মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে। তবে তার আগেই দেশের কিছু কিছু অঞ্চল মুক্ত হয়। দক্ষিণের সীমান্ত জনপদ সাতক্ষীরা মুক্ত হয় ৭ ডিসেম্বর। ১২ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের সঙ্গে মুক্ত বাংলাদেশ দেখতে আসেন একদল ভারতীয় সাহিত্যিক। তাঁদের সবাই–ই বাঙালি এবং কলকাতার লেখক-কবি–সাংবাদিক। সেই দলে ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়,নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায় প্রমুখ। আসবার পথে তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্র দেখেন, গণহত্যার স্থান দেখেন, পোড়া বাড়ি দেখেন। দেখেন গ্রামীণ মুক্তিযোদ্ধাদের নিষ্পাপ বীরের মতো মুখ। আর দেখেন স্বাধীনতা ও শোকে আপ্লুত অপূ্র্ব সব মুখচ্ছবি।পরে এই সব দেখা থেকে কথাসাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ‘ভোমরা পেরোলেই সাতক্ষীরা’ নামে মর্মস্পর্শী একটি লেখা লেখেন, কলকাতার সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার ২৫ ডিসেম্বর সংখ্যায় ছাপা হয় লেখাটি। সন্দীপন চট্টপাধ্যায়ের এই লেখা কেবল যুদ্ধ আর ধ্বংসের বিবরণ নয়, এটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রাণভোমরা আবিষ্কারের অসাধারণ এক গল্প। বিজয়ের ৫০ বছরে প্রকাশিত হলো সেই লেখাটি। ভূমিকা ও গ্রন্থনা: ফারুক ওয়াসিফ।

গাদাগাদি একটা গ্রাম্য বাসে আমাদের সঙ্গে চলেছে জন তিরিশ গেঁয়ো মানুষ। অধিকাংশের পরনে লুঙ্গি, কেউ কেউ হাঁটুর ওপর মালকোঁচা মেরে ধুতি। মাটিমাখা মাত্র দু-চারজনের পায়ে হাওয়াই চপ্পল, নতুনই বটে। এ রকম ধ্বস্ত রাস্তা, যাতে লোকবোঝাই বাস উঠছে মিনিটে দুবার তড়াক তড়াক করে লাফিয়ে ফুটপাতের শহুরে চটির খুব একটা পুরোনো হওয়ার এখানে সুযোগ কই। ক্যাম্প থেকে সুতির খাকি সোয়েটার সকলে পায়নি। মাত্র দশজনের কাঁধে রাইফেল। তবু এরা যোদ্ধা, এরা সৈন্য; ছেঁড়া, নোংরা, আপরুচি জামা-কাপড়ের নিচে এরা সকলেই সেই উজ্জ্বল-শ্যামবর্ণ ইউনিফর্ম পরে আছে, যার ডাকনাম চামড়া।
ভোমরা বর্ডার ক্রস করতেই হ্যান্ডেল ধরে জানালায় ঝুঁকে পড়ল মহম্মদ ইউসুফ (বয়স ৩৫), ‘উই দ্যাখেন বাংলাদেশ!’ সত্যি তার কণ্ঠস্বর ছিল অদ্ভুত আকস্মিকতায় ভরা। সেই জাদুঝলক ছিল সেখানে, যা নদীর নাম উচ্চারণ করলেই ‘চারদিকে প্রতিভাত হয়ে ওঠে নদী’...কথা ছিল, তবু বনরাজিনীল, শস্যশ্যামল, নদীমাতৃক পূর্ব বাংলা সে আমাদের দেখাতে পারে না। বলতে বলতেই ইউসুফের চাষাভুষো রুখু মুখে তাই ছায়া এসে পড়ে। জানালা থেকে সকালবেলার ময়লা রোদ্দুর সরে যায়। ‘বাংলাদেশ বলতে আর কিছু নাই, দ্যাখেন শুধু মাটি।’ বুক খালি করে সে এবার দীর্ঘস্থায়ী শ্বাস ফেলে, ‘মরুভূমিতে শোনা যায় খালি বালু। আর এখানে পোড়া ঘাসের কাছে খালি পোড়া ঘাস। কেউ ধান করতে পারে নাই। উই দ্যাখেন পাট, এখনশুকনা লাকড়ি, কেউ কাটে নাই! বাংলাদেশ ঠিকই আছে। বৈশাখ অব্দি অভাব–অভিযোগ থাকবে আঁইজ্ঞা। তারপর আর থাকবে না। তারপর ধান হবে।’ শূন্য বুক ইঞ্চি দুই বেশি ফুলিয়ে বোধ হয় সে আবারও নিশ্বাস নেয়, ‘এখন কিছু কিছু ইরি করতে পারবে।’ ইউসুফের বাড়ি ছিল বরিশালের বানারিপাড়ায়। চাষি ছিল।
‘পিকচার প্যালেস’ সিনেমায় এ বছর (১৯৭১) জানুয়ারির গোড়ায় সে স্ত্রীর সঙ্গে শেষবার ছবি দেখতে গিয়েছিল। তার ছোটবেলায় হলটির নাম ছিল ‘নীলা’। এখন তারা বিচ্ছিন্ন। না, তাদের সন্তান হয়নি। ছবির নাম ছিল ‘মোমের আলো’।
‘ওই দ্যাখেন একটা পাখি’, ডাকনিয়া গ্রামের কাছে ব্যারেল থেকে দক্ষিণ বাহু তুলে নিয়ে ইউসুফ জানালা দিযে তর্জনি বাড়িয়ে দেয়, ‘আমরা বলি ফেচুয়া।’ দেখি, কাঁচা বাঁশের ইলেকট্রিক পোস্টের মাথায় একটি ফিঙে বসে। আরও দূরে পোড়া ঘাসের জঙ্গল থেকে ধানের স্বয়ম্ভু ছড়া খুঁজে বেড়াচ্ছে চাষি। অভ্যাসবশত জেলে আজও জলায় জাল ফেলছে। ওদিকে মেঠো রাস্তা থেকে পাকা সড়কে উঠছে চারটি ছইঢাকা গরুর গাড়ি, তার পেছনে দিগন্ত পর্যন্ত সারবন্দী পুঁটলি-মাথায় মানুষ, সাইকেল, রিকশর পা–দানিতে হাঁড়িকুড়ি। দুধারে বিধ্বস্ত পিলবক্স ও বাংকারের মধ্য দিয়ে ওরা ঘরে ফিরে আসছে। ‘একটা ফেচুয়া থাকলে’ ইউসুফ বলে যাচ্ছে, ‘সে গাঁয়ে কাক থাকতে পারে না। আমরাও অমনি’, রাইফেলের নলে সে হাত বোলায়, ‘একটা গেরিলা থাকলে সে গাঁয়ে শত্রু থাকতে পারে না।’ কুঁদোয় হাত রেখে যেন প্রতিজ্ঞা করে সে বলে, ‘এই বন্দুক দিয়ে ২১ জন খতম করেছি। ৪টে কেটেছি।’ পরক্ষণেই হাত রাখে বুকে, ‘তবু জুড়ায় নাই।’ একটা সিগারেট দিতে গেলে ডান হাতটা নমস্কারের ভঙ্গিতে কপালে ঠেকিয়ে, বাঁ হাতে মুখ লুকিয়ে সে একধরনের হাসতে লাগল। কিসে যে ওর অমন নারীসুলভ সুন্দর লজ্জা হলো, বুঝলাম না।
‘ওসব ভুলে গেছি আঁইজ্ঞা।’ ইউসুফের হয়ে জবাব দিলে কেরামত আলি (৪০)। ইউসুফের পাশে বসন্তক্ষতে ভরা, যার মুখ দেখে এতক্ষণ মনে হয়েছিল অজস্র বল্টু মারা একটা বন্ধ দরজা, পাল্লা খুলে সে এবার সহাস্যে বেরিয়ে আসে, ‘সময় কোথা বাবু! রাত নাই, দিন নাই, খালি তো ছুটে ছুটে বেরিয়ে যেতে হতো। দুই সপ্তাহ সে স্নান করেনি, কেরামত জানায়, যা তার দাঁতের ময়লা দেখে বিশ্বাস হয়। তার চোয়াড়ে মুখে ধীরে, অতি ধীরে, প্রায় অলক্ষ্যে, বীরের নিষ্পাপ আত্মগরিমা ফুটে ওঠে, ‘এখানে তিন দিন লড়াই করেছি। সব আমরা ধ্বংস করেছি’, ডাকনিয়ার বিধ্বস্ত বাংকারগুলো দেখিয়ে যখন সে বলে।
সে ছিল পশ্চিম রংপুরে ইপিপির একজন হাবিলদার, কেরামত আলি (নং ১৪৫৭)। একটা টাইপ করা পরিচয়পত্র পকেট থেকে বের করে সে আমাকে দেখায়। ‘সার্টিফায়েড দ্যাট’, তাতে লেখা, ‘কেরামত আলি, এস/ও লেট মেহের আলি খান, ভিলেজ-মুসুরিয়া, পোস্ট-দেহেরঘাটি, পিএস-বাবুগঞ্জ, ডিস্ট্রিক্ট-বরিশাল, কেম টু মাই ক্যাম্প উইথ সিক্সটি ফোর হাবিলদার্স অ্যাজ আ গ্রুপ লিডার অ্যান্ড আফটার ট্রেনিং হ্যাজ বিন ডিউলি প্রোমোটেড টু দ্য র্যাঙ্ক অব প্লেটুন কমান্ডার। হি ইজ আ বোনাফাইডে ফ্রিডম ফাইটার। অল কনসার্নড আর রিকোয়ার্ড টু হেল্প অ্যান্ড কো-অপারেট।’ সিলমোহর। স্বা. ক্যাপ্টেন আবদুল বারি। ক্যাম্প ইনচার্জ। ধলচিতা।
আরে! শবনমও উঠেছে যে, ঠাসা ভিড়ের মধ্যে দেখতেই পাইনি ওকে। ওদিকে দরজার পাশে বসেছে। ‘এতক্ষণ দেখিনি।’ উচ্চারণ করে আমি আমাকে বলি! পাশে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই ওর দাদা। এ পারে ইটিন্ডায় পৌঁছে শবনম আমাকে বলেছিল, ও অপেক্ষা করছে দাদার জন্য।
দাদার বগলে ওটা কী! দাদার হাতের নাগাল না পেয়ে কিসের বাঁট ধরে আছে শবনম?
আজ ভোরবেলা ইছামতীর ওপর মাঝবরাবর আমরা তখন, কুয়াশার ভেতর থেকে সহসা বেরিয়ে একটা নৌকা হুস করে আমাদের পেছনে রেখে কুয়াশার ভেতর ঢুকে যায়। নৌকাটি ছিল আরোহীবিহীন, নৌকায় একটা রিকশ ছাড়া ঘন কুয়াশার মধ্যে আমি প্রথমত কিছুই দেখতে পাইনি। এ সময় কুয়াশা ভেঙে রোদ এসে পড়লে রিকশর কারুকাজ থেকে টিন চকচকিয়ে ওঠে ও, যেন সিংহাসনে, না রিকশর ওপর, একটি ফুটফুটে কিশোরী বসে আছে দেখতে পাই এবং সেই তার সঙ্গে প্রথম চোখাচোখি এবং সেই তার প্রথম হেসে ফেলা।
ভিড়ের ভেতর থেকে শবনমের চোখ দুটো খুঁজে বের করি। ওই স্বভাব মেয়েটার। এমনিতে ভীষণ গম্ভীর, কিছুতেই চোখের দিকে তাকাবে না, খালি ফাঁকি দেবে এবং চোখাচোখি না হলে কিছুতেই হাসবে না। ফিক করে হেসে বাসের একমাত্র মহিলা যাত্রী গম্ভীর মুখে আবার বাইরে তাকায়।
দাদাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলে ভিড় ঠেলে সে এগিয়ে আসে। ওর নাম সিরাজুল। সাতক্ষীরা টাউন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। ওরা বাড়ি যাচ্ছে। আম্মা আর আব্বা ফিরেছেন পরশু।
‘ওটা কী?’
‘এলএমজি।’
‘অ্যাঁ!’
‘শর্ট মেশিনগান।’
‘শর্ট? মেশিন? গান?’
‘জি।’
‘সাদাপোশাকে ইন্ডিয়ান আর্মি নাকি তুমি সিরাজুল?’ আমি হেসে জানতে চাইলুম। সবাই হাসি থামালে তারপর সিরাজুল একা হাসল, ‘জি না। আমি সিরাজুল। সিরাজুল ইসলাম।’ মুক্ত সাতক্ষীরায় আজ বড় মিটিং সে জানে। কিন্তু তার যাওয়া হবে না। বোনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই সে ক্যাম্পে রিপোর্ট করবে।
‘গাঁয়ে একটা কচুগাছ থাকলে তার আড়ালেও আমি লড়তে পারি। ওরা পারবে?’ তার কথা শুনে চমকে উঠি। আল মাহমুদও তো তাই বলতে চেয়েছিল। আল মাহমুদের সদ্য প্রকাশিত ‘ক্যামোফ্লাজ’ কবিতাটি আমার স্বতঃই মনে পড়ে যায়। যেখানে পরিখার ভেতর থেকে একটি আস্ত বনানীসহ জেগে উঠেছে একজন মুক্তি সেনানীর সতর্ক হেলমেট! কথা শেষ করে সিরাজুল এতক্ষণে হাসে, ‘হা হা।’ ওই স্বভাব সিরাজুলের।
‘ভিয়েতনামে ৮ বছরে যা পারেনি, আমরা ৮ মাসে তা–ই পেরেছি। মুক্তি ফৌজ পিছু হটতে জানে না।’ বললে সিরাজুল। সিরাজুলের অপরাভূত মুখশ্রীকে তুলে ধরার জন্য সিরাজুলের ঘাড়ের পেশি ফুলে উঠতে আমি দেখি।
মামুদপুরে একটি মিলিটারি ট্রাক ঢালে পড়ে গেছে। সেটিকে রাস্তায় তুলে দেওয়ার জন্য বাসটির সাহায্য চাইলেন আর্মির একজন অফিসার। বাস খালি করে আমরা নেমে পড়লুম। অপেক্ষা না করে মুক্তি ফৌজ মার্চ করে বেরিয়ে যায়। মুক্তি ফৌজ অপেক্ষা করতে জানে না।
এই অবসরে জাল ফেলে জলা থেকে উঠে এল মামুদপুরের সোবাহান আলি (২৫)। সে প্রায় জোর করে গাঁয়ের ভেতরে আমাদের ডেকে নিয়ে যায়। গাঁয়ের প্রান্তে প্রবহমান খালের ধারে একটা লম্বাপানা গর্তের চারিদিকে ইতস্তত নরকঙ্কাল, হাড় ও খুলি পড়ে আছে। মাটির সঙ্গে পচা মাংস মিশে আছে। একটি ভাঙা চশমা আমরা সকলেই দেখেছি। গর্তের মধ্যে কিছু নেই। একটা সাড়ে চার ফিট কেউটের অটুট খোলস পড়ে আছে। কেউটেটা নেই।
সোবাহান আলির কোমর পর্যন্ত ভিজে, গায়ে ফতুয়া। শীতে কাঁপতে কাঁপতে গর্ত দেখিয়ে সোবাহান আমাদের বলল, ‘এইখানডা।’ এইখানে একজনকে শুইয়ে গুলি করেছে আর একজনকে তুলতে বলেছে। তারপর তাকে বলেছে শুতে। ‘এই রকমভাবে গেল হপ্তায় ২০/২৫ জনকে মেরে ফেলতে আমরা দেখেছি। গন্ধে এদিকে গরু আসত না।’ গত ৮ মাসে এদিক-সেদিক থেকে এনে অন্তত ১ হাজার ২০০ লোক এই মামুদপুরেই মারা হয়, বেশির ভাগ বেয়নেট চার্জ করে। কেউ কেউ দেড় থেকে দু হাজারও বলেছেন। সাতক্ষীরা রোডের দিকে ফেরার পথে একজন গ্রামবাসী একান্তে আমাকে একটি কথা বলে, যা প্রকাশ করার সব পাপ আমার, যে জন্য আমি তার কাছে পুনঃ পুনঃ ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। কিন্তু ঈশ্বর জানেন, সত্যের খাতিরেই আমাকে এটা করতে হচ্ছে। ‘আমাদের গাঁয়ে ওরা ছেলেমেয়ে পায় নাই। শেষ রাতে পুকুর থেকে দাদি গোসল করে উঠছে—কী বলব বাবু, বলা যায় না—’। সে আমাকে বলেছিল। বলতে বলতে বুকের ওপর ঝুলে পড়েছিল তার যুবাবয়সী মুণ্ডু। যেতে যেতে মামুদপুর গাঁয়ে তিনটি ছইঢাকা গরুর গাড়ি ঢোকে, পুরুষরা হেঁটে যাচ্ছে। পুকুরে জাল পড়ছে। ওদিক দিয়ে অনেকগুলো হাঁস জলে নেমে পড়ে।
মামুদপুরের পর তালবেড়ে। তালবেড়েতে ফেলে আসা বাসটিকে আমরা পেয়ে যাই ও ছেড়ে দেই। মানুষজনের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে পূর্ববৎ ফেটে পড়ছিল বাসটি। আজ সাতক্ষীরায় আঞ্চলিক প্রশাসনের উদ্বোধন, বিকেলে সভা, ওরা যাচ্ছে সেখানে। আলিপুর বাজার গাঁয়ে জলের জন্য বাস দাঁড়িয়ে। এখানে একটি বড়সড় হাইস্কুল রয়েছে। চা ও পানবিড়ির দোকানে বেশ কিছু লোকে ট্রানজিস্টরে ১টা ২৫–এর ভারতীয় খবর শুনছে। এখান থেকে একটা ভারতীয় আধুলি দিয়ে ঢাকায় তৈরি এক প্যাকেট পৃথিবীর সুলভতম সিগারেট কিনে ফেলি। নাম, ‘রূপালী’। নামটি ছিল বাংলা অক্ষরে। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে সুদীর্ঘভাবে কালীগঞ্জ রোড এখানে মিশেছে। দিগন্ত পর্যন্ত দেখা যায়। ১৫–২০টি গরুর গাড়ি আসছে।
আলিপুরের পর তীরমোহনা। তারপর বাকাল পোল, যা পালাবার আগে পাকসৈন্যরা গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়। গ্রামের লোকে সানন্দে পুনর্নির্মাণ করে দিয়েছে। ধ্বংস থেকে নির্মাণের ব্যবধান মাত্র ২ দিন!
তারপর পটাগাছা। ইটাগাছার এনায়েত খানের (৮১) বাড়ি থেকে পাঞ্জাবি সেনারা ঘড়ি, বন্দুক, ট্রানজিস্টার—সব নিয়ে গেছে। গরু-ছাগল টেনে নিয়ে গেছে। বাড়ির মেয়েরা এখনো ফেরেননি। বৃদ্ধের দেখাশোনার জন্য শুধু একটি দাসী ছিল। ডাক্তারিমতে সে তখনো রমণী হয়নি, যখন ৪ জন পাঠান সৈন্য তাকে ধরে নিয়ে যায়। সাতক্ষীরার একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার এখন মেয়েটির চিকিৎসা করছেন। মুসলিম মেয়েদের নাম কী মিষ্টি হয়। এর নাম সাবিহা, মানে নাকি ভোরের হাওয়া। আশা করি বসন্তের? ওহ, ভাবা যায়!
শোনা গেল, পাশেই কার্তিক বোসের বাড়ি ধ্বংসস্তূপ। ‘ও! কার্তিক বোস? আই নো।’
‘ক্রিকেটার নাকি?’
‘আরে না মশায়’, বৃদ্ধ মহম্মদ আলির সামনে তারাপদ রায় আমাকে চাপা ধমক দেয়, ‘আচ্ছা ঘটি তো আপনি। এসব বাঙালে কাণ্ডোয় আপনি ঢুকে পড়েছেন কী করতে! কার্তিক বোসের ল্যাবরেটরি, নাম শোনেননি? আপনার দাদার পায়ে কড়া হয়নি? কর্ণহীলার লাগাতে দেখেননি? টাঙ্গাইলে থাকতে আমার বাবার পায়ে কড়া হয়েছিল।’
বাড়িটি ধূলিসাৎ কিন্তু একতলা ছিল শুনে আমি একটু ঘটিসুলভ গোয়েন্দাগিরি না করে পারি না। ক্রিকেটার অবশ্যই নয়, কিন্তু ফার্মাকোলজিস্টও না। ইটাগাছার সয়ীদুল ইসলাম (২৫) আমাকে জানালেন সাতক্ষীরা বাজারে কার্তিক বোসের একটি কাপড়ের ‘টহল’ (স্টল) ছিল। একটা ছোট সংসার ছিল। এক ভাই ছিল। স্ত্রী ও বাচ্চা ছিল দুটি। এখন নেই। কিছু নেই। কেউ নেই। ইটাগাছার কার্তিকচন্দ্র বোস, বয়স ২৫, দোহারা, কালো বেঁটেখাটো। ডান গালে মস্ত আঁচিল। আপনার বন্ধ ও পাশের বাড়ির ইটাগাছার সয়ীদুর ইসলাম জানাচ্ছেন, আপনি যেখানেই থাকুন, সপরিবার ফিরে আসুন। আপনার ছোট্ট ধানের গোলাটি আশ্চর্যজনকভাবে আজও অক্ষত থেকে গেছে। একটি শিমগাছ কয়েকটা হলুদ ফুলসহ বেড় দিয়ে লতিয়ে ওঠে। গোলাটি এখনো আপনার জন্য রক্ষা করছে।
বেলা দুটো। সাতক্ষীরা এখান থেকে ৯ মাইল। একজন সাইকেল আরোহীকে লিফট দিতে বলি। বাকি রাস্তা আমিই চালিয়ে নিয়ে যাই। বন্ধুরা একটু পিছিয়ে পড়লেন, সঙ্গে পদব্রজে বহু মানুষজন, সাইকেল অন্তত ৩০টি, সকলেই তাঁর মহার্ঘতম পোশাকটি পরে বেরিয়ে পড়েছেন। সকলেই চলেছি সাতক্ষীরার মিটিংয়ে। আর্মির একটি জিপ আসতে দেখে আমি নেমে সরে দাঁড়াবার প্রস্তাব দেই। ‘না না, ওরাই পাশ দেবে, সরে যাবে’, আবদুস সবুর (১৭) উদ্ভাসিত মুখে জানায়, ‘আজ ৮ মাস পরে সাইকেল চাপছি!’ বৃদ্ধ এনায়েত খানও তা–ই বলেছিলেন, ‘এরা বন্ধুর মতো ব্যবহার করছে।’ অর্থাৎ ইন্ডিয়ান আর্মি। ফেরার সময়ে বিকেলবেলা রিকশচালক গফুরও (৩৫) একটি আর্মড কার আসতে দেখে গতি কমায়নি। রাতদুপুরে তার বাড়িতে পাঠান সেনার মাতাল পদাঘাত, ‘ইধর দুশমন অ্যায়?’ সাইকেলের রডে বসে আবদুস সবুরও অনুরূপ কাহিনি শোনাল। সে আসছে ভারোখালী থেকে।
সাতক্ষীরা পৌঁছলুম আড়াইটে নাগাদ। রোদ উঠেছে ভালোই, উত্তরের উপভোগ্য হাওয়ায় বাড়িতে বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা থেকে উড়ছে ঘন সবুজ ও লাল সোনালি। অনেকেই বেরিয়ে পড়েছে। এক জায়গায় আহারাদির পর বাড়ির সামনে রোদে মাদুর পেতে বরাবরের কুঁড়েমি করছে কয়েকজন। তাদের সামনে পানের ঝুড়ি নামিয়ে রেখে পসারিণী বুড়ি পান সাজিয়ে দিচ্ছে। ট্রানজিস্টারে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ বেজে চলেছে। এখান থেকে সাতক্ষীরা টাউন স্কুলের চওড়া দেয়ালের বুলেট বিক্ষত বুকে লটকানো দুটি বড় বড় পোস্টারের অক্ষুণ্ন মাহত্ম্য চোখে পড়ে:
১.
এক একটি বাংলা অক্ষর
অ আ
ক খ
এক একটি বাংলা অক্ষর
২.
এরা জানোয়ার (এখানে কামরুল হাসানের আঁকা রাক্ষসের প্রসিদ্ধ ছবির প্রিন্ট: ইয়াহিয়া খান) এদের হত্যা করতে হবে।
উল্টো দিকে কালীপদ রায়চৌধুরীর দালানকোঠার ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ে। প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএপি) মুসীর আহম্মদের বাড়িটি রয়েছে, দরজা-জানালা সব পোড়া। ভেতরে ঢুকে দেখি...একটাও ঘর নেই। এমন দোতলা বাড়িতে মনে হয় দুঃস্বপ্নে আগে একবার ঢুকেছিলাম। সিলিং পর্যন্ত ঝলসানো। শুধু উঁচু উঁচু দোতলা দেয়াল! স্তূপাকার ধ্বংসের ওপর একটি কুকুর ঘুমিয়ে।
গত ২২ এপ্রিল সাতক্ষীরায় ঢুকে পাঠান সৈন্যরা এই বাড়িটায় প্রথম আগুন লাগায়। সাতক্ষীরায় এলে শেখ সাহেব বরাবর এই বাড়িতে উঠতেন। সুরাবর্দি, ভাসানী—কে না এসেছেন! শেখ সাহেব শেষবার এসেছিলেন ১৯ নভেম্বর।
মুসীর আহম্মদের বাড়ির ভেতরে টলটলে পুকুর। পুকুরে মাছ নেই। ১০–১২টা নারকেলগাছ পুকুরপাড়ে। মুসীর সাহেবের বড় দাদা আনীস আহম্মদ (৭০) সম্পন্ন চাষি। তাঁর গোলা থেকে এই ৮ মাসে ৩০–৩২ বস্তা ধান ও ২০–২২ বস্তা চাল নিয়ে গেছে। সাশ্রুলোচনে বললেন, ‘বাবারা, এই বুড়ো মানুষকে বললে, ডাব পাড়। বললাম, আমি জানি না পাড়তে। তখন বুকে পিস্তল ধরলে। জীবনে প্রথম গাছে চড়ে ডাব পেড়ে দিয়েছি বাবা। নিচে থেকে হুকুম দিল, মুচিগুলো ভেঙে দাও। নিজের হাতে পোঁতা এই সব গাছ...ও হো হো হো হো।’ তারপর যতক্ষণ ছিলাম সে কান্না থামেনি।
খবর পেয়ে মুসীর আহম্মদ (৪২) এসে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে গা থেকে ছাই ঝেড়ে সে কি প্রকাণ্ড লাফে লাফিয়ে এল সাতক্ষীরার নেড়িকুত্তা, কোনো এক অতি শারীরিক উপায়ে দুপায়ে দাঁড়িয়ে প্রভুর কাঁধ বরাবর বিছিয়ে দিল তার দুটি হাত। যেন গলা জড়িয়ে ধরতে চায়। তার ব্যতিব্যস্ত আদর–শাসন করার জন্য গলা চড়িয়ে মুসীর আহম্মদ হাঁকতে লাগলেন, ‘টাইগার! টাইগার!’...‘এই একটাই স্মৃতি থেকে গেছে’, বিষণ্ন হেসে বললেন আমাদের।
‘একটা ভালো লাইব্রেরি ছিল আমার বুঝলেন। অনেক রেয়ার বই ছিল, যা আর পাওয়া যাবে না। আম্বেদকরের “থটস অন পাকিস্তান” বইটা কজনের কাছ আছে তা জানি না।’ মুসীর সাহেবের শ্বশুর হলেন জালালউদ্দিন হাসেমী। অবিভক্ত বাংলার ডেপুটি স্পিকার ছিলেন, যাঁকে বলা হতো খোঁড়া হাসেমী। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের সেই বিখ্যাত সভার মঞ্চ থেকে সুভাষ চন্দ্র গ্রেপ্তার হওয়ার পরেই খোঁড়া পায়ে অকুতোভয়ে এগিয়ে যিনি পাঠ করেছিলেন সুভাষের অসমাপ্ত ভাষণ। পুলিশের ভ্যান থেকে জনতার দিকে লাঠি ছুড়ে দিয়ে হাসেমী পুলিশকে বলেছিলেন, ‘বাট ইউ কান্ট অ্যারেস্ট মাই ক্রাচ।’
হাসেমীর ছেলে কামাল বখত জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) মধ্যবয়সী, মুখে হাসি, চামড়া, লাবণ্যময়, রং টকটকে ফরসা। পরনে লক্ষ্ণৌ পাঞ্জাবি ও ঢিলে পায়জামা। ঠোঁট দুটি অসম্ভব পাতলা, অমনই রাঙা, পান একদম খান না। এঁর ভাই হচ্ছেন বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ কবি সিকান্দার আবু জাফর, ‘সমকাল’ নামে অসাধারণ সাহিত্যপত্রের সম্পাদক, যা ডাকযোগে অজ্ঞাতপরিচয় আমাতে বারংবার উপহার পাঠিয়েছেন। বাবার গল্প কামার বখত সাহেবের মুখেই শুনলাম। মুসীর আহম্মদ আবার হাসেমীর জামাই। শালা-ভগ্নীপতি দুজনেই আজকের সভায় বক্তৃতা করবেন।
আমাদের সঙ্গে ছিল ডিম, পাউরুটি, সেদ্ধ আলু ও কলা। মুসীর আহম্মদের পোড়া বাড়ির বারান্দায় বদনার জলে হাত–মুখ ধুয়ে আমরা মধ্যাহ্নভোজনে বসলুম।
বৃদ্ধ আনীস আহম্মদের সঙ্গে ট্রে হাতে ও কে! শবনম না? ‘এ হচ্ছে আমাদের মুসীবের ছোট মেয়ে’, জ্যাঠামশাই আলাপ করিয়ে দেন। গুডনেস! সিরাজুল তাহলে কে? এর ফুফাতো ভাই। কোথায়? নেই। সে ক্যাম্পে ফিরে গেছে।
কপট নমস্কারের ভঙ্গিতে কাঁধের ওপর দুহাত জড়ো করে আমি শবনমের সঙ্গে পরিচিত হই। সে প্রতি-অভিবাদন করে না। তবু সে হাসে না। একবারও চোখের দিকে না তাকিয়ে, ফাঁকি দিয়ে, গম্ভীর মুখে সাতক্ষীরার বিখ্যাত ছানার মুড়কির ৪টে প্লেট শবনম এক এক করে এগিয়ে দেয়। আনীস আহম্মদ এখনো কাঁদছেন। পাঞ্জাবির হাতা ভিজে ঢোল হয়ে গেছে। ‘১০০ জন লোক এলে আমার বাড়ির থেকে ১০০টা প্লেট বেরোত, আর আজ ৪টির বেশি—ওহো হো হো হো।’ কিন্তু তখন কে শোনে বৃদ্ধের বিলাপ! শবনম আবার হেসে ফেলেছে। শুধু তা–ই নয়, এখনো ফিক ফিক করে হাসছে। এবার হাসিয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
আধঘণ্টার মধ্যে ডাক এল এমাদুল হকের বাড়ি থেকে। মুক্তিফৌজের সঙ্গে আবার ভরা পেটে খেতে বসতে হলো ভাত ও মাংস। খেতে খেতে আলাপ হলো পংকজ মিত্রের সঙ্গে। ইনি ছিলেন রাজশাহীর বিখ্যাত সারদা পুলিশ একাডেমির চিফ ইনস্ট্রাক্টর। বাংলাদেশ সরকার পরশুদিন একে খুলনা জেলার এসপি নিযুক্ত করেছেন। কালই তিনটি থানায় ইনি নতুন ওসি নিয়োগ করেছেন। এসডিও মহ. শাহজাহান আলি, সাতক্ষীরার ওসি মি. এইচ এম হান্নান, সেকেন্ড অফিসার মোয়াজ্জেম খান, সবাই পাত পেড়েছেন। আবদুল রহিম অ্যাডভোকেট। বললেন, কোর্ট আজকালের মধ্যেই খুলবে। আবদুল গফফর, মাদ্রাসার শিক্ষক, গুনাগারকাটি। মাদ্রাসা খুলেছে। আবদুস সোবাহান, অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান, সাতক্ষীরা কলেজ। ৮ মাস পরে কলেজ খুলেছে। হাজিরা ৫০%। শেখ আবদুল আহাদ। ‘টাইম প্রিসিশান’ নামে সাতক্ষীরা বাজারে ভূতপূর্ব ঘড়ির দোকানের মালিক। ২২ এপ্রিল ১২ হাজার টাকার জিনিস খানেরা লুট করে। চাবুক খেয়েছেন দুবার। কালিদাস চক্রবর্তী এসেছেন ২০ বছর পরে ভিটে দেখতে। টেলিফোন অফিসের ইঞ্জিনিয়ার শেখ মজনু হাসান জানালেন, ৪ দিন হলো পাওয়ার সাপ্লাই এসেছে—ব্যাটারি চার্জ কমপ্লিট—৯৮টি টেলিফোনই চালু করেছেন। ‘রাস্তায় প্রতিটি লাইটপোস্ট জ্বলছে এবং আজ থেকে বিল্ডিংয়ে আলো জ্বলবেই’, বললেন ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটির ডিভিশান ওয়ানের কর্তা আফাজউদ্দিন। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম ২২ এপ্রিল থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে খান সেনারা ছিল। ৬–এ–ই পালায়। পালাবার আগে ৪ঠা ডিসেম্বর ভোর সাড়ে চারটের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, যেন ভূমিকম্পে থরথর করে কেঁপে উঠল গোটা সাতক্ষীরা টাউন...২০টা মাইন একসঙ্গে ফাটিয়ে ওরা বাঁকাল নদীর স্লুইস গেটটি ভেঙে দিয়ে যায়। ৩০ ফিট কংক্রিটের ওপর ছিল গেটটি। ২৭টা গ্রামের ‘পানি ভাঙত’। আগামী বর্ষায় নির্মাণ না করলে গ্রামকে গ্রাম ডুবে যাবে। লোনাজল ঢুকবে ও ধান হবে না।
গত ৮ মাসে এদিক-সেদিক থেকে এনে অন্তত ১ হাজার ২০০ লোক এই মামুদপুরেই মারা হয়, বেশির ভাগ বেয়নেট চার্জ করে। কেউ কেউ দেড় থেকে দু হাজারও বলেছেন। সাতক্ষীরা রোডের দিকে ফেরার পথে একজন গ্রামবাসী একান্তে আমাকে একটি কথা বলে, যা প্রকাশ করার সব পাপ আমার, যে জন্য আমি তার কাছে পুনঃ পুনঃ ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। কিন্তু ঈশ্বর জানেন, সত্যের খাতিরেই আমাকে এটা করতে হচ্ছে। ‘আমাদের গাঁয়ে ওরা ছেলেমেয়ে পায় নাই। শেষ রাতে পুকুর থেকে দাদি গোসল করে উঠছে—কী বলব বাবু, বলা যায় না—’। সে আমাকে বলেছিল। বলতে বলতে বুকের ওপর ঝুলে পড়েছিল তার যুবাবয়সী মুণ্ডু। যেতে যেতে মামুদপুর গাঁয়ে তিনটি ছইঢাকা গরুর গাড়ি ঢোকে, পুরুষরা হেঁটে যাচ্ছে। পুকুরে জাল পড়ছে। ওদিক দিয়ে অনেকগুলো হাঁস জলে নেমে পড়ে।
বিকেলে সাতক্ষীরা টাউন স্কুলের পেছনে শহীদ রাজ্জাক পার্কে জনসভা। আগে নাম ছিল চিলড্রেনস পার্ক। মার্চের গোড়ায় অসহযোগ আন্দোলনের সময় চাপরা লজের সামনে বাসস্ট্যান্ডের কাছে গুলি চলল। সাতক্ষীরায় এবারের আন্দোলনে সে–ই প্রথম শহীদ, শহীদ রাজ্জাক, একজন রিকশচালক। মিটিংয়ের ভিড় এড়িয়ে পার্কের একদিকে চলে যাই—যেখানে তার স্মৃতিস্তম্ভ ছিল! স্রেফ বুটের লাথি মেরে ভেঙে ফেলা হয় স্তম্ভটি। স্তম্ভের পরেই ঈদগার ঘেরা জায়গা, যেখানে মোনাজাত করা হতো। ‘শুয়ারের বাচ্চারা গরু ধরে এনে এখানে নিলামে চড়াত’, জমিতে থুতু ফেলে বললেন সৈয়দ নওসাদ এরতেজা (২২)। সাহাপার ৩ জন হিন্দু ভাইকে এই এরতেজা আশ্রয় দিয়ে বাঁচায়। তার বন্ধু কেষ্ট পাল, সুরেন, খগেন, বাঁটুল, পূর্ণ স্যার, তারক ঠাকুর (পুরোহিত) মোট ১৫ জন হিন্দুকে খালপাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে, তারপর জলে ফেলে দেয়। এদের মধ্যে শরৎ পাল ছাড়া সে কারুকেই বাঁচাতে পারেনি। ‘ইধর দুশমন অ্যায়?’ সেনারা তাকে প্রশ্ন করে। ‘দুশমন ইধর নেহি মিলেগা’, সে বলে। পরিত্যক্ত কুমোরপাড়ায় একটি বাড়িতে ঢুকে পড়ে তারা ঠাকুরঘর দেখতে পায়। সমস্ত কুমোরপাড়া জ্বলে ওঠে। মাটিতে মিশে যায়। আমাদের একটা ছেলে দেখিয়ে দিয়েছিল, মাথা নিচু করে এরতেজা বলল।
সোনার বাংলা গান দিয়ে শুরু হয়ে গেছে। তারপর গীতা ও কোরআন পাঠ। বাংলায় কোরআন পাঠ এই প্রথম শুনলুম—গদ্য ছন্দে এমন চমৎকার অনুবাদ, ছাপ হয়েছে নাকি! আমি সভার একেবারে পেছনে। পাশেই রাস্তা। রাস্তার ধারে পাকাবাড়ির ছাদ ও বারান্দা, সেখানে দুই করতল জড়ো করে নারীরা মোনাজাত করছেন। ওই একতলা বাড়িটার ছাদের আলসেয়, কে আর সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কে। মোনাজাত শেষে উনি হাত নাড়লেন। মিটিংয়ে তখন ঘন ঘন স্লোগান উঠছে
জঅঅঅয় বাংলা!
ভারত–বাংলাদেশ মৈত্রী
জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!
সাত কোটি মানুষের আর এক নাম
মুজিবর রহমান! মুজিবর রহমান!
জেলের তালা ভাঙব
শেখ মুজিবকে আনব!
জঅঅঅয় বাং–লা!
অলিন্দ থেকে নারী ও শিশুরা উত্তর দিচ্ছে। ধন্য মুজিবর, তোমার অপার বিস্ময় আমার কাছে এ যে একটা গোটা জাতকে তুমি উপহার দিয়েছ দু–দুটি নতুন শব্দ, জয় ও বাংলা, শিশুবৃদ্ধবনিতাসহ একটা গোটা জাত, বড়–গরিব, কৃতজ্ঞচিত্তে তা গ্রহণ করে বহুকাল পরে উপহৃত হবার আনন্দ পেয়েছে।
দিঘির পাড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পাশাপাশি চুপচাপ বসে। খুব কাছ থেকেই সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেমন লাগছে?’ নীরব থাকাই আমি মনে করেছিলাম শ্রেয়। কেননা, আমার মনে হয়েছিল, ওর পুরু লেন্সের ভেতর দিয়ে এত দূরের জিনিস উনি এর আগে এখনো দেখেননি, মাঝখানে এতটা ব্যবধান রেখে সুভাষদা আমাকে আগে কখনো ডাকেননি। উনি এখন ডুবে রয়েছেন কবির মগ্নচেতনায়, আমি টের পেয়েছিলুম। বাস্তবিক, এই কবিকে আমি সর্বত্র দেখেছি—দেখেছি কবিসভায়, পানশালায়, অ্যাকাদেমি পুরস্কার হাতে ওঁর চলচ্চিত্র দেখেছি। ১৯৫৫–য় বাগনানে কৃষকসভার পর এই দ্বিতীয়বার আবার আমি ওঁকে দেখলুম গ্রামবাংলার মানুষজনের সঙ্গে এবং এখানে ছাড়া, সত্যত, এই কবিকে, কোথাও কখনো মানায়নি। পুকুরের চারামাছের মতন এখানেই গ্রামবাংলার এই ধনী প্রকৃতিও খুব বেশি গরিব বোকাসোকাদের মধ্যেই, উনি ওঁর সাম্প্রতিক কবিতার শ্রেষ্ঠ পঙ্ক্তিতে যেমন ‘হানফান করে’ বেড়ে ওঠেন। বস্তুত ওই দিঘির পাড়ে নীরেনদার পাশে সেই একবার, তারপর আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আমরা খুঁজে পাইনি। থেকে গেলেন, মনে হয়।
মিটিং চলছে। ছোট ছোট বক্তৃতা করে চলেছেন এমপিএ ও এমএন এরা। মমতাজ মিয়া (সাতক্ষীরা), আলাউদ্দিন (কনিষ্ঠতম সদস্য-২৪), ফজলুল হক (শ্যামনগর), আবদুর রহমান (বাগেরহাট), কামার বখত ও আবদুর রব সোরনিয়াবাদ—শেষোক্ত দুজন এমএনএ; অর্থাৎ আমাদের এমপি। শেখ আবদুল আজিজ এমএনএ ও খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট। বক্তৃতা আমি কখনো শুনি না। কিন্তু ছাত্রলীগের অতি তরুণ নেতা নসী ময়না (১৮) আমাকে বাধ্য করেছিল শুনতে, যখন সে একটা রাইফেল তুলে ধরে, বক্তৃতা দেয়, চিৎকার করেছিল, ‘ভায়েরা আমার! আমি আর কিছু জানি না! আমার আর কিছু বলার নেই! শুধু বলছি ২৫শে মার্চ যুদ্ধ শুরু করেছি—এখনো যুদ্ধ করছি এবং “দরকার হলে” সারা জীবন যুদ্ধ করব, ইনশা আল্লাহ! এ জন্য জাতির পিতা শেখ মুজিবের কাছে আমি ওয়াদাবদ্ধ।’ সম্ভবত মাইকটি অকারণেই তার সামনে রাখা হয়েছিল। এত চিৎকার করে, শির ফুলিয়ে, সে কথাগুলো বলে। দীর্ঘতম সময়জুড়ে করতালি ও উল্লাস সে–ই পেয়েছিল। আমি ‘কোট’ করেছি তার বাক্যগুলি।
জাল ফেলে জলা থেকে উঠে এল মামুদপুরের সোবাহান আলি (২৫)। সে প্রায় জোর করে গাঁয়ের ভেতরে আমাদের ডেকে নিয়ে যায়। গাঁয়ের প্রান্তে প্রবহমান খালের ধারে একটা লম্বাপানা গর্তের চারিদিকে ইতস্তত নরকঙ্কাল, হাড় ও খুলি পড়ে আছে। মাটির সঙ্গে পচা মাংস মিশে আছে। একটি ভাঙা চশমা আমরা সকলেই দেখেছি। গর্তের মধ্যে কিছু নেই। একটা সাড়ে চার ফিট কেউটের অটুট খোলস পড়ে আছে। কেউটেটা নেই।
পার্কের পরে রিকশর হুড়োহুড়ি। সভা থেকে বেরিয়ে একটা রিকশ নিয়ে গ্যারেজ ব্রিজ পেরিয়ে আমি খাল পর্যন্ত চলে যাই। হসপিটাল রোডের দুধারে সারি সারি দোকান—সাখাওয়াত মেডিকেল স্টোর্স, মমতাজ হোটেল, হ্যানিমান হোমিও ফার্মেসি, সাইকেলের দোকান, ঘড়ির দোকান, লন্ড্রি—সব খোলা। একটি জিপ আসছিল। রিকশঅলার মন্তব্যের কথা আগে বলেছি। দুজন জওয়ান জিপ থামিয়ে একটা স্টেশনারি দোকানে ঢুকে আনা চারেকের মতো চানাচুর কিনল। রিকশ দাঁড় করিয়ে আমি স্বচক্ষে দেখলুম।
মিটিংয়ে ফিরে এলুম। এখন সভা ভাঙার মুখে। নীরেনদা আমাকে কাছে ডাকলেন। হেসে বললেন, ‘ওদিকে এতক্ষণ কী দেখলি?’ আমি মুখ খোলার আগেই বললেন, ‘চুপ’, তারপর অদূরে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই দ্যাখ, পার্কে ঘুগনিওলাএসেছে।’ এবং তার পেছনে এই এত বড় মিটিংকে কুছপরোয়া জ্ঞানে ছেলেমেয়েরা পার্কের একদিকে স্লিপ খাচ্ছে, দোলনা দুলছে—স্কিপিং করছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে। পাখিদের মতোই, সন্ধ্যা হলে ছেলেপিলেদের চেঁচামেচি বেড়ে যায়। আকাশছেঁড়া মেঘ। দিঘির পাড়ে সারি সারি বাবলাপাতা থরথর করে কাঁপছে—গোধূলির এ রকম আলোতেই নিশ্চয়—হাওয়া তো নেই! একটা সাপ ওই দিঘির মাঝবরাবর পৌঁছে গেল আমি দেখি, খেলা নয়, ওপার অবধি যাবে মনে হয়। কলকাতায় ফিরে আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞাস করে, ‘কী দেখলে?’ আমি বলব, হাওয়া বিনা বাবলাপাতার ওই কাঁপনের মতোই কিছুটা আশ্চর্যজনক স্বাভাবিক জীবন এখানে।
সভা ভেঙে গেছে। সব লাইটপোস্টে আলো জ্বলে উঠেছে। হ্যাঁ, ব্ল্যাকআউটফাউট নেই। বাড়িগুলোতে ও দোকানপাটেও জ্বলছে—আজকের মধ্যে জ্বলার কথা ছিল।
ল্যান্ডরোভারে ওঠার আগে একজন বৃদ্ধ—শুধু এঁর নাম ও বয়সই আমার জানা হয়নি—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সোয়েটারের হাত চেপে ধরলেন। কিছুতেই ছাড়তে চান না। সাশ্রুনয়নে উনি কেবলই বলছিলেন, ‘বাবা, এই তো গেল-হপ্তায় ঠিক এমনি মিটিং হয়েছিল…লোকজনও এসেছিল। সেখানেও বক্তৃতা হয়েছিল। এমন কোরআন পড়েছিল। ঠিক এমনি হয়েছিল বাবারা!
আমাকে একটা কথা বলতে দিন। আমি কোনো রাজনৈতিক দলে নেই, এখনও নেই। যে-কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী, যারা সুবাতাস ও সমুজ্জ্জ্বল সমাজ চেয়েছে, আমি তাদের শ্রদ্ধা করি। কিন্তু, তবু, একটি নিষিদ্ধ রাজনীতি আমি করি, যা এখানে প্রকাশ করছি। গত ১০ বছর ধরে কলকাতার প্রায় প্রতিটি বড় জনসভার মঞ্চের পিছনে একা দাঁড়িয়ে পশ্চাৎদেশ থেকে মহিলানেত্রী সহ ছোট বড় মেজো সকল নেতাকে আমি দেখেছি। দেখে আমার মনে হয়েছে যারা সামনে বসে রয়েছে তাদের প্রত্যেকের উচিত পশ্চাৎদেশ থেকে মঞ্চটিকে একবার দেখা। এক-একটি বামনাবতার সব, যে যার রণ পা-র ওপর দাঁড়িয়ে। আমি দেখেছি।
আমি বলতে চাই একটি শিশুরাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। ইতিহাস জন্ম দিয়েছে অতি রহস্যময় এক শিশুকে। এখন এই শিশুর কাছ থেকে তাঁরা দূরে থাকুন, যাঁদের পৃথিবীর সকল শিশুর কাছ থেকে তফাতে থাকা দরকার। ওই নামহীন বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর শুনুন। ওঁর আবেদনের প্রতি আমাদের একটা দায়িত্বে রয়েছে। এই নতুন রাষ্ট্রের যাঁরা দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তাঁরা যদি ওই অরুন্তুদ আবেদনকে মর্যাদা না-দেন, তাহলে আমি সাবধান করে দিচ্ছি, এবার সর্বনাশা পরিণতি হবে। নসীম ময়না ২৫ শে মার্চ এবারের যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যুদ্ধ করছে। এবং ‘দরকার হলে’ সারাজীবন যুদ্ধ করতে সে ওয়াদাবদ্ধ, ইনশা আল্লাহ।
(লেখাটি নেওয়া হয়েছে প্রতিভাস প্রকাশিত সন্দীপন চট্টপাধ্যায়ের ‘গদ্যসমগ্র’ থেকে)