নয়ন মুন্সীর ছবি অবলম্বনে গ্রাফিকস
নয়ন মুন্সীর ছবি অবলম্বনে গ্রাফিকস

নয়ন মুন্সীকে কি আমরা মনে রেখেছি?

প্রথম বাংলাদেশি গিটারবাদক হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতি পেয়েছিলেন নয়ন মুন্সী। ব্যান্ডতারকা ও গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু মূলত তাঁকে দেখেই একসময় গিটারবাদক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই নয়ন মুন্সীর যাত্রা থেমে গিয়েছিল এক গাড়ি দুর্ঘটনায়, ১৯৮১ সালের ২১ অক্টোবর। আজ তাঁর মৃত্যুদিনে এই তারকার দিকে ফিরে দেখা।

গিটার হাতে নয়ন মুন্সী

‘নয়ন সবার নয়ন মণি
কানাডায় গিয়েছিল গাইতে সে গান
দেশে আসার কথা ছিল
সেই যে গেল ফিরে এল না
হলো মরণ, নয়ন সবার।’
কিংবদন্তি শিল্পী আজম খানের এই গান হয়তো আপনারা অনেকেই শুনে থাকবেন। এই গানে আদ্যন্তে একজন ‘নয়ন’–এর গল্প বলা হয়েছে। কিন্তু কে এই নয়ন মুন্সী! কেনই–বা আজম খান তাঁকে নয়নের মণি বলছেন! আবার আজ ২১ অক্টোবরেই কেন তাঁকে নিয়ে লিখছি! আমরা মূলত জন্মদিন অথবা মৃত্যদিনে স্মরণীয়দের মনে করে দু-চারকথা লিখি। হ্যাঁ, আজ তাঁর মৃত্যুদিন।

ফিরে যাই ১৯৮১ সালের এই দিনে, কানাডাতে। এক সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু হয় ২০ বছর বয়সী নয়ন মুন্সীর। গাড়ি চালাচ্ছিলেন নিজেই। তো ওই দুর্ঘটনায় সব শেষ। সময়ের অনিবার্যতায় নিভে গেল একটি নক্ষত্র।

তাঁর পুরো নাম নয়ন হক মুন্সী। ১৯৬১ সালের ১৮ এপ্রিল জন্মেছিলেন বাংলাদেশি এই গিটার জাদুকর। আজম খানের ভাষ্যমতে হয়তো আগামী ২০০ বছরেও বাংলাদেশে এমন গিটারিস্টের জন্ম হবে না। নয়ন মুন্সী বাংলাদেশের প্রথম গিটার সেনসেশন। যাঁকে দেখে তখনকার অনেক তরুণ হাতে তুলে নিয়েছিলেন গিটার, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে খ্যাতি পেয়েছেন। তাঁদেরই একজন কিংবদন্তি ব্যান্ডতারকা প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চু। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে আজম খানের সঙ্গে নয়ন মুন্সীর গিটার বাজানো দেখে আইয়ুব বাচ্চু স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনিও নয়নের মতো গিটারিস্ট হবেন। ‘মাইলস’ ব্যান্ডের সদস্য ও বামবা সভাপতি হামিন আহমেদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সেই প্রজন্মের অধিকাংশ গিটারিস্টের অনুপ্রেরণার নাম ছিল নয়ন মুন্সী। শুনেছি, বাংলাদেশের অন্যতম সেরা গিটারবাদক-শিক্ষক প্রয়াত নিলয় দাশ ছাত্রদেরকে নয়ন মুন্সীর গল্প শোনাতেন।

আজম খান, সত্তর দশকে

এত সব অভিধা যাঁর, সেই নয়ন মুন্সী বেঁচে ছিলেন মাত্র ২০ বছর। ক্ষণজন্মা এই প্রতিভার মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে ৪০ বছর। নয়ন মুন্সীর গাওয়া কোনো গান, গিটারওয়ার্কের রেকর্ডেড কিছু কোথাও তেমন পাওয়া যায় না। এই দুয়ে মিলেই হয়তো আমাদের এই প্রজন্ম তাঁর নাম তেমনভাবে শুনতেই পায়নি। জানা যায় লাকী আখান্দের সুরে, হ্যাপী আখান্দের গাওয়া ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানে গিটার বাজিয়েছিলেন নয়ন মুন্সী। বিখ্যাত এই গান আমরা সবাই–ই শুনেছি, গিটারের মূর্ছনায় মাত হয়েছি।

নয়ন মুন্সী জন্মেছিলেন ঢাকার শান্তিনগরে, এক সংগীতপরিবারে। ১১ ভাই–বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল নয়ন। তাঁর প্রায় সব ভাইবোনই সংগীতের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন। সংগীত–অনুরাগী বড় ভাই কামাল হক ছিলেন মূলত পূর্ব পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়ন বক্সার। তাঁর হাত ধরেই হক পরিবারের সন্তানেরা গানবাজনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। নয়ন মুন্সীর বড় ভাই আলমগীর হক এই পরিবারের সবচেয়ে সফল সংগীতশিল্পী। আলমগীর হককে তো চেনেন? আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় পপগায়কদের একজন তিনি। এই উর্দু পপতারকাকে অনেকে ‘প্রাচ্যের এলভিস প্রিসলি’ বলে থাকেন। এই আলমগীর হক আবার ১৯৬৪-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা–পূর্ব বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্যান্ড ‘আইওলাইটস (উইন্ডি সাইড অব কেয়ার)’–এর প্রথম ভোকাল ছিলেন, হারমোনিকাও বাজাতেন। বড় কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে তিনি সেই সময়েই করাচি চলে যান।

নয়নের আরেক বড় ভাই জামাল হক মুন্সী ছিলেন তবলাবাদক, ওস্তাদ জাকির হোসেনের ছাত্র। আরেক ভাই জাহাঙ্গীর হক ছিলেন ড্রামার। অন্য আরেক ভাই দস্তগীর হক বাংলাদেশ স্বাধীনের পর গঠন হওয়া প্রথম ব্যান্ড ‘আন্ডারগ্রাউন্ড পিস লাভার’–এর ভোকাল ছিলেন। আর বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার জর্জিনা হক এই পরিবারেরই মেয়ে। জর্জিনা হক এবং তাঁর বোনেদের ব্যান্ড ছিল ‘থ্রি হক সিস্টার্স’ নামে। পরিবারের এতজনকে দেখে স্বাভাবিকভাবেই খুব অল্প বয়সে গিটারে হাতেখড়ি হয়েছিল নয়নের।

স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নয়ন মুন্সীর ইচ্ছে ছিল বড় গিটারিস্ট হবার, আর সে জন্য কঠোর অনুশীলন করতেন তিনি। ঘুম থেকে উঠে গিটার, ঘুমাতে যাবার আগেও গিটার। যেখানেই যেতেন সঙ্গে রাখতেন, তাই সারা দিন কাটত গিটারের সঙ্গেই। একটি সাক্ষাৎকারে নয়ন মুন্সীর বন্ধু ‘মাইলস’–এর শাফিন আহমেদ জানিয়েছিলেন, ঢাকার সায়েন্স ল্যাবে চলতি রিকশায় তাঁকে গিটার বাজাতে দেখা যেত হরহামেশাই। তাঁর স্কুলের এক বন্ধুর কাছে শুনেছি, তাঁরা যখন স্কুলে আড্ডা দিতেন, সে সময় দেখা যেত গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে একমনে গিটার বাজাচ্ছেন নয়ন।

একেবারে নিজের চেষ্টায় শিখেছেন প্রথমে, তখন তো শেখার এত সব মাধ্যম ছিল না।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নয়ন মুন্সীর ইচ্ছে ছিল বড় গিটারিস্ট হওয়ার, আর সে জন্য কঠোর অনুশীলন করতেন তিনি। ঘুম থেকে উঠে গিটার, ঘুমাতে যাবার আগেও গিটার।

যেখানেই যেতেন, সঙ্গে রাখতেন, তাই সারা দিন কাটত গিটারের সঙ্গেই। একটি সাক্ষাৎকারে নয়ন মুন্সীর বন্ধু ‘মাইলস’–এর শাফিন আহমেদ জানিয়েছিলেন, ঢাকার সায়েন্স ল্যাবে চলতি রিকশাতে তাঁকে গিটার বাজাতে দেখা যেত হরহামেশাই। তাঁর স্কুলের এক বন্ধুর কাছে শুনেছি, তাঁরা যখন স্কুলে আড্ডা দিতেন, সে সময় দেখা যেত গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে একমনে গিটার বাজাচ্ছেন নয়ন। বন্ধুরা যেখানে বিকেলে মাঠে ফুটবল খেলেছেন, তখন তিনি হয়তো সিনিয়র মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে অনুশীলন করছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিংবা কোনো শোতে বাজাতে গেছেন গেস্ট গিটারিস্ট হিসেবে। এর বাইরে হোটেলেও বাজাতেন নয়ন মুন্সী। তখন ‘অস্থির’ নামে ব্যান্ডও বানিয়েছিলেন তাঁর মিউজিশিয়ান বন্ধুরা মিলে। মূলত নয়ন মুন্সীর চঞ্চলতা, অস্থির প্রকৃতির জন্যই এমন নাম বেছে নিয়েছিল সবাই। এভাবে গানের সূত্র ধরেই কিশোর বয়সে সান্নিধ্য পান আজম খানের। প্রথম ১৯৭৫ সালের দিকে আজম খানের ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ডের কিবোর্ডবিহীন লাইনআপের লিড গিটারিস্ট ছিলেন তিনি, ছয়তারে জাদু ছড়িয়েছেন বিভিন্ন কনসার্টে-হোটেলে। আজম খান হৃদয় দিয়ে যেটা গাইতেন, সেটাকে গিটারে অনুবাদ করতেন নয়ন মুন্সী।

নয়ন মুন্সীর কবরফলক

ঢাকায় দীপ্তি ছড়িয়ে দারুণ কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে ১৮ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন কানাডার এডমন্টনে, যেখানে তাঁর বড় বোন থাকতেন। কানাডায় গিয়ে তিনি আরও মনোযোগের সঙ্গে গানবাজনা শুরু করেন। সেখানে তিনি ‘ফ্ল্যাশ ল্যান্ডিং’ নামে ব্যান্ডও তৈরি করেছিলেন। সেই ব্যান্ডে লিড গিটারিস্ট, ভোকাল এবং ব্যান্ডের ম্যানেজার ছিলেন তিনি। শুনেছি, অডিশনের মাধ্যমে নাকি বাকি সদস্য বাছাই করা হয়েছিল। এর পাশাপাশি নয়ন মুন্সী এডমন্টনের একটি পাঁচ তারকা হোটেলে নিয়মিত গিটার বাজাতেন, তাঁর দুর্দান্ত গিটার বাজানোতে মুগ্ধ হয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষ এটির নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য নয়ন মুন্সী শো’। সে সময়ে এডমন্টনে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো। চলতি পথে গাড়ির জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে সেখানেই গান গেয়ে, গিটার বাজিয়ে আলমগীর হক ও নয়ন মুন্সীর মুহূর্তেই প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করার গল্প এখনো লোকমুখে প্রচলিত।

প্রথম বাংলাদেশি গিটারবাদক হিসেবেও নয়ন মুন্সী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতি পেয়েছিলেন। একবার বিখ্যাত গিটারবাদক কার্লোস সান্তানার কনসার্ট–ট্যুর প্রমোশনের জন্য গিটার প্রতিযোগিতা হয়েছিল, কথা ছিল সেখানের বিজয়ী সুযোগ পাবেন সান্তানার সঙ্গে এক মঞ্চে বাজানোর। নয়ন মুন্সী সেখানে বিজয়ী হয়েছিলেন। আবার তখনই আমেরিকান এক রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কথা চলছিল তাঁর। যদিও এর কোনোটাই হয়নি আর। তার আগেই ঘটেছিল ভয়াবহ সেই সড়ক দুর্ঘটনা।

এত বড় একজন প্রতিভা, যাঁর উত্থান সহসা ধূমকেতুর মতো এবং প্রস্থান আকস্মিকভাবে। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো বিদেশি কোনো কনসার্টে তাঁকে দেখতে পেতাম, আর গর্ব করে বলতে পারতাম—এই তো আমাদের নয়ন মণি নয়ন মুন্সী।