
পাহাড় ভালোবাসেন আপনি? অথবা অবিরত ঝরে পড়া জলধারা? যাকে আমরা ঝরনাধারা বলি? ভালোবাসেন কি টলটলে জলের বহমান কোনো নদী। পাহাড়ি ঝিরি, পাথর, নানা রঙের মাছেদের জলকেলি? টলটলে জলের প্রবাহ ধরে, পাহাড়ের পাদদেশে, পাথরের আড়ালে, শেওলা জড়ানো কোনো টুকরো কাঠের সঙ্গে অবাক করে দেওয়া মিতালি করা মাছেদের ঝাঁক? নদীর পানি যেন নয়, পাহাড়ের পায়ে-পায়ে জড়িয়ে থাকা কোনো সুবিশাল কাচের বিস্তার, পাহাড়ের প্রান্তর জুড়ে। এমন জায়গায় বারবার ছুটে যেতে চায় আপনার মনপ্রাণ?
আপনার ভীষণ ব্যস্ত জীবন। যেখানে তেমন কোনো অবসর নেই। নেই বলবার মতো কোনো ছুটি, যে ছুটিতে একটু অবসর পেলেই একা, পরিবার বা বন্ধু বান্ধব নিয়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে করবে কোনো পাহাড়ে, নদীর তীরে, জল প্রপাতের পাহাড়ি ঢালে কিংবা কোনো শান্ত নদীর তীরে। আপনার রূঢ় বাস্তবতা সেই সুযোগ আপনাকে কোনো ভাবেই দিচ্ছে না। বিষণ্ন মন নিয়ে, শহুরে ইট, পাথর আর ধুলো ধূসরিত রাজপথের জ্যামে বসে বসে আপনি চোখ বন্ধ করে, মনে মনে কল্পনা করে চলেছেন, যদি যাওয়া যেত!
যেতে পারেন, যদি আপনার মাত্র দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি, পাসপোর্ট আর পাসপোর্টে ভারতের ডাউকি সীমান্ত পারি দেওয়ার অনুমতি থাকে। আপনি পেতে পারেন একদম আপনার স্বপ্নের মতো, আপনার মনের মতো নানা রকম রঙে রাঙানো কল্পনার সবকিছু একই সঙ্গে, একই জায়গায় দেখতে একদম আপনার সাধ্যের মধ্যেই। যেখানে আছে এই লেখার শুরুতেই দেওয়া বর্ণনার মতো করে সব, সবকিছুই। তেমন একটি জায়গা থেকে সম্প্রতি ঘুরে এলাম পরিবার নিয়ে।
এই জায়গা বা পাহাড়ি এই গ্রামের নাম সোনাংপেডাং। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে, কিন্তু আমাদের দেশের একদম সীমান্ত ঘেঁষে থাকা পাহাড়ের পাদদেশে এর অবস্থান। ভারতের নানা জায়গা থেকে এখানে আসা বা যাওয়া যতটা সহজ তার চেয়ে অনেক বেশি সহজ আর কম সময়ে আমাদের চলে যাওয়া যায় অপার্থিব স্বচ্ছ জলের এই সোনাংপেডাং গ্রামে। সস্তাও বটে এ দর্শনীয় এলাকা।
ঢাকা থেকে যেকোনো দিন রাতের ট্রেনে সিলেট চলে যেতে পারেন খুব সকালে। স্টেশনের পাশের বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে দেড় ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন তামাবিল সীমান্তে। পাসপোর্টে কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ভারতে প্রবেশ করে সেখানেও একই রকম আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে, আধা কিলোমিটার হেঁটে ডাউকি বাজার থেকে ৩০/৫০ রুপি দিয়ে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন এক টলটলে স্বচ্ছ জলের ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম সোনাংপেডাং।
যদি রাতে থাকতে চান তবে দেখে শুনে একটা পাহাড়ি ঘর বা কটেজ ভাড়া করে ব্যাগপত্র রেখে চলে যান সবুজ অরণ্য আর পাহাড়ে পাহাড়ে ঘেরা, স্বচ্ছ নদীর পাথর বিছানো তীরে। এর টলটলে জল আপনার জন্য অপেক্ষা করছে বিস্ময় নিয়ে। উমগট নদীর পানি এতটাই টলটলে, স্বচ্ছ আর কাচের মতো ঝকঝকে যে নদীর নিচের পাথর, বালু, শেওলা, রঙিন মাছ, ভেসে চলা নানা জলজ প্রাণী, সাঁতার কেটে যাওয়া নানা রকম পাহাড়ি প্রাণের সকল অস্তিত্ব দেখা যাবে দুচোখ মেলে। নদীর যে কোনো জায়গা থেকেই।
পাথরে, বাঁশের সেতুতে, পাহাড়ের যে কোনো প্রান্তে বসে আপনি প্রাণ ভরে উপভোগ করতে পারবেন স্বর্গীয় দৃশ্য। যার চারপাশে আপনাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে অরণ্যে অরণ্যে ঢাকা সুবিশাল পাহাড়ের দেয়াল। এই সবুজ পাহাড়ের দেওয়ালে বসে আছে রঙিন পাহাড়ি ঘরবাড়ি। নদীর জলে, পাথরে পাথরে ভেসে আছে নানা রঙের নৌকা কায়াকিং এর জন্য প্রস্তুত হয়ে। আছে স্রোতে ভেসে চলার জন্য রোমাঞ্চকর রাফটিং এর আয়োজন। আর আছে দুই পাহাড়ের মাঝে দোলনায় দোল খাওয়ার মতো অদ্ভুত রোমাঞ্চকর সেতু। যেখানে উঠে গা ছমছম করবে যে কারুর, কিন্তু একটা ভিন্ন রকম রোমাঞ্চ আপনাকে অদ্ভুত মায়ায় বেঁধে রাখবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
এসব রোমাঞ্চ উপভোগ করে চাইলে শেষ বিকেলে আবারও ডাউকি চলে এসে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সে চলে আসতে পারেন সিলেট শহরে; আর রাতের ট্রেনে ঢাকায়। আর যদি রাতে থাকতেই চান, তবে তো রাতের নানা রকম রোমাঞ্চ আপনার জন্য অপেক্ষা করছেই নানা রকম বিস্ময় নিয়ে, এই স্বচ্ছ নদীর গ্রামে, সোনাংপেডাংয়ে।