বইপত্র

প্রেমের সঙ্গে বোঝাপড়া

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

আমার দুঃখভারাতুর বেশ্যাদের স্মৃতিকথা

আমার দুঃখভারাতুর বেশ্যাদের স্মৃতিকথা

মূল: গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
অনুবাদ: রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
প্রথমা সংস্করণ ২০১২
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
১১১ পৃষ্ঠা
দাম: ২০০ টাকা
মেমোরিয়া দে মিস পুতাস ত্রিস্তেস প্রকাশিত হওয়ার সময় মার্কেসের বয়স ৭৭। মূল স্প্যানিশ থেকে বাংলায় অনুবাদ করে রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী এই উপন্যাসিকার নাম দিয়েছেন আমার দুঃখভারাতুর বেশ্যাদের স্মৃতিকথা। নাম শুনে কারও কারও মনে হতে পারে, এটা বোধ হয় অত্যন্ত অশ্লীল বা যৌন উত্তেজনায় পরিপূর্ণ কোনো কাহিনি বা মনে হতে পারে, এতে আছে একের পর এক বেশ্যা ভোগের বয়ান বা বেশ্যাদের জীবনের প্রচণ্ড কষ্ট ও বেদনাই এর বিষয়। আদতে এর কোনোটাই নয়। এটি হলো একজন ‘যৌন-দুর্গত’ মানুষের ‘প্রেম-দুর্গত’ মানুষে পরিণত হওয়ার গল্প। ‘যৌন-দুর্গত’, কারণ এর কথক ১২ বছর বয়স থেকেই বেশ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে এবং পয়সা ছাড়া কোনো দিন কোনো নারীর সঙ্গে বিছানায় যায়নি (নিজের ৫০ বছর বয়সে একবার গুনে দেখে যে এদের সংখ্যা মোট ৫১৪ জন), এমনকি সেই নারী যদি বেশ্যা না-ও হয়, তাহলেও তাকে সে পয়সা নিতে বাধ্য করে, সেই লোকটি ৯০ বছর বয়সে এসে সত্যিকারের প্রেমিক হয়ে ওঠে।
লোকটি সাংবাদিক, অন্যদিকে একটি কলেজের স্প্যানিশ ভাষার অধ্যাপক; বাখ, মোৎসার্ট, শোপাঁ, ব্রাহম প্রমুখ সংগীত নিয়মিত শোনে, ক্ল্যাসিক সাহিত্য পড়ে; আর সে স্বীকার করে, বেশ্যাদের কারণেই তার বিয়ে করা হয়নি। সে আরও বলে, ‘আমি কোনো দিনই প্রেমে পড়িনি।’
আমার দুঃখভারাতুর বেশ্যাদের স্মৃতিকথা পড়তে পড়তে প্রেম ও যৌনতা সম্পর্কে চিরন্তন কথাগুলোই ফিরে ফিরে দেখতে পাই, অনুভব করতে পারি। প্রেম কী? ‘প্রেম দেহের নয়, মনের ব্যাপার,’ ‘প্রকৃত প্রেম যৌনতাশূন্য,’ ‘প্রেম রাশির ফের,’ ‘প্রেমে মিলনে না, বিরহেই সুখ,’ ‘প্রেমই বলে দেয়, ‘‘হু অ্যাম আই,” তুমি কে, কী তুমি।’ সোজা কথায়, প্রেম হলো আত্ম-আবিষ্কারের একটা পথ। বেশ কিছু নতুন কথাও পাওয়া গেছে, যেমন ‘ভালোবাসা না পেলে একমাত্র সান্ত্বনা হলো সেক্স।’
যে লোকটা কোনো দিন টাকা ছাড়া কোনো মেয়ের সঙ্গে শোয়নি, সেই লোকটা উঠতি বয়সের কোনো কুমারী ভোগ করে ৯০তম জন্মদিন উদ্যাপন করবে বলে মনে করেছিল, তা সে না করে চলে এল, তার পাশে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল রাত—এই তাক লাগানো ঘটনা দিয়ে শুরু হয় প্রথম অধ্যায়। পরের চার অধ্যায়েও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলে। প্রথমবার সেই রাত কাটানোর পর থেকে কোনোভাবেই মেয়েটিকে আর ভুলে থাকতে পারে না সে। মেয়েটিকে সে মনে মনে ‘দেলগাদিনা’ নাম দেয়। নিজের ঘরের ভেতরে তার অস্তিত্ব টের পায়। এরপর বার বারই দেলগাদিনার কাছে গিয়ে সে ওই একই কাণ্ড করে। গিয়ে দেখে মেয়েটি ঘুমাচ্ছে, তাই সেও ঘুমিয়ে পড়ে তার পাশে, আর ভোরে উঠে চলে আসে।
এ উপন্যাসিকা মার্কেস লিখেছিলেন ৫০ দশকের পটভূমিকে সামনে রেখে। দু-এক জায়গায় সেই সময়ের ইতিহাস হানা দিয়েছে; যেমন, ‘নির্লান্ডিয়ার-এর চুক্তি’, ‘শহিদ সান হুয়ান বাউস্তিতার স্মৃতিমাখা দিবস ২৯ আগস্ট।’ লাতিন আমেরিকার সমাজ-সংস্কৃতির সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়গুলো এখানে এসেছে, আর এসেছে মৃত্যুবোধ। সে টের পায়, ‘মৃত্যুই ধ্রুব।’ মৃত্যুর কথাটি সরাসরি এভাবে মাত্র একবার বলা হলেও পুুরো কাহিনিটি আসলে প্রেম ও মৃত্যুরই মুখোমুখি খেলা, আসলে তো জরাই মৃত্যু, যখন আর প্রেম বলে কিছু থাকে না।
মার্কেসই একবার বলেছিলেন, ‘প্রেমহীনতাই বৃদ্ধত্ব।’ আর এই কাহিনি বলে দেয়, প্রেমের উদ্বোধনই নতুন জীবন। ...গৌতম বুদ্ধ এক বৃদ্ধর কাছে তার বয়স জানতে চাইলে, বৃদ্ধটি বলে তার বয়স দুই বছর। বুদ্ধ একটু অবাক হয়ে বলেন, কিন্তু তোমাকে তো আশি বছরের বুড়োর মতো দেখাচ্ছে! বৃদ্ধ বলে, আমার বেঁচে থাকার বয়স আশি ঠিকই, কিন্তু মাত্র দুই বছর আগে আমি জানতে পারি প্রকৃত প্রেম কী। বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের দিকে তাকিয়ে বলেন, আজ থেকে তোমরা এভাবেই বয়সের সংজ্ঞা দেবে। মার্কেসের আমার দুঃখভারাতুর বেশ্যাদের স্মৃতিকথা যেন সেই নবজীবনটি কী, কী করে যৌনতার দাসত্ব থেকে মুক্তি মানুষকে দিতে পারে নতুন জীবন—তারই আধুনিক স্মারক। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত রফিক-উম-মুনীর চৌধুরীর প্রাঞ্জল অনুবাদে এ নভেলটি পড়া শুরু করলে শেষ না করে পারা যাবে না।