্রাময় হয়ে ওঠে কালোত্তীর্ণ শিল্পসুষমায়। সংস্কৃতির অংশ হয়ে সেই পদ ভুবনাদৃত হয়েছে। প্রচার করে চলেছে জাপানিদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারণের মাহাত্ম্য।

যেকোনো সংস্কৃতির বিশেষ একটি এবং বলতে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাদের খাদ্যাভ্যাস। জাতি ও অঞ্চলভেদে খাদ্যাভ্যাসই মূলত একটি বিশেষ সংস্কৃতিকে পরিবেশন করে সুন্দরভাবে।

সুশির রয়েছে আলাদা রসনাসংস্কৃতি

প্যান এশিয়ান কুইজিনের একটি বড় অংশই আবর্তিত হয় এই সুশিকে ঘিরে। জন্মস্থান চীন হলেও এ খাবারের উন্নতি ও বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে জাপানিদের ভূমিকাই মুখ্য। মূল উপকরণ ভাত-মাছ হলেও এ খাবার তৈরির কৌশলে আছে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য। এ ছাড়া বিভিন্ন সবজির সমন্বয়ে সুশি তৈরি করা হয়ে থাকে।

এটি জাপানিদের জৈবিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা এবং সুনির্দিষ্টতার মতাদর্শকেও একভাবে প্রচার করে থাকে। কেননা, এ খাদ্য একধরনের শিল্প ও নিদর্শনও বটে। তাই একজন দক্ষ সুশি শেফের দরকার বহু বছরের চেষ্টা ও ভিন্ন আঙ্গিকের কৌশল রপ্ত করতে জানা। যদিও এ খাবারের সৃষ্টির ইতিহাস মূলত খাদ্য সংরক্ষণ ও প্রয়োজনের জন্য সহজ উপায়ে বহন করার চিন্তা থেকে, কিন্তু কালক্রমে এটি পরিণত হয়েছে অনন্য এক শিল্পে।

প্রধান উপকরণ এক বিশেষ ধরনের চালের ভাত

যদিও এর প্রধান উপকরণ এক বিশেষ ধরনের চালের ভাত, তবে এটি বিভিন্ন রকমের মাছ, সবজি ও অন্যান্য উপকরণের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়, যার ওপর বিভিন্ন জাতের কাঁচা মাছ খাওয়ার উপযোগী করার জন্য বিশেষ প্রক্রিয়াজাত করার পরই পরিবেশিত হয়। সঙ্গে থাকে সে দেশের বিভিন্ন রকমের মুখরোচক খাবারের সম্ভার।

কালের পরিক্রমায় বর্তমানে সুশি পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষের মধ্যে একটি উপাদেয় ও শৌখিন খাবারে পরিণত হয়েছে। ফলে বর্তমানে এর প্রকারভেদ এবং উপকরণও বিচিত্রতা লাভ করেছে। জাপানের আঞ্চলিক মাছ ছাড়াও স্যামন, মাকারেল, ডরি, স্কুইড, অক্টোপাস, চিংড়ি প্রভৃতি জাতের মাছ ব্যবহৃত হয়।

সুশির উপকরণেও এসেছে বৈচিত্র্য

তবে সারা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো টুনা মাছের সুশি, যার দামও হয় সাধারণ সুশির তুলনায় অনেক। ধরা যায়, সুশি যদি হয় খাবার হিসেবে শৌখিনতা, তবে টুনা মাছের সুশি হবে বুর্জোয়া বিলাস। তবে দিন শেষে এ খাবারের জনপ্রিয়তা বিস্তৃতি লাভ করেছে এর উৎপত্তিস্থান থেকে আশপাশের মহাদেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে।

সুশির রয়েছে নানা প্রকারভেদ। এর কিছু আছে দারুণ জনপ্রিয়। কিছু আছে তুলনায় কম। তবে সেগুলোরও জনাদর নেহাত কম নয়। তবে জনপ্রিয়তা কম বা বেশি যেমনই হোক, প্রাথমিক উপকরণ মোটামুটি অভিন্ন। অর্থাৎ সেই ভাত আর তার সঙ্গে মাছ। অবশ্য উপকরণের অভিন্নতা সত্ত্বেও নানা ধরনের সুশির সন্ধান পাওয়া যায় বিশ্বব্যাপী। যাহোক, আপাতত জেনে নেওয়া যেতে পারে সুশির কিছু জনপ্রিয় ধরন।

নিগিরি

নিগিরিতে মাছ কাঁচা থাকে না

এতে মূলত ভাতের ওপরে মাছ দিয়ে পরিবেশন করা হয়। তবে সুশি বলতেই যে ধারণা আমাদের মনে চলে আসে তা হলো কাঁচা মাছ। তবে সব ধরনের নিগিরিতে মাছ কাঁচা থাকে না। ফলে নিগিরির মধ্যেই আছে বিপুল বৈচিত্র্য। যাঁরা মাছ ভালোবাসেন, সুশি খেতে চান মাছের স্বাদকে উপভোগ করতে, তাঁদের জন্য নিগিরি এককথায় অসাধারণ।

সাশিমি

মাছপ্রিয় মানুষের জন্য সাশিমি ধরনের সুশি

মাছপ্রিয় মানুষের জন্য সবচেয়ে ভালো পরিবেশনা হলো সাশিমি ধরনের সুশি। এতে কোনো ভাত ছাড়াই শুধু মাছ পরিবেশন করা হয়। মাছকে যে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয় সুশির জন্য, তার স্বাদকে এককভাবে উপভোগ করতে সাশিমির কোনো বিকল্প নেই। সসের সঙ্গে প্রক্রিয়াজাত টুনা বা শেলফিশ সত্যিই অসাধারণ। তাই জনপ্রিয়তাতেই সাশিমি পিছিয়ে নেই অন্য ধরনগুলো থেকে।

মাকি

সুশি বললেই সুশি রোলে প্যাঁচানো ভাত, তার ভেতরে থাকা মাছ—এমন যে সুশি আমাদের সবার চোখে ভেসে ওঠে, মাকি হলো সেই ধরনের সুশি। এতে পাওয়া যায় ভাতসহ সব ধরনের উপকরণের এক পরিমার্জিত ও পরিপূরক স্বাদ।

উরামাকি

সুশি রোলে প্যাঁচানো প্রক্রিয়া করা মাছ

এটিও অনেকটা মাকির মতো হলেও এতে ভাতের তৈরি স্তরটি থাকে সবার বাইরে। এর ভেতরে সুশি রোলে প্যাঁচানো প্রক্রিয়া করা মাছ। স্বাদে অসাধারণ এবং বর্তমানে এটি খুবই জনপ্রিয়। এতে রান্না করা বা কাঁচা দুই ধরনের মাছই ব্যবহার করা হয়। সঙ্গে থাকে ক্ল্যাসিক সুশি রোল। স্বাদের জন্য তাই সহজেই জয় করে নিয়েছে ভোজনরসিকদের মন।

তেমাকি

এটি মূলত হাতে প্যাঁচানো সুশি

এটি মূলত হাতে প্যাঁচানো সুশি। সুশির সব উপকরণ থেকে চপস্টিকের সাহায্যে নিজের হাতে সুশি রোলে পেঁচিয়ে নিয়ে খাওয়া হয় এই ধরনের সুশি। বাড়িতে তৈরিতেও তাই এটি বেশ সহজ।

এ তো গেল অধিক জনপ্রিয় কিছু ধরনের কথা। এর বাইরেও গুনকানমাকি, ইরাকিযুশির মতো আরও অনেক ধরনের সুশি প্রচলিত আছে। প্রচলিত বললেও ভুল বলা হবে, বরং বলা উচিত বিশ্বব্যাপী পেয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা।

সুশি শেফরা দারুণ সম্মাণিত

তা ছাড়া সুশির জনপ্রিয়তার পেছনে আরেকটি প্রভাবক হলো এটি তৈরির পেছনের সাধনা। শুধু উপকরণ নিখুঁত ও পরিপূর্ণতাই দরকার নয়, সঙ্গে দরকার রাঁধুনির দক্ষতা ও ওই রসনাশিল্পের প্রতি ভক্তি। এ ছাড়া জাপানি সামাজিকতা ও সংস্কৃতির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সুশি পরিবেশনায় একটি পরিবার বংশপরম্পরায় কাজ করে যায়। বিভিন্ন সুশির দোকান জাপানে রয়েছে, যারা শতাধিক বছর ধরে এ খাবার পরিবেশন করে যাচ্ছে বংশপরম্পরায়।

এ ছাড়া পৃথিবীর বিখ্যাত সুশি রাঁধুনিদের অনেক ক্ষেত্রেই প্রচুর সম্মানীয় ও শ্রদ্ধার চোখে সবাই দেখে থাকে, যা এ খাবারের মর্যাদাকে কিছুটা ঐশ্বরিক পর্যায়ে নিয়ে যায়। একই সঙ্গে জাপানি জীবনদর্শন ও রীতির সঙ্গে সুশির সম্পর্ক এর জনপ্রিয়তাকে দীপ্তিমান করে রেখেছে।

লেখক: অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়