Thank you for trying Sticky AMP!!

ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম

শঙ্খ ঘোষ, (জন্ম ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২-মৃত্যু ২১ এপ্রিল ২০২১)

যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া শহরে কবি-লেখকদের এক বিশ্ব সমাবেশে আট মাস অবস্থানের অভিজ্ঞতা নিয়ে শঙ্খ ঘোষ ডায়েরিধর্মী বই লিখেছিলেন, ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম নামে। উননব্বই বছর পেরিয়ে তিন মাস পূর্ণ হওয়ার কিছু আগে ২১ এপ্রিল ২০২১ তাঁর প্রয়াণের খবরটা শুনে এই শিরোনামটা মনে আসছে শুধু। বিস্তৃত এক মহান জীবনে যে সৃষ্টি তিনি রেখে গেছেন, তা আমাদের পাঠস্মৃতিতে ছবির মতো থেকে যাবে; ছবির নেপথ্যের মানুষটি কেবল ঘুমিয়ে পড়লেন প্রিয় পৃথিবীর অ্যালবামে। অবশ্য কালের ধুলো ঝেড়ে আমরা তাঁকে নিয়তই আবিষ্কার করব নতুন করে।

১৯৩২-এর ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের চাঁদপুরে মামাবাড়িতে জন্ম তাঁর। পৈতৃক নিবাস বরিশালের বানারীপাড়ায়। পড়াশোনা পাবনার পাকশীর চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অধ্যাপনা করেছেন, ছিলেন শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষও।

কবি শঙ্খ ঘোষের প্রথম বই ছিল বিদ্যাসাগরের কিশোর জীবনী (১৯৫৬)। একই বছর প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই দিনগুলি রাতগুলি থেকে শেষ গদ্যের বই ছেড়ে রেখেই ধরে রাখা পর্যন্ত বিচিত্র-বিপুল সৃষ্টিতে সৃজন ও মননের শান্ত-সোচ্চার শব্দশিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন তিনি।

কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্রগবেষক, সম্পাদক তিনি। বিরল এক বিবেকী বাঙালি। নিহিত পাতালছায়া, আদিম লতাগুল্মময়, মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়, বাবরের প্রার্থনা, পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, ধুম লেগেছে হৃৎকমলের অনন্য কবিই আবার নিঃশব্দের তর্জনী, শব্দ আর সত্য, ঐতিহ্যের বিস্তার, এই শহরের রাখাল-এর মতো ব্যতিক্রমী সব গদ্যবইয়ের রচয়িতা। শুধু কি তাই? কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, এ আমার আবরণ, নির্মাণ আর সৃষ্টির মতো বইয়ে রবীন্দ্র-অন্বেষার নতুন মাত্রা যোজনা করেছেন শঙ্খ ঘোষ। ১৯৬৩ সালে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সহযোগে অনূদিত-সম্পাদিত বিশ্বকবিতার বাংলা সংকলন সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তর পাশাপাশি বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে ঘনীভূত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মুহূর্তে লেখা গিরিশ কারনাডের নাটক অনুবাদ করেছেন রক্তকল্যাণ নামে। কবি ইকবালকে নিয়ে বিশদ গবেষণা যেমন করেছেন, তেমনি বাঙালি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন কিউবা কিংবা ইরাকের কবিতার সঙ্গে।

শঙ্খ ঘোষ এক জীবনে প্রমাণ করেছেন প্রত্যক্ষ রাজনীতির খাতায় নাম না লিখিয়েও, জনপ্রতিনিধি না হয়েও কী করে মানুষের প্রাণ-প্রতিনিধি হওয়া যায়। তরুণকাল থেকে প্রায় নবতিপর আয়ুসীমায় এসেও তিনি পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতে সাম্প্রদায়িক শক্তির মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। নীতির প্রশ্নে নিরাপস মানুষটি রাষ্ট্রীয় খেতাব বর্জন করতেও দ্বিধা করেননি। শারীরিক অসুস্থতাকে তুচ্ছ করে জনদাবিতে রাজপথে নেমেছেন; কখনো কোনো সমাবেশে বা মিছিলে তাঁর উপস্থিতিই হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মহিমাদীপ্ত প্রতিবাদ।

সন্ধ্যানদীর জলে বাংলাদেশ শঙ্খ ঘোষ ।

২০১৯ সালে প্রথমা প্রকাশনের জন্য আমাকে শঙ্খ ঘোষের বাংলাদেশবিষয়ক গদ্য লেখার একটি সংকলন প্রস্তুতের প্রস্তাব দেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তাঁর খণ্ড খণ্ড গদ্যসংগ্রহে সন্ধান চালিয়ে এবং অগ্রন্থিত কিছু লেখাসমেত একটি পাণ্ডুলিপি দাঁড় করাই। প্রথমার হয়ে কবি সাজ্জাদ শরিফ আমার তৈরি করা খসড়া পাণ্ডুলিপিটি কলকাতায় তাঁকে পৌঁছালে তিনি বই করার সানন্দ সম্মতি দেন এবং এ-ও বলেন, ‘তাহলে তো আমার সমগ্র রচনাই প্রকাশ করতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ তো ব্যাপ্ত আমার সব লেখার গভীরেই।’

বইয়ের নাম দাঁড়ায় সন্ধ্যানদীর জলে: বাংলাদেশ। কবিতায় বাংলাদেশের স্মৃতিময় সন্ধ্যানদী নিয়ে তিনি যেমন বলেছেন:

‘আমার সম্বল শুধু ঝুমকোঘেরা মঠ অবিকল/ আমার নদীর নাম সন্ধ্যানদী, তুমি তার জল।’

‘একুশে, একাত্তর ও নববর্ষ’, ‘ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান’, ‘গানের ভিতর দিয়ে’, ‘শিক্ষা-আন্দোলন’, ‘স্মৃতি, ভ্রমণ’—এমন পাঁচ অধ্যায়ে বিন্যস্ত বইটি সেপ্টেম্বর ২০১৯-এ প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয়ে দুই বাংলাতেই পাঠক-আদৃত হলো।

তবে তাঁর হাতে বইটি তুলে দেওয়া গেল ৯ নভেম্বর ২০১৯। আমার সঙ্গে ছিলেন ‘স্টুডেন্ট ওয়েজ’-এর প্রকাশক মাশফিকউল্লাহ তন্ময় এবং প্রথমা প্রকাশনের পক্ষে হুমায়ুন কবীর। হুমায়ুন ভাই মতিউর রহমানের আকাশভরা সূর্যতারা বইটি উপহার দিলে সূচিপত্রে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পরিতোষ সেন—আমার সব প্রিয় মানুষদের নিয়ে লেখা দেখছি! বন্ধু তন্ময় আনোয়ার পাশার নীড়সন্ধানী উপন্যাসটি উপহার দিতেই তাঁর বাল্যবন্ধু একাত্তরের শহীদ আনোয়ার পাশার কবিতা স্মৃতি থেকে শোনালেন—

‘এই মাটিতে এখনও আছে বেঁচে থাকার মানে।’

তারপর সন্ধ্যানদীর জলে: বাংলাদেশ বইটি হাতে নিয়ে মৌন বসে রইলেন। মৌনতার সুতোয় বোনা চাদরে স্মিত হাসির উদ্ভাসে যেন জানালেন তাঁর ভালো লাগার কথা। আর ভালোবাসার বাংলাদেশ তো ছিল শঙ্খ ঘোষের হৃদয়জুড়ে, যেমনটি সন্ধ্যানদীর জলে বইয়ের ‘আত্মপ্রসঙ্গ’-এ তিনি লিখে গেছেন:

‘এমন কবিতা কমই লিখেছি যার মধ্যে—শব্দে বা প্রতিমায়—বাংলাদেশই প্রচ্ছন্ন হয়ে নেই। স্মৃতিমূলক এমন গদ্যও আছে কম, অন্তঃসারে যা বাংলাদেশকেই ধারণ করে রাখেনি। এ তো সত্যি যে মুহুর্মুহু আমি বেঁচে থাকি বাংলাদেশেরই মধ্যে।’