বর্ষা মানেই তো মাঠঘাট ভেসে যাওয়া, ছাতা ফেলে ভিজে যাওয়া
বর্ষা মানেই তো মাঠঘাট ভেসে যাওয়া, ছাতা ফেলে ভিজে যাওয়া

ঢাকার কাছের এই গ্রামে এখনো তেমন শহরের ছোঁয়া লাগেনি, বর্ষার অতিথি হয়ে সেখানেই গিয়েছিলাম

দমকা হাওয়ায় কড় কড় করে বাঁশে বাঁশ ঘষে ডেকে ওঠে প্রকৃতি। নগরের টিনের চালে ঝমাঝম বৃষ্টির মূর্ছনায় বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে, ভিজে যায়।

মেঘকে দূত করে প্রিয়ার কাছে পাঠিয়েছিল কালিদাসের যক্ষ। যক্ষের মনের খবর পাহাড়, পর্বত ডিঙিয়ে মেঘ পৌঁছে দিয়েছিল তার প্রিয়ার কাছে। এ দিকে আমি অফিসের টেবিলে বসে আছি তবু মনটা ভিজে যাচ্ছে, বাইরের মুষল বৃষ্টির ছাটে। মনে পড়ে যায় ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’। এই শহরে কংক্রিটের গায়ে গায়ে যে জল জমে আছে, সে জল আমার নয়। আমার জল পড়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তায়, টিনের চালে, পুকুরপাড়ে, ঘাসের ডগায়। সেই জলের ফোটায় মিশে থাকে মাটির ঘ্রাণ, কাঁদার স্পর্শ, কেয়া আর কদম ডালের মায়া।

ক্যালেন্ডারের পাতা না দেখেও কদম ফুল দেখে বোঝা যায় বর্ষা এসেছে। কিন্তু নগরে বসে কি সত্যিকারের বর্ষার দেখা মেলে? বর্ষা মানেই তো মাঠঘাট ভেসে যাওয়া, ছাতা ফেলে ভিজে যাওয়া, আর মাটির কাছাকাছি থাকা। তখনই গ্রাম যেন ডাক পাঠায়—এসো, ভেজো, ভেজাও, ভিজে যাও।

এই টান প্রথম পেয়েছিলাম কবি ফররুখ আহমদের ‘বৃষ্টির ছড়া’য়:

বৃষ্টি এল কাশবনে

জাগল সাড়া ঘাসবনে

বকের সারি কোথা রে

লুকিয়ে গেল বাঁশবনে।

নদীতে নাই খেয়া যে

ডাকল দূরে দেয়া যে

কোন সে বনের আড়ালে

ফুটল আবার কেয়া যে...

এই কয়েকটি পঙ্‌ক্তিই বৃষ্টির দিনে আমার ভেতরে সত্যি বেজে যায় বারবার। বৃষ্টি হয়ে ওঠে কোনো এক অনুপস্থিত প্রিয়জনের চিঠির মতো—ঘন কালো মেঘ তার বাহক, আর ঝরঝর বৃষ্টি না বলা কথার আর্তি।

ভাদুনে এখনো তেমন একটা শহরের ছোঁয়া লাগেনি

চাকরি, সংসার, শহরের ব্যস্ততা সবকিছুর মধ্যেই কোথা থেকে যেন তার বার্তা পাঠায় মেঘ—তুমি এখনো এলে না যে, তখন কি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে যক্ষপ্রিয়া!

সেদিনও তাই হয়েছিল। গিয়েছিলাম গাজীপুরের ভাদুনে। বিকেলেই ফেরার কথা ছিল, কিন্তু ফিরতে পারিনি। যেন আমি বর্ষার বহু পুরোনো অতিথি। ফলে ‘রাত ভরে বৃষ্টি’।

ভাদুনের পথঘাট সবই কাঁচা মাটি। শহরের পাকা রাস্তায় হাঁটা অভ্যস্ত পা সেখানে হোঁচট খায়, কিন্তু মন ঠিকই মানিয়ে নেয়। মাটির সঙ্গে এখানকার মানুষের যেন এক গভীর আত্মীয়তা আছে, পথচারীর মনেও লাগে সেই আত্মীয়তার ছোঁয়া।

এই গ্রামের গায়ে এখনো তেমন একটা শহরের ছোঁয়া লাগেনি। ইট-পাথরের দালান বা বড় দোকানপাট নেই। বিকেল হলেই পাড়ার মেয়েরা, বউঝিরা দল বেঁধে বের হয় গল্প করতে। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যায়, হাসি-ঠাট্টায় মুখর করে তোলে চারপাশ। এখনো এই গ্রামে কিছু কিছু ঘর মাটিরই আছে, টিনের ছাউনি আর বাঁশের বেড়া। বর্ষার সময় টিনের ছাঁদে বৃষ্টির শব্দ সরব সংগীত হয়ে বাজে।

বর্ষাকালে মাটির বাড়িগুলো আবার নতুন করে সাজিয়ে নেয় বউঝিরা। বাড়ির ছোট ছোট মেয়েরাও এসে সাহায্য করে, ছোট হাতজোড়া মাটি মেখে দেয়ালে লাগিয়ে দেয় তাদের ভালোবাসার সিলমোহর।

ভাদুনের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বেলাই বিল

ভাদুন শুধু একটা গ্রাম নয়, মাটির সঙ্গে গড়া এক অনুভূতি, ধুলাবালি, কাদামাটির মধ্যেও যা সজীব থাকে। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, এখানে সময়টা একটু ধীরে চলে, আর মানুষের মুখে এখনো থাকে আন্তরিকতার সহজ হাসি। এমন সব দৃশ্য ও মুহূর্তই আমাকে এই গ্রামে টেনে আনে বারবার। কিছু জায়গা থাকে, যেখানে একবার গেলে আর পুরোপুরি ফিরে আসতে পারে না মানুষ, ভাদুন ঠিক তেমনই এক গ্রাম।

এ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বেলাই বিল। বৃষ্টিতে টইটম্বুর। ডাঙার পাশে শাপলা ফুটে একাকার। নেমে পড়লাম শাপলা তুলতে, সাদা আর গোলাপি। দুপুর গড়াতেই বিলের জলে গা ভাসিয়ে দিলাম। ভেতরে চোরা স্রোত, বাইরে থেকে বোঝা যায় না। সাঁতার জানা ছিল বলে রক্ষা! প্রকৃতি যেন বলছে, সহজ যা মনে হয়, সব সময় তা সহজ নয়। যা–ই হোক, দূরে এক ডিঙি নৌকায় একজন বসে আছেন, ধ্যানমগ্ন বকের মতো। মাছ ধরা তো শুধু শিকার নয়, একপ্রকার সাধনা। যেমন জীবনও।

রাতটা কাটালাম ছনের চালের দশ চালা ঘরে, ঘরের দেয়ালগুলো বাঁশের চাটাইয়ের আর নিচে মাটির মেঝে। চারপাশে অচিন বৃক্ষ আর ভেজা মাটির ঘ্রাণ। সারা রাত ঝুম বৃষ্টি, মাঝেমধ্যে আম পড়ার টুপটাপ শব্দ, আহা, শহরে এমন ঘুম জোটে না। দশ চালার ফাঁক দিয়ে চারপাশ থেকে বৃষ্টির ছাঁট ঢুকে পড়ে, সঙ্গে ঘরটাও ভিজে ওঠে। ভোরবেলা শিশিরভেজা ঘাসে পা রেখে হাঁটি। মনে হয় শিশিরের শব্দের মতো শুধু সন্ধ্যা নয়, সমস্ত রাতের শেষে ভোরও নামে। টুপ করে একটা আম গড়িয়ে পড়ল পায়ের কাছে! বৃষ্টির দিনে এইখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো, শরীর বয়স জানিয়ে দিলেও মন আজও বলছে আমি সেই পথের পাঁচালির ‘দুর্গা’। ছোট ‘অপু’কে নিয়ে কাদামাটির পথে হেঁটে যাচ্ছি। আম আঁটির ভেঁপু বাজাচ্ছি…আর ফিরে যাচ্ছি নিজের ভেতরে, শৈশবে, স্মৃতিতে। আমরা যারা বুকের ভেতর এখনও কাদামাটির গ্রাম লালন করে রাখি, তাদের জন্য এই সময়টাই সবচেয়ে সত্যি। কারণ, বর্ষা মানেই ফিরে যাওয়া—মাটি আর নিজের কাছাকাছি।