ছবি: লেখক
ছবি: লেখক

বিদায় বেলায় ছুটি কাটানো

সেদিন লাবীবার বাবা আউটার অ্যাঙ্কোরেজ থেকে ফোন করে বলল, ‘শুক্র-শনিবার যেহেতু বাচ্চাদের ক্লাস নেই, তাই শিপে এসে বেড়িয়ে গেলে ভালো লাগবে। প্লিজ না করবে না।’ ঠিক ছয় মাস হয়ে গেল আমাদের, বাসা থেকে বের হইনি। তাই ওকে না করতে পারিনি। কারণ, এবার সে সাইন অফ করবে। ফলে বাচ্চাদের নিয়ে এভাবে বেড়াতে আসার সুযোগ হয়তো আপাতত আর হবে না। এমনিতেই আজমাঈন সারাক্ষণই শিপে যাওয়ার জন্য অস্থির থাকে। ফলে ওর কথা ভেবে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বেড়িয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিই।

গভরি সমুদ্র অভিমুখে জাহাজ

১১ কি ১২ মার্চ সর্বশেষ শিপে গিয়েছিলাম। সেবার দুই রাত থেকে ফিরে যাই। এরপর এই ১১ সেপ্টেম্বর। ঠিক ছয় মাস পর। সকালবেলা দ্রুত প্রস্তুতি নিই। কারণ এদিন শিপ ছাড়বে, তাই ক্যাপ্টেন সাহেবের তাড়া একটু বেশি।

বাচ্চাদের কাপড়চোপড় সব গুছিয়ে নিলাম, দুদিনের প্রস্তুতি। শুক্র আর আগামীকাল শনিবার ওদের কোনো ক্লাস নেই। অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস হলেও এই দুদিন ছুটি পাওয়া যায়। আগামীকাল শনিবার সন্ধ্যায় লাবীবার একটা পরীক্ষা আছে, আমি প্রশ্নটা প্রিন্ট আউট করে দিলেই ও পরীক্ষা দিয়ে দেবে। সে হিসাবে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। জোয়ার-ভাটা বদলের কারণে শনিবার জাহাজ জেটিতে আসবে না। আউটারে থাকতে হবে আমাদের। পরশু রোববার বেশ সকালে জেটিতে ভিড়বে। বাচ্চারা হয়তো তখন ঘুমে থাকবে। ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট করে মা-বাবা দুজনের মোবাইল ফোনে জুম ক্লাউড অ্যাপসে লাবীবা আর আদীবা ক্লাস করে নেবে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা ৪০ পর্যন্ত ক্লাস শেষ করতেই লাঞ্চ টাইম। লাঞ্চ করেই আমরা বাসায় ফিরে যাব।
আগের দিন সন্ধ্যায় বাসায় এসে লাবীবার বাবা অসুস্থ বোধ করলেও সকালে সুস্থ হয়ে যায় এবং আমাদের নিয়ে যায় জাহাজে। তবে বাইরে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছি। শুক্রবার সত্ত্বেও জ্যাম থাকায় ডলফিন ৭ নম্বর অয়েল জেটিতে পৌঁছাতেই বেলা একটা বেজে গেল।

সেই পুরোনো জেটি, সেই আমাদের বাংলার সৌরভ

ছবি: লেখক

সবকিছু আগের মতোই আছে, কিন্তু আমার মনে অনেক পরিবর্তন। জেটিতে হেঁটে হেঁটে জাহাজের কাছে আসতেই আমার চোখ ভিজে এল। অনেক দিন পর বাসা থেকে বের হয়ে সকালে একবার চোখ ভিজেছিল, ছাড়া পাওয়ার আনন্দে। কেউ আমাদের আটকে রাখেনি। আমরাই সতর্কতার কারণে কোথাও বের হইনি। তবু বারবার মনে হচ্ছিল, যখন করোনামুক্ত হবে পৃথিবী, কত আনন্দ হবে আমাদের, কত স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারব। ভাবতে ভাবতেই চোখ থেকে অশ্রু বেয়ে পড়ল। জাহাজে উঠার সময়ও একই অনুভূতি হলো। প্রথমত, অনেক দিন পর এখানে এসেছি, তারপর হয়তো—এবার অনেক দিনের জন্য শেষবার।

জাহাজে উঠে আমাদের কেবিনে এসে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। বাচ্চাদের জন্য চিকেন ফ্রাই করে রাখা হয়েছিল আগে থেকেই। ওরা মজা করে চিকেন ফ্রাই খেলো। সঙ্গে সফট ড্রিঙ্কস।

ফক্সেল স্ট্যান্ডে লাবীবা, আদীবা

ক্যাপ্টেন সাহেবের অনেক তাড়া, একটু পরেই জাহাজ ছাড়বে, তাই সে খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে চলে গেল ব্রিজে। টাগবোট এসেছে; কান্ডারি-১১, মোরিং ম্যানও সময়মতো হাজির। জাহাজের এই একটা জিনিস আমার খুবই ভালো লাগে। সবকিছু সময়মতো মেনটেইন করতে হয়। একটুও এদিক–ওদিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সবকিছু জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে চলে। সাধারণ মানুষের এ সম্পর্কে ধারণা করার কোনো সুযোগ নেই, সহজে অনুমান করা যায় না যে কত কড়াকড়িভাবে জাহাজিদের সময় ধরে চলতে হয়। আমরা সাধারণত বিমানবন্দরের ফ্লাইট টাইমিং নিয়ে মাথা ঘামাই; কিন্তু জাহাজিদের যে সবকিছু সময়মতো করতে হয়, তা কেবল জাহাজিরাই বোঝেন।

এরই মধ্যে ফ্রন্ট সাইডে সিঙ্গেল আপ হয়ে গেছে। ব্যাকসাইড থেকে ইনফর্মেশন এল, এখনো ভাটার টান রয়েছে, তাই আরও ১০ মিনিট ওয়েট করতে হবে। সবকিছু গুছিয়ে জাহাজ ছাড়তে বেলা ২টা বেজে গেল। ডানে চট্টগ্রাম ড্রাই ডক, বামে সবুজ–শ্যামল পাহাড়ি এলাকা। নদীর মাঝখান দিয়ে আমাদের জাহাজ ছুটে চলল; আকাশে মেঘ, কোনো কোনো দিকে শরতের সাদা মেঘের স্তূপ। অন্য সময় ফ্লাইট ল্যান্ডিং দেখা গেলেও এবার কোনো ফ্লাইট চোখে পড়ছে না। এরই মধ্যে আজমাঈনকে লাঞ্চ করালাম।

সূর্যোদয়

খুব দ্রুত জাহাজ চলে এল গুপ্ত ব্যান্ডের কাছাকাছি। পশ্চিমে বোট ক্লাব দেখা যাচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরে বেড়ানোর জন্য অন্য রকম সুন্দর একটা জায়গা। কাশ ফুলে ভরে আছে বোট ক্লাবের পাশের খোলা জায়গায়; বাতাসে হেলেদুলে যেন নদীর পাড়ের সব জাহাজ, মানুষ—সবকিছুকে অভিবাদন জানাচ্ছে এই শ্বেতশুভ্র ফুলেরা। এয়ারপোর্ট এরিয়া একেবারে নীরব। কোনো কোলাহল নেই। বাম দিকে সুন্দর ঘন সবুজে ঘেরা পাহাড়ি বন। এত সুন্দর সবুজে ভরা আমাদের এই দেশ চোখে না দেখলে বর্ণনা করা সম্ভব না। নদীর বুকে ছুটে চলেছে শত শত ফিশিং ট্রলার, পণ্যবাহী জাহাজ, ছোট ছোট হাজারো ডিঙি। এখানে এসে বোঝার কোনো উপায় নেই যে মহামারি চলছে বিশ্বে। নদীপথে মানুষের পারাপার চলছেই।

মধ্যাহ্নের সূর্যকিরণ নদীর পানিতে ঝিকমিক করছে। নদীর দুই পাশে ঘন সবুজের সমারোহ। বর্ষার পর ঘন সবুজের এমন রূপে যে কারোরই মনে শান্তি শান্তি ভাব আসবেই। বারবার মনে ভাসছে সেই গান ‘হায় রে আমার মন মাতানো দেশ, হায় রে আমার সোনা ফলা মাটি, রূপ দেখে তোর কেন আমার নয়ন ভরে না, এত ভালোবাসি তবু ...’।

জেটি থেকে জাহাজের ছবি

জোরে হুইসেল বাজিয়ে জাহাজ ছুটে চলেছে। এবার আমরা সবকিছু যেন একটু বেশি করেই উপভোগ করছি। আগে যতবার এসেছি, ওভাবে ফিল করতাম না ব্যাপারগুলো। বারবার দেখতে দেখতে স্বাভাবিকের মতোই হয়ে গিয়েছিল। এবার প্রথমত ছয় মাস পর এসেছি; তারপর আবার কবে এভাবে আসার সুযোগ হবে জানি না। বামে মেরিন একাডেমি জেটি, ডানে বিমানবন্দর রেখে এগিয়ে একটু পরেই বামে সিইউএফএল, কাফকো জেটি, ডানে নেভাল। সামনেই মোহনা, নদী একটু পরেই মিশে যাবে সাগরে। বিলীন হয়ে যাবে বিশালতায়। লাবীবা-আদীবার দুপুরের খাবারের কথা খেয়ালই নেই, বেলা ২টা ৩০ বাজতে চলল। ওদের বাবা ব্রিজ থেকে এসে আজমাঈনকে ব্রিজে নিয়ে গেল। আমি লাবীবা-আদীবাকে নিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম। তিনটা বাজতেই চলে এল প্রিয় ‘চা’। জাহাজে এটাই টি–টাইম। এদিকে জাহাজও চলে এসেছে সাগরে। সাগরের বুকে চোখজুড়ানো রূপে মন ভরে তৃপ্তি নিয়ে চা পান করলাম।

আজমাঈন ক্লান্ত হয়ে বিকেলেই ঘুমিয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। গভীর সমুদ্রে ফরওয়ার্ড ডেকে খোলা বাতাসে কিছুক্ষণ সময় কাটালেই মন অনেক ফুরফুরে হয়ে যায়। কিন্তু আজমাঈন ঘুমিয়ে পড়ায় সবাই মিলে একসঙ্গে ফরওয়ার্ড ডেকে যেতে পারছিলাম না। তাই আমরা দুজন অ্যাকোমোডেশন সাইড প্যাসেজে দাঁড়ালাম। সূর্যাস্ত হতে চলল। চলন্ত জাহাজে গভীর সমুদ্রে সূর্যাস্তের এই অপরূপ সৌন্দর্য যেমন প্রখর, তেমনি মনোমুগ্ধকর।

ক্যাপ্টেন মুনির উদ্দিন মুনসুরী

একজন দক্ষ ও সৎ, নিষ্ঠাবান, কর্মঠ, পরিশ্রমী ক্যাপ্টেন কীভাবে একটি পুরোনো জাহাজকে একেবারে নতুন পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে, তা আমি নিজের চোখে দেখলাম। এভাবে বললেও খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। ২ বছর আগে সে যখন প্রথম জয়েন করে, আমরা প্রথম যেবার জাহাজে এসেছিলাম, তার সঙ্গে বর্তমান সময়ে জাহাজের ব্যাপক পরিবর্তন। শুধু আমি না, এ কথা প্রত্যেক ডেক অফিসার, ক্রু, ইঞ্জিন সাইট অফিসার, যাঁরা চলে গেছেন, যাঁরা আছেন তাঁদের প্রত্যেকের মুখে মুখে। ভেতরে-বাইরে, খাবারদাবার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে, অফিশিয়াল ডেকোরাম মেনটেইন করে সুন্দর কাজের পরিবেশে মিলেমিশে হাসিখুশিতে একসঙ্গে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করে এক দারুণ দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন ক্যাপ্টেন মুনির উদ্দিন মুনসুরী। আগে জাহাজে এলে সব দিকে শুষ্ক ভাব, মরুভূমি মনে হতো আর এখন সব দিকে সবুজ শান্ত শান্ত ভাব। ফুল, ফলের গাছে ভরে আছে ব্রিজের চারপাশ।

সন্ধ্যায় এক চক্কর মেস রুমে ঘুরে এলেই দেখা যায় কয়েকজন মিলে বসে বসে টিভি দেখছে, কেউ খাচ্ছে, কেউ বা ক্যারম খেলছে কিংবা কেউ কেউ আবার খেলছে টেবিল টেনিস। নির্দিষ্ট সময় কাজের পর আনন্দের সঙ্গে দারুণ সময় পার করে সবাই। ক্যাপ্টেন সাহেবের সাইন অফ করাকে অনেকেই সহজে মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু সে খুবই ক্লান্ত হয়ে গেছে। একজন অফিসার টানা এত দিন কাজ করতে পারে না। এই ধরনের পেশায় যেহেতু বাসায় আসা-যাওয়ার সুযোগ আছে, তাই ধৈর্য ধরে সে দুই বছর পার করে আজ থেকে আরও ৪ মাস আগে সাইন অফ করতে চাইলে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুরোধে এ পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৭ সাল থেকে চলে আসা এই জাহাজ ২-৩ বছরের মধ্যে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এখানে এসে মনে হচ্ছে এটা একেবারেই নতুন একটি জাহাজ।

বাবা ও মায়ের সঙ্গে আজমাঈন

খুব দ্রুত সন্ধ্যা পেরিয়ে যেতে লাগল, সমুদ্রের সব দিকে জাহাজে জাহাজে আলো জ্বলে ঝলমল করতে লাগল। ওদিকে বাচ্চারা কেবিনে তাই অল্পক্ষণ সময় কাটিয়ে চলে এলাম। এখন ভরা জোয়ার; কুতুবদিয়া পৌঁছাতে আরও অনেক সময় লাগবে। এরই মধ্যে আমরা রাতের খাবার শেষ করলাম। সন্ধ্যার পর আমাদের অফুরন্ত সময়। গল্পগুজব করতে করতেই সময় কেটে যাচ্ছে আমাদের।

মাদার ভেসেলের কাছাকাছি এলে সবার কাজের গতি বেড়ে যায়। একজন অফিসারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় ফেন্ডার ফেলার কাজ। একজন ক্রেনচালকের সহযোগিতায় কয়েকজন ক্রু মিলে এই কাজ শেষ করেন। পাম্পম্যান তাঁর নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মোটকথা, যাঁর যাঁর কাজ প্রত্যেকেই নিয়মমতো পালন করে যান। এখন সমুদ্রে অবস্থা অনেক ভালো। গত মাসে সারা বিশ্বে অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছিল সমুদ্রের অবস্থা। জোয়ারে ছিল অস্বাভাবিকতা। ওই অস্বাভাবিক সময়ে জাহাজে যে পরিস্থিতি হয়, তাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারবে না। এখন স্বাভাবিক অবস্থাতেও অনেক রোলিং হচ্ছে জাহাজে। রাত প্রায় ১টা বাজল মাদার ভেসেলে এলং সাইড হতে।

১২ সেপ্টেম্বর ২০২০

আরেকটি সুন্দর সকালের শুরু। ভোরের আলো ফোটার আগেই জাহাজ কাস্ট অব হলো মাদার ভেসেল থেকে। খুব দ্রুত সব দিক আলোকিত হতে শুরু করেছে। সকালের শান্ত-স্নিগ্ধ সৌন্দর্য, নীল আভা ছড়িয়ে বিকশিত হতে লাগল। গভীর সমুদ্রের স্বচ্ছ নীল জলরাশি তার সব সৌন্দর্য নিয়ে আমার চোখে বিচ্ছুরণ ছড়াতে লাগল। অপরূপ শোভা আমার চোখে শান্তির প্রলেপ দিয়ে যেতে লাগল। এই ভোরেও এত গভীর সমুদ্রে শত শত ফিশিং বোট। আসলেই সাগরপাড়ের মানুষ কিংবা সাগরের সান্নিধ্যে যারা কাজ করে, তাদের সকাল-সন্ধ্যা, রাত-দিন হিসাব করার কোনো সুযোগ নেই। জাহাজ চলতে শুরু করেছে চট্টগ্রাম অভিমুখে। ইচ্ছা হচ্ছিল একটু বাইরে যাই, কিন্তু বাচ্চারা ঘুমে আছে, তাই আর যাওয়া হলো না।

জাহাজের বাগানের ফুল

কিছুক্ষণ পর ওদের বাবা তার নিজের হাতে গড়া বাগান থেকে কিছু তরতাজা মিষ্টি রঙের ফুল নিয়ে এল। এই সাতসকালে নজরকাড়া সৌন্দর্য আর মন ভোলানো রঙের ফুলগুলো হাতে নিয়ে অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছিল। আমি ফুলগুলো বাচ্চাদের জন্য গুছিয়ে রাখলাম।

জাহাজে দোল খেতে খেতেই বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে। আমার কাজের কোনো তাড়া নেই, বাচ্চাদের পড়াশোনার কোনো চাপ নেই, তাই তারা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে, গোসল করতেই মোটামুটি দুপুর হয়ে এল। এ পর্যায়ে জাহাজ অ্যাঙ্কর করতে হলো কিছুটা দূরে। ভাটার কারণে খুব একটা বেশি এগোনো যাচ্ছে না।

লাঞ্চ সেরে গল্পগুজবে সময় কাটতে লাগল। ইচ্ছা হচ্ছিল সবাই মিলে ডেকে যাই, কিন্তু আজ আবহাওয়া খুব একটা সহায়ক নয় আমাদের। মেঘলা আবহাওয়া হঠাৎ করেই খারাপ হতে লাগল। আমাদের মনও খারাপ হতে শুরু করল।

বাবার সঙ্গে ছেলেড়-মেয়েরা

শত শত ফিশিংবোটের ভিড়ে জাহাজ নিয়ে এই রুটে এগোনো খুবই কষ্টের। প্রতিটা মুহূর্ত সচেতন থাকতে হয় নাবিকদের। যত্রতত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে ফিশিং নেট। এসব দেখতে দেখতেই হঠাৎ করেই আমাদের চমকে দিয়ে সন্ধ্যার ঠিক আগমুহূর্তে আবহাওয়া ভালো হতে শুরু করল। মুহূর্তেই আমরা ছুটে গেলাম ডেকে। নতুন রূপে সূর্য উঁকি দিতে লাগল। সূর্যের রোদে ঝকঝক করতে লাগল অথই জল। সাগরের ব্যস্ততাকে সঙ্গে করে ছুটে চলেছে হাজার হাজার মানুষ। গভীর সমুদ্রের অথই জলে সূর্যের হারিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা নেমে এল। সন্ধ্যায় লাবীবার পরীক্ষা আছে, তাই আমরা খুব বেশিক্ষণ সময় না কাটিয়ে চলে এলাম রুমে।
হালকা নাশতা খেয়ে লাবীবা পরীক্ষা দিতে বসল। আর আমি ভাবছি, সবকিছু পেছনে ফেলে আমাদের চলে যেতে হবে নিজস্ব ঠিকানায়। সবকিছু একটা সময় স্মৃতি হয়ে যাবে।

১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

রাত সাড়ে তিনটায় জোয়ার শুরু হলে অ্যাঙ্কর হিভ আপ করে আমাদের জাহাজের চলা শুরু হলো। রাতে অন্ধকারে ডেকের লাইট নিভিয়ে জাহাজ চালাতে হয়। জাহাজ চলার সময় সব দিকের আলো রাখতে হবে। এটাই নিয়ম। আমার দুচোখে ঘুম নেই। অন্যান্য জাহাজের আলোয় চারদিকের জলের চিকচিক করে জ্বলে ওঠা আর জলের ওপর জাহাজের আলোর বিচ্ছুরণ দেখতে দেখতে ভোরের আলো আসতে শুরু করল।

ছবি: লেখক

ক্যাপ্টেন সাহেব জানেন, এই সময় আমি নামাজ পড়ে নিশ্চয়ই বসে আছি, তাই ব্রিজ থেকেই এক কাপ চা পাঠালেন, সঙ্গে ব্রেড টোস্ট। এই এক কাপ চা আমাকে সারা দিনের শক্তি জোগায়। প্রচণ্ড ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে আমি বাইরের দিকে দৃশ্যপটের বদলে যাওয়া দেখতে থাকি। এরই মধ্যে সূর্যোদয় হতে করেছে। কত শতকোটি মাইল দূর থেকে এই সূর্যের আলো পৃথিবীতে এসে পড়ছে, তার হিসাব আমরা কখনো করি না। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত হবে; দিন থেকে রাত—আমরা শুধু ওটাই দেখি। যে আলোয় আমাদের ধরণি আলোকিত হতে থাকে, সে সূর্যের আলো তার দীর্ঘ পথে কোথাও বাধা না পেলে অনায়াসে এসে পড়ে আমাদের কাছে। তেমনি করে আজও ভোরের আলো এসে আলোকিত করে দিচ্ছে।

‘বাংলার সৌরভের’ যাত্রাপথে আর কারও সঙ্গে দেখা হোক বা না হোক ‘বাংলার জ্যোতির’ সঙ্গে দেখা হবেই । গুপ্ত ব্যান্ডের কাছাকাছি এসে দেখা হলো দুই জাহাজের। সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভোর সাড়ে ছয়টায় আমাদের জাহাজ জেটিতে ভিড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে অয়েল রিফাইনারি জেটিতে কার্গো ডিশচার্জিং শুরু হয়ে গেল। জাহাজ পরিচালনা পুরোপুরি একটা দলীয় ব্যাপার। যাঁর যা দায়িত্ব, সময়মতো তাঁকেই তা করতে হয়।

রাতের ঘুম দুচোখ জুড়ে আসতে লাগল। বাচ্চাদের ক্লাস আছে সকাল ১০টা থেকে। তাই এর আগেই ঘুম থেকে জাগাতে হবে, কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম ভাঙতেই তড়িঘড়ি করে ওদেরকে ডেকে তুললাম। লাবীবা ও আদীবা ব্রেকফাস্ট করতে করতেই ক্লাস শুরু করল। ওদের ক্লাস শেষ হবে দুপুর ১২টা ৪০–এ।

এদিকে ততক্ষণে ভরা জোয়ার, অন্য আরেক অপরূপ দৃশ্য; জেটির কানায় কানায় জল। মাত্র ৬ ঘণ্টার ব্যবধানে কীভাবে নদী কানায় কানায় ভরে যায়, আবার কীভাবে পানি নদীর তলায় চলে যায়, এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

সবাই মিলে

লাঞ্চ শেষ করতে করতেই প্রস্তুতি নিতে থাকলাম বাসায় ফিরে যাওয়ার। অল্পতেই আমার মন ভারী হয়। অল্পতেই আমার কান্না পায়। জাহাজের কেবিনের দুটি রুমে আমাদের অনেক স্মৃতি। আমি কোথাও গেলে দুটি দিন হোটেলে থেকে ফিরে আসার সময় হোটেলে রুমের দিকে তাকিয়েও কান্না আসে। আর এখানে প্রায় দুই বছরের কাছাকাছি সময় ধরে আসা-যাওয়া করি আমরা। বাচ্চাদের জন্য বালিশ রাখা আছে, ব্ল্যাঙ্কেট রাখা আছে, আমাদের প্রত্যেকের প্রয়োজনীয় অনেক জিনিস বাসার মতো করে রাখা আছে কেবিনে। এবার সবকিছু গুছিয়ে নিতেই মন ভারী হতে লাগল

তারপরও বুকের ওপর পাথর বেঁধে কান্না চেপে সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। আসার আগমুহূর্তে আবার ব্রিজে গেলাম, মনে হচ্ছিল সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। কী এক অব্যক্ত মায়া সব জিনিসের প্রতি। সবকিছুর ছবি তুলে নিলাম। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। নিজেদের হাতে গোছানো, নিজেদের ব্যবহৃত সবকিছু পেছনে ছেড়ে আসা অন্য রকম কষ্ট।

ছবি: লেখক

শেষ মুহূর্তে নেমে আসার সময় বৃষ্টি এল, আমার চোখের পানি বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে গেল। বিদায় জানানোর জন্য যাঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে হাত নাড়িয়ে বিদায় বলতে পারলাম না। আমি দাঁড়াতে পারছিলাম না, ফিরে তাকাতে পারছিলাম না, কান্না চেপে রেখে গাড়িতে উঠে এলাম। বে-টার্মিনাল হয়ে ফিরে আসার সময় সাগরপাড়ের দীর্ঘ রাস্তায় অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা ফেলে আসছিলাম, সেই সৌন্দর্য আমাদের আকৃষ্ট করতে পারল না। বাষ্পচোখে ঝাপসা দেখছি সবকিছু। মাইলের পর মাইল দ্রুতগতিতে গাড়ি এগিয়ে চলছিল বাসার দিকে। রাস্তার দুই ধারে সবুজ পাহাড়ি বন, গাড়ি চলার শোঁ শোঁ শব্দ, নিশ্চুপ সবাই, আমাদের কারও মুখে কোনো কথা নেই।